ইতিহাস গড়ে জীবন চলছে না, চাকরির খোঁজে সালমা
তার হাত ধরে বাংলাদেশের ফুটবলে ইতিহাস রচনা হয়ে গেছে। প্রথম নারী রেফারি হিসেবে পুরুষদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লিগে দায়িত্ব পালন করেছেন সালমা আক্তার। গত সোমবার বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ ও উত্তর বারিধারা ক্লাবের মধ্যকার ম্যাচে সহাকারী রেফারির দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
এরপর থেকে অভিনন্দনে ভাসছেন সালমা, হচ্ছেন খবরের শিরোনাম। উচ্ছ্বাস ভরা কণ্ঠে অনুভূতির কথা জানাচ্ছেন তিনি। কিন্তু এই উচ্ছ্বাসেই মিশে আছে লড়াই না চালিয়ে যেতে পারার ভয়, স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা।
মাত্র ১৪ বছর বয়সে রেফারিং শুরু করা সালমা কেবল নিবেদনের জায়গাতেই নজর দিয়ে রাখতে পারছেন না। ইডেন মহিলা কলেজের দ্বিতীয় বছরের এই শিক্ষার্থীকে করতে হচ্ছে চাকরির সন্ধানও। রেফারিং থেকে সেভাবে উপার্জন হয় না বলে সালমার আকুতি, 'একটা চাকরি হলে স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে এগিয়ে যেতে পারতাম।'
কদিন আগে ইতিহাস গড়া সালমা আনন্দের রেশের মাঝেই বলে ফেলছেন 'আজ রাতে ভাবতে হয় কাল কী খাব।' কেবল নিজের কথাই নয়, পরিবারের চিন্তাও তাকে ভাবায়। কিছুদিন আগেই বাবাকে হারিয়েছেন, সংসারের হাল ধরা ছাড়া উপায় নেই তার।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় রেফারিংয়ে আসা, অনিশ্চিত জেনেও রেফারিংয়ে ক্যারিয়ার শুরু করা, লেখাপড়ায় হাল না ছেড়ে দেওয়া, অর্থকষ্ট, রেফারি হিসেবে দেখা স্বপ্নসহ আরও অনেক জীবন যুদ্ধের কথা জানিয়েছেন ২৩ বছর বয়সী সালমা।
টিবিএস: বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের সর্বোচ্চ পর্যায়ে প্রথম নারী রেফারি আপনি, আপনার হাত ধরে একটা অধ্যায়ের শুরু। এটা কতোটা গর্বের?
সালমা আক্তার: এটা আমার জন্য অবশ্যই অনেক বড় গর্বের, খুব ভালো লাগছে আমি আমার স্বপ্নের পথেই হাঁটছি। আমিই যেহেতু প্রথম, সবার আগে আমরা নামটাই থাকবে; এটা অনেক তৃপ্তিদায়ক। গর্ব করার মতোই একটা ব্যাপার। এটা আমাদের ফুটবলে ঐতিহাসিক একটা ঘটনার মতোই। ম্যাচে দায়িত্ব পালন করার আগ পর্যন্ত বুঝতে পারিনি এমন হবে। ম্যাচ শেষ হওয়ার পর এতো আলোড়ন তুলবে বুঝিনি। সব মিলিয়ে দারুণ একটা অনুভূতি, আমি খুবই উচ্ছ্বসিত।
টিবিএস: এতোদিন নারী ফুটবলে রেফারিং করেছেন, এবার করলেন পুরুষ ফুটবলে। সেদিন রেফারিং করার সময় কেমন লাগছিল?
সালমা: মাঠে নামার আগে চিন্তা হচ্ছিল। ভাবছিলাম কী হবে, কেমন করব। মাঠে নামার পর ওই চিন্তা চলে যায়। চিন্তা না থাকায় ভালোভাবে ম্যাচের দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছি। ভালোভাবেই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।
টিবিএস: কী ভেবে আপনাকে পুরুষদের ফুটবলে রেফারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, রেফারিজ কমিটি আপনাকে কিছু জানিয়েছে?
সালমা: হ্যাঁ, কারণটা আমি নিজেও জানি। আমার একটা ম্যাচের দরকার ছিল এলিট প্যানেলে অন্তর্ভুক্তির জন্য। এই ম্যাচের ভিডিও এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনকে (এএফসি) পাঠানো হবে। গত দুই বছরের মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছি, এমন ম্যাচ ভিডিও চেয়েছে ওরা। সহকারী রেফারি হিসেবে আমার তেমন ম্যাচ করা হয়নি, করলেও ভিডিও নেই। তো এখন যেহেতু মেয়েদের কোনো ম্যাচ নেই, তাই আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
টিবিএস: দায়িত্ব পালনের পর সবার মূল্যায়ন কী?
সালমা: সবাই খুব খুশি। ম্যাচ শেষে সবাই খুব আন্তরিকতা দেখিয়েছেন, অভিনন্দন জানিয়েছেন। সুযোগ পেয়ে যে ভালো করতে পেরেছি, সেটা সবার কথা শুনে বুঝেছি। এটা দারুণ একটা ব্যাপার। সবার সমর্থন, সহযোগিতার জন্য উনাদের আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই।
টিবিএস: ফুটবলে আসাটা কীভাবে, কতোদিন খেলেছেন?
সালমা: আসলে সেভাবে আমার ফুটবল খেলা হয়নি। জেলা পর্যায়ে খেলেছি। তবে খুব বেশি সময় খেলা হয়নি।
টিবিএস: সেভাবে ফুটবল না খেলেও রেফারিংয়ের প্রতি আগ্রহ জন্মালো কীভাবে? কখন মনে হলো রেফারি হবে, এই গল্পটা শোনাবেন…
সালমা: আমি আসলে অ্যাথলেট ছিলাম। আমি লং জাম্প খেলতাম। রেফারিংয়ে আসার পর আর খেলা হয়নি। ক্লাস টেনের পর আর লং জাম্প খেলিনি। আমার ভাইকে আমি ফুটবল খেলতে দেখেছি। ও জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে খেলেছে, ক্লাবে মাঝে মাঝে আসতো। যেহেতু আমি অ্যাথলেট ছিলাম, আমার বাবারও ইচ্ছা ছিল আমি যেন ফুটবলে যাই। উনি ফুটবল পছন্দ করতেন। আমি স্কুল ফুটবল, জেলা পর্যায়ে খেলেছি। আমাদের এখানে সেভাবে সুযোগ হয়নি। দল ছিল না, খেলার মতো মেয়ে ছিল না। শুধু ছেলেরাই অনুশীলন করতো। আমিও ওদের সাথে অনুশীলন করতাম। তবে বেশিদিন খেলা হয়নি।
ফিফার সহকারী রেফারি ফেরদৌস আহমেদ আমার আত্মীয়, পাশাপাশি বাসা আমাদের। উনাকে আমি বলি, ফুটবল খেলতে চাই। উনি আমাকে বলেন, "ফুটবলে থাকতে চাও, চাইলে আমাদের মেয়েদের রেফারিংয়ে সুযোগ আছে, দেখো।" তো ২০১২ সালে আমি কোর্সটা করি ওনার তত্ত্বাবধানে। ওই সময়ে উনি আমাকে অনেক সহযোগিতা-সমর্থন দিয়েছেন। উনি আমাকে স্বপ্ন দেখাতেন, "এখন পর্যন্ত আমাদের মেয়েরা ফিফাতে যেতে পারেনি, তুমি পারবে।" এরপর উনি আমার বাসায় জানান এটা। বাসার সবাই এটা ইতিবাচকভাবেই নেয়। তাদের চাওয়াও ছিল আমি যেন ফুটবলের সাথে থাকি।
তো এভাবেই শুরু রেফারিংয়ে। ঢাকায় আসার পরে ২০১৩ সাল থেকে রেফারিং করে আসছি। ঢাকায় আসার পরে স্যাররা আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন। সবাইকে খুব ইতিবাচক দেখেছি। কেউ কখনও থামিয়ে দেওয়ার মতো কিছু করেননি। সব সময় সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথাই বলেছেন। প্রথমত পরিবার, পরে এখানে এসে সবারই সমর্থন পেয়েছি।
টিবিএস: অনেকের সমর্থনের কথাই বললেন। রেফারিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে কার সমর্থন বা সাহস যোগানো বেশি আত্মবিশ্বাস দিয়েছে? কার কথায় মনে হয়েছে যে আপনি পারবেন।
সালমা: শুরুর দিকের কথা বললে আমি ফেরদৌস ভাইয়ের কথা বলব। উনি শুরু থেকেই আমাকে অনেক সমর্থন করতেন। ঢাকায় আসতেন উনি, আমাকে আসতে বলতেন। এরপর এখানে আসার পর মাঝে মনক্ষুন্ন হয়ে আমি রেফারিং ছেড়ে দিই। ২০১৬ থেকে ২০১৭ আমি রেফারিং করিনি। ২০১৭ তে আবার ফিরি। এ সময় ফিফার রেফারি পরীক্ষায় আমি ফেইল করি। এরপর ২০১৮ তে ভুটান যাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়। যাব কিনা ভাবছিলাম, তখন ফিফার সহকারী রেফারি মাহমুদ জামাল ফারুকী নাহিদ আমাকে সমর্থন দেওয়া শুরু করেন। এর আগে আমার কোনো ফেইল ছিল না, এটা আমার প্রথম ফিফা পরীক্ষা ছিল। তো এরপর নাহিদ ভাই আমার শিক্ষক হয়ে গেছেন। উনার কথা মতোই সব করতাম।
২০১৮ সালে ফিফার পরীক্ষা আমি আর দিইনি। আমি চাকরি শুরু করি, একটা বেসরকারি স্কুলে চাকরি শুরু করি। ভালো করার জন্য এ সময় প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কারণ মেয়ে মানুষের এভাবে ঢাকা শহরে টিকে থাকতে গেলে অনেক কিছুরই প্রয়োজন হয়। বিশেষ করে টাকা পয়সার প্রয়োজন হয়। ওটাও তো আমাকে দেখতে হবে। কেউ তো আর এই বিষয়টা দেখবে না। আমাদের ম্যাচ ফিও সে সময় খুব একটা ভালো ছিল না। ম্যাচ তো একদমই ছিল না মেয়েদের। বছরে একটি-দুটি টুর্নামেন্ট হতো বড়জোর। তাই নিজেকে নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম। আমি ভুটান যাই ১৮ সালে। তারপর ২০১৯ সালে আবার ফিফাতে যাই। আবার পরীক্ষা দিই, এরপর আমি পাশ করি। পুরোটা গাইড লাইনের পেছনে নাহিদ ভাই ছিল। এখনও উনিই আছেন।
টিবিএস: আপনি ফিফার সহকারী রেফারি। স্বপ্নের এই ধাপে পৌঁছানোর পথটা কতোটা কঠিন ছিল?
সালমা: আমি ২০১৯ সালে পাস করি। ফিফাতে নাম পাঠানোর পরে দেখা গেল, আমার ফেডারেশন জানতো না যে বয়সের একটা ব্যাপার আছে। প্রথম বছর আমি বয়সের কারণে বাদ পড়েছি। তখন আমার বয়স ২২ বছরের কম ছিল। একবার আপনি ফিফাতে পাস করলে আপনি এক বছরের জন্য ফিফা রেফারি। প্রতি বছরই আপনাকে পাস করতে হবে। ২০১৯ সালে যখন কাগজ দিলাম। তখন জয়া আপুর হলো, আমার হয়নি। কেউই জানতো না এখানে বয়সের একটা বাধা আছে।
এরপর আমি ২০২০ সালে দিই। তখনও আমার বয়স ২২ বছরের একদিন কম ছিল। তখন ফেডারেশন থেকে আমার জন্য স্পেশাল একটি চিঠি পাঠায় ফিফার কাছে। যেন তারা একদিন বিবেচনা করে। ফিফা তখন বিবেচনা করে। ২০২১ সালে আমি ফিফা সহকারী হই। এখন এলিট প্যানেলের জন্য ভিডিও দরকার। ফিটনেস পরীক্ষা গতকাল দিয়ে ফেলেছি। বেসিক পরীক্ষাগুলো হয়ে গেছে গত মাসে। এই মাসে গেমগুলো পাঠিয়ে দেবে। গতকাল আমি পরীক্ষা দিয়েছি, পাস করেছি। ওই পরীক্ষার ভিডিওটাও পাঠাবে। এরপর তারা বিবেচনা করে আমাকে এলিটে দেবে। ২০২২ সালের জন্য আমি ফিফা হয়ে গেছি। আমাদের এই ২৮ তারিখ হওয়ার কথা ছিল। এএফপির সময় কম, তো কালকের মধ্যেই পাঠাতে হবে।
টিবিএস: রেফারি হিসেবে কাউকে অনুসরণ করেন, কিংবা কাউকে আদর্শ মানেন?
সালমা: এ রকম অনেকেই আছে। কে কেমন ম্যাচ করে ভালোটাই নিই। বাংলাদেশে আপনি বলতে পারেন মিজানুর রহমান ভাই নিঃসন্দেহে ভালো। সহকারী হিসেবে নাহিদ ভাইয়ের কথা বলব, মোহাম্মদ নুরুজ্জামান আছেন। শাহ আলম আছেন, উনিও ফিফার রেফারি হয়ে গেছেন। আমি উনাদের অনুসরণ করি। বাইরের দেশের কারও কথা যদি বলেন, আমি ভারতের এক জনকে অনুসরণ করি। এলিট প্যানেলে আছেন, নাম রঞ্জিতা। সেও ভালো। ২০১৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ এখানে এসেছিলেন তিনি।
টিবিএস: এখন পর্যন্ত কতগুলো ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বাইরের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
সালমা: অনেক ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছি। ফোর্থ অফিসিয়াল হিসেবে শুরু করেছিলাম। এভাবেই শুরু হয় সবার। এরপর সহকারী, তারপর রেফারি। স্কুল টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু করি। ২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০১৫ সালে নেপাল গিয়েছি। ভুটান গিয়েছি দুইবার। বাংলাদেশে সাফে দায়িত্ব পালন করেছি, অনূর্ধ্ব-১৯ করেছি। প্রথম দুটি বদেশ সফরে আমি কোর্স করতে যাই। এরপর একটা টুর্নামেন্টও ছিল, যেখান থেকে আমি কোনো টাকা-পয়সা পাইনি। এরপর বাংলাদেশে অনূর্ধ্ব-১৫ নারী সাফ হলো, সেখানে দায়িত্ব পালন করি। এখানে থেকে কিছু টাকা পয়সা পেয়েছি। এরপর ভুটান গেলাম দুইবার অনূর্ধ্ব-১৫ করতেই। এখানে পারিশ্রমিক পেয়েছি। তবে দেশে অনূর্ধ্ব-১৯ করেছি, সেখান থেকে কিছু পাইনি।
টিবিএস: রেফারিং নিয়ে কী স্বপ্ন দেখেন? নিজেকে কোথায় দেখতে চান?
সালমা: রেফারিং নিয়ে আমার স্বপ্ন এলিট হওয়া। এরপর আন্তর্জাতিক ম্যাচ করা। ভালো জায়গায় চলে যাওয়া, দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা। মূল রেফারি হতে গেলে আমার বয়স লাগবে। এখনও বয়স হয়নি। এখন সহকারী থেকে এলিটে গিয়ে ভালো কিছু করার ইচ্ছে আছে। এরপর চিন্তা ভাবনা করব।
টিবিএস: আপাতত রেফারিং নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
সালমা: এখন আমি যে জায়গাটায় আছি, আমাকে যদি এলিট প্যানেলে ডাকে তাহলে আশা করি আমাকে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচেও ডাকবে। তো দেখা যাক, চালিয়ে যেতে থাকি।
টিবিএস: বাংলাদেশের ফুটবলে টাকার ঝনঝনানি নেই। ঠিক কী ভেবে রেফারিংয়ে আসা?
সালমা: এটা যদি বলেন, আমি বলব রেফারিংয়ে এসেছি শুধু সম্মানের জন্য। এখানে ম্যাচ ছাড়া আমার কোনো আর্থিক সাপোর্ট আসে না। যে কারণে বাংলাদেশে এটা ধরে রাখা কষ্টকর। খুবই কঠিন একটা বিষয়। কারণ এখানে অনেক পরিশ্রম করতে হয়। ভারতে, ভুটানে দেখেছি, নারী রেফারিদের সরকারী চাকরি দিয়ে দেওয়া হয়। ভালো করলে তাদের নিয়ে ভাবা হয়, চাকরি দেওয়া হয়। তারা নিজেদের চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়। জানি না সামনে কতোটা এগোতে পারব। কারণ আর্থিক ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়া, থাকা, অনুশীলনের সরঞ্জামসহ সব মিলিয়ে অনেক খরচ।
আমরা ওইভাবে ম্যাচও করতে পারি না। আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচও পাইনি সেভাবে। এখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাধারণ ম্যাচগুলোতে আমাদের খুব একটা টাকা দেওয়া হয় না। তবে দুই বছর আগে মহিলা লিগে টাকার পরিমাণ ভালো ছিল, ম্যাচ ফি বাড়িয়েছে। কিন্তু এখন টিকে থাকাটা আমার জন্য কঠিন। সত্যি বলতে আমার এখন একটা চাকরি দরকার। একটা চাকরি পেলে আমি রেফারিংটা ধরে রাখতে পারব। এমন না হলে চালিয়ে নিতে পারব কি না আমি জানি না। সম্মান ধরে রাখতে হবে ঠিক আছে, কিন্তু এর জন্য অনেক কিছুরই দরকার। আমার বাবা নেই, কিছুদিন আগে মারা গেছেন। আমারটা আমাকেই ভাবতে হবে। মা-বোনদের চিন্তাও করতে হবে।
টিবিএস: আর্থিক বিষয়টা আপনি বেশ কয়েকবার উল্লেখ করলেন। তাহলে নিশ্চয়ই এখানকার আর্থিক কাঠামোর উন্নয়ন চান?
সালমা: তাতো অবশ্যই। সত্যি কথা বলতে আমার একটা চাকরি দরকার। যেন আমি নিজেকে এখানে টিকিয়ে রাখতে পারি। এ জন্য চাকরিটা খুব জরুরি। আমি ইডেনে পড়ালেখা করছি, তবে পাঁচ বছরের সেশন জটে আছি। আমি ১৬-১৭ এর ব্যাচ, আমাদের পরীক্ষাও হচ্ছে না। সত্যি বলতে অনেক সমস্যা। রেফারিং এবং পড়াশোনা দুইটা সামলানো একটু কষ্ট হয়। যদিও আমি স্টুডেন্ট খুব একটা ভালো না (হাসি), বলতে সমস্যা নেই। তাই হয়ে যায় আরকি, ম্যানেজ করতে পারি। তবে একটা সাপোর্ট থাকলে আমি চাকরির পাশাপাশি এটাও সুন্দরভাবে করতে পারতাম। মানে আমার আর কালকের জন্য চিন্তা করতে হতো না। আমাদের তো চিন্তা করতে হয়, আজ রাতে ঘুমানোর সময় চিন্তা করতে হয় কাল আমি কী খাব, কীভাবে চলব।
টিবিএস: বাংলাদেশের ফুটবলে রেফারিংয়ে আরও মেয়েদের আসার সুযোগ আছে কী না?
সালমা: সুযোগ তো অবশ্যই আছে। কিন্তু আমরা যারা আছি বা আমার কথা বলি। আমরা অনেক গরিব পরিবার থেকে আসা। আমিও গরিব পরিবার থেকে এসেছি। এখানে টিকে থাকার জন্য যেটা আমি আগেই বলেছি সাপোর্ট বা টাকা দরকার। ফেডারেশন থেকে পৃষ্ঠপোষকতা বা সমর্থন খুবই দরকার। তাহলে মেয়েদের আসার পথ সহজ হবে। আমি যেমন আমার পরিবারকে বলার পর জিজ্ঞেস করেছিল, ওখানে কেন যেতে চাও, কী হবে ওখানে গেলে। আমি ওখানে গিয়ে ম্যাচ করব, শুধু খরচই করব কিন্তু পাব না, তাহলে কীভাবে। এটা দুই-তিন বছর হতে পারে। এরপরও না হলে কোন পরিবার মেনে নেবে না। আর মেয়েদের অনেক সুযোগ আছে এখানে। আমরা আছি, অনেকেই আসতে পারে। আমাদের দেশে এখন দুটি কোটা, মেয়েরা ভালো কারলে কোটা বাড়তে পারে।
টিবিএস: রেফারিংয়ে আসার মধ্য দিয়ে দেশের ফুটবলে নারীদের অবদান রাখার ক্ষেত্র কী বাংলাদেশে আছে?
সালমা: অবশ্যই অবদান রাখার আছে। কারণ, আমাদের নারী জাতীয় ফুটবল দল অনেক এগিয়ে গেছে আগের চেয়ে। বড় বড় টুর্নামেন্ট খেলছে, ভালো পারফরম্যান্স করছে। আশা করি সামনে আরও ভালো করবে। উনারা ভালো করলে আমাদেরও ভালো করার সুযোগ তৈরি হবে।
টিবিএস: ফুটবলারদের মতো রেফারিদেরও রুটিন মেনে চলতে হয়, নিয়মিত অনুশীলন চালিয়ে যেতে হয়। আপনার রুটিন কেমন, কীভাবে মানিয়ে নেন?
সালমা: এটা আসলে ব্যক্তিগতভাবে মানিয়ে নিতে হয়। কারণ আমার আর আপনার রুটিন এক হবে না, অনুশীলন এক হবে না। নিজেকেই রুটিন তৈরি করে নিতে হবে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কখন কী করবেন, সেটা আপনাকে ঠিক করতে হবে। কতক্ষণ লেখাপড়া করবেন, কতক্ষণ অনুশীলন করবেন, কী খাবেন, কী খাবনে না; এটা আপনাকে ঠিক করতে হবে। রেফারিজ কমিটি থেকেও নির্দেশনা থাকে। আমাদের ফিটনেস ইনস্ট্রাক্টর আছেন। চন্দন স্যার কিছুদিন পর পরই আমাদের বিষয়গুলো দেখেন। অনুশীলন থেকে শুরু করে সব বিষয় তদারকি করেন। উনি আমাদের নিয়ে কাজ করেন।