ইউরোতে রোনালদোর 'বোতল কাণ্ড' খেলায় বাণিজ্যিক প্রভাব সৃষ্টিকারীদের সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিল
বাণিজ্যিক জগত ক্রীড়াবিদ তারকাদের জনপ্রিয়তার নেতিবাচক দিক লক্ষ্য করেছে অতি-সম্প্রতি।
টুর্নামেন্টের সংবাদ সম্মেলনে তারকাদের দিয়ে ইভেন্ট স্পন্সররা তাদের পণ্যের প্রমোশন করান। গত সোমবার রাতে ইউয়েফা ইউরোপিয়ান ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ টুর্নামেন্টের সংবাদ সম্মেলনেও ছিল যার ধারাবাহিকতা।
কিন্তু, সোমবার পর্তুগিজ তারকা ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো যখন সামনে রাখা কোকোকোলার বোতল সরিয়ে দিলেন বিপত্তিটা ঘটে তারপরেই। এ ঘটনার পর বিপুল বাজারমূল্য পতন লক্ষ্য করেছে কোকাকোলা কোম্পানি।
সামাজিক মাধ্যমে বিশাল সংখ্যক অনুসারী-অনুরাগী থাকা মাত্র একজন তারকা কীভাবে কোনো কোম্পানির সাথে ক্রীড়া টুর্নামেন্ট বা দলের লাভজনক বাণিজ্যিক সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেন- তারই প্রমাণ ছিল এ ঘটনা।
গেল বছর মহামারির কারণে হয়নি ইউয়েফা ইউরো- ২০২০ আয়োজন। তবে এবছর ইউরোপে টিকাকরণ বাড়ায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তুমুল জনপ্রিয় এ ক্রীড়া মহাযজ্ঞের আনুষ্ঠানিক স্পন্সর হচ্ছে বেভারেজ জায়ান্ট কোকাকোলা। অন্য স্পন্সরদের মধ্যে আছে; বিয়ার প্রস্তুতকারক হ্যানিকেন এনভি, জাস্ট ইট টেকওয়ে ডটকম, কাতার এয়ারওয়েজ, বাইটড্যান্স লিমিটেডের টিকটক এবং ইলেকট্রনিক্স গ্রুপ ভিভো।
ক্রীড়া জগতের বাণিজ্যিক তথ্য-উপাত্ত পরিবেশক সংস্থা- স্পোর্টস বিজনেস সূত্রে জানা গেছে, এই টুর্নামেন্টে যুক্ত হতে স্পন্সররা মোট ৩ কোটি ইউরো দিয়েছে।
কোকোকোলা কোম্পানি সরাসরি রোনাল্ডোর স্পন্সর না হলেও, তার কর্মকাণ্ডে সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে। ইউরোপিয় চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা পর্তুগিজ অধিনায়ক, সংবাদ সম্মেলনে সামনে থাকা কোকাকোলার বোতল সরিয়ে এক বোতল পানি সামনে রেখে বলেন, 'আগুয়া' (পর্তুগিজ ভাষায় যার অর্থ পানি), যেন তিনি সকলকে কোকাকোলা ছেড়ে শুধু পানি পানেই উৎসাহিত করছেন। এই ঘটনায় উদ্বিগ্ন বিনিয়োগকারীরা কোকাকোলার শেয়ার বিক্রি শুরু করলে কার্যদিবসের লেনদেনে চারশ কোটি ডলার বাজারমূল্য কমে কোম্পানিটির। ফলে শেয়ারপ্রতি মূল্যও আগের ৫৬.১০ ডলার থেকে নেমে এসেছে ৫৫.২২ ডলারে।
এখানে দোষ শুধু কোনো ব্যক্তির নয়, গত ১০ বছর ধরে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও দল ছেড়ে ব্যক্তিমুখী হয়েছে। যেমন; রোনাল্ডের স্পন্সর নাইকি ইঙ্ক। সে তুলনায় একক তারকার পেছনে মার্কেটিংয়ের সমুদয় অর্থ খরচ না করে একাধিক ম্যাচের ক্রীড়ানুষ্ঠানে বিনিয়োগ করেছে কোকাকোলা।
উদ্যোগটি ঝুঁকিমুক্ত নয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু, আজকের দিনে স্পোর্টস ইনফ্লুয়েন্সারদের সর্বব্যাপী প্রভাব বলয়ের অর্থ- কোনো কোম্পানিই আজ তাদের নিজস্ব বাণিজ্যিক গণ্ডিতেও সুরক্ষিত নয়।
এই দায়ভার কোনো একক ব্যক্তির হলে, সেজন্য কিম কারদেশিয়ানকে দায়ী করা উচিত। সত্যিকার অর্থেই এ তারকা ও উদ্যোক্তা ইনফ্লুয়েন্সার শিল্পের শুরুটা করেন। ফলে আজ ক্রীড়া, পপ তারকা বা ফ্যাশন আইকনদের অনুকরণে কোনো পণ্য কেনা বা নতুন পোশাক পরিধানের চল দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপী।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অনুসারী থাকা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো
ব্যক্তির পেছনে বিজ্ঞাপনী ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধির দিক থেকে এগিয়ে আছে অ্যাডিডাস এজি। কোম্পানিটি দলের পেছনে ব্যয়ের চাইতে বেশি মার্কেটিং ব্যয় করছে পল পগবা ও লিওনেল মেসি'র মতো তারকাদের স্পন্সরে। তাছাড়া, ঐতিহ্যবাহী স্পোর্টসওয়্যার ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘমেয়াদী পার্টনারশিপের চুক্তি রয়েছে র্যাপার কেনি ওয়েস্টের সঙ্গে। অ্যাডিডাস সম্প্রতি বিয়ন্সের আইভি পার্ক স্পোর্টস ফ্যাশনও যুক্ত করে নিজ পণ্য সমাহারে।
সে তুলনায় প্রতিদ্বন্দ্বী নাইকি বরাবরই শীর্ষ ক্রীড়াবিদদের যুক্ত করছে। এনিয়ে তাদের ইতিহাসও দীর্ঘদিনের। বাস্কেটবল মহাতারকা মাইকেল জর্ডানও অ্যাডিডাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ফুটবলের নেইমার, বাস্কেটবলে লি ব্যারন জেমস এবং টেনিসে সেরেনা উইলিয়ামস ও নাওমি ওসাকার মতো তারকাদের স্পন্সর করছে অ্যাডিডাস।
সাম্প্রতিক সময়ে অবশ্য কিছু দলীয় চুক্তিও করেছে কোম্পানিটি। তবে ব্লুমবার্গ ইন্টেলিজেন্সের পুনম গয়াল জানান, পণ্যের প্রদর্শন ও ভোক্তাদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে নাইকি এখনও সেলিব্রেটি দূতদের উপর অধিক নির্ভরশীলতার নীতিতে আস্থা রাখে।
মাঠের লড়াই:
ক্রীড়া জগতের শীর্ষ তারকারা নাইকির দখলে থাকলেও, ফুটবলার ব্যক্তিত্বদের সংখ্যা বেশি অ্যাডিডাসের।
তারকাদের বিজ্ঞাপনে যুক্ত করার বড় ঝুঁকিও আছে। অনেক সময়েই তারা উল্টোপাল্টা আচরণ করে সমালোচনার জন্ম দেন। অনেক সময় পুরোনো স্পন্সর ছেড়ে নতুন স্পন্সরের সঙ্গেও চুক্তি করে ফেলেন। জিমন্যাস্টিক্স তারকা সাইমন বিলস সম্প্রতি নাইকি ছেড়ে গ্যাপ ইঙ্কের সহযোগী প্রতিষ্ঠান অ্যাথলেটার সঙ্গে চুক্তি করে তেমন ঘটনারই জন্ম দেন।
সবচেয়ে বড় ঝুঁকি অবশ্য আরেক জায়গায়, ভোক্তাদের ওপর কোনো কোনো স্পন্সর কোম্পানির চাইতেও তারকাদের প্রভাব অনেক বেশি। যেমন; সামাজিক মাধ্যমে রোনাল্ডোর মোট অনুসারী সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি। এসব অনুরাগীর সিদ্ধান্ত গ্রহণেও এ মহাতারকার ভূমিকা অপরিসীম।
তাই ঝামেলা এড়াতে অনেক সময় খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত পছন্দকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে স্পন্সর প্রতিষ্ঠান। যেমন, ধর্মপ্রাণ মুসলিম হিসেবে খ্যাত পল পগবা অ্যালকোহল ও জুয়ার সঙ্গে যুক্ত পণ্য বা পরিষেবার বিজ্ঞাপন করেন না। গত মঙ্গলবারের ইউয়েফা ম্যাচে ফ্রান্সের হয়ে জার্মানিকে হারাতে সহজাত নৈপুণ্য দেখিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন পগবা। কিন্তু, সংবাদ সম্মেলনের সময় তিনি সামনে রাখা হ্যানিকেন বিয়ারের বোতল সরিয়ে দেন। হ্যানিকেন কিন্তু তাতে বাজারমূল্য হারায়নি, বরং বুধবারের লেনদেন ১.৪ শতাংশ বেড়েছে তাদের শেয়ারমূল্য।
কিন্তু, রোনাল্ডের কাণ্ড বাজারকে প্রভাবিত করেছে অন্য কারণে। পেশাদার ফুটবল যেমন আকর্ষণীয় ক্যারিয়ার, তেমনটাই বিপজ্জনক। পদে পদে থাকে ইনজুরি ও ফিটনেস হারানোর ঝুঁকি। অনেক তারকার ক্যারিয়ারে ৪০-এর ঘরে পা রাখার আগেই সূর্যাস্তের আভাস দেখা যায়। বিষয়টি রোনাল্ডোর অজানা নয়, তবে কঠোর ডায়েট ও শরীরচর্চার মাধ্যমে নিজেকে ফিট রেখে ৩৬ বছর বয়সেও মাঠ কাঁপাচ্ছেন তিনি। বিষয়টি তার ভক্ত ও অনুসারীরাও জানেন। তাই তিনি যখন কোকাকোলার বোতল সরালেন, তখন কোমল পানীয়ের স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকটিও মানুষের মনে নতুন করে ছাপ ফেলাটাই স্বাভাবিক।
ফলে ভবিষ্যতে কোনো তারকার কারণে অন্যান্য ভোক্তাপণ্যের উৎপাদকদেরও এমন নেতিবাচক অবস্থায় পড়ার ইঙ্গিত মিললো।
- লেখক: ভোক্তা ও খুচরা পণ্য শিল্প বিষয়ক ব্লুমবার্গের কলামিস্ট আন্দ্রেঁ ফেলস্টেড। ইতঃপূর্বে, তিনি প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক ফিনান্সিয়াল টাইমসে যুক্ত ছিলেন।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ