কোভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কি অলিম্পিকে পারফরম্যান্সে প্রভাব ফেলেছে?
নারীদের ১০০ মিটারে ফ্লোরেন্স গ্রিফিথ জয়নারের রেকর্ড ৩৩ বছর পর্যন্ত অভেদ্য ছিল। এবার টোকিওর শূন্য স্টেডিয়ামে সেই রেকর্ড ভাঙলেন জ্যামাইকান দৌড়বিদ ইলেইন থম্পসন-হেরা।
করোনা মহামারির জন্য দর্শকরা মাঠে যোগ দিতে না পারলেও অলিম্পিকের এবারের আসরে ১৬ দিন জুড়েই ছিল রেকর্ডের ছড়াছড়ি।
অলিম্পিকের সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই খেলা, সাঁতার ও অ্যাথলেটিক্সে যথাক্রমে ছয় ও তিনটি রেকর্ড ভাঙা হয়েছে টোকিওতে। ট্র্যাক সাইক্লিংয়ে ভাঙা হয়েছে তিনটি বিশ্বরেকর্ড।
সাঁতার ও অ্যাথলেটিক্সে গত অলিম্পিকের সমান নতুন বিশ্ব রেকর্ড তৈরি না হলেও, কোভিড সংক্রান্ত বিধিনিষেধ যে বিশ্বের সেরা অ্যাথলেটদের কোনোভাবে কাবু করতে পারেনি, সেটা অন্তত পরিষ্কার। রিও অলিম্পিকে সাঁতারে আট, অ্যাথলেটিক্সে তিন ও সাইক্লিংয়ে চারটি নতুন বিশ্বরেকর্ড তৈরি হয়েছিল। আর এবার টোকিওতে, অ্যাথলেটরা সাতটি খেলায় মোট ২৩টি রেকর্ড ভেঙেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, এই অলিম্পিকে প্রযুক্তির ব্যবহার অ্যাথলেটদের অনেক সাহায্য করেছে, বিশেষ করে অ্যাথলেটিক্সে। মহামারির ফলে অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও অ্যাথলেটদের অনুশীলনের সূচি বিঘ্নিত হয়েছে। তবে এর ফলে নতুন ঘরানার প্রশিক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে বাধ্য হয়েছে তারা, যেগুলো আগের চেয়ে বেশি ফলপ্রসূ।
নরওয়েজিয়ান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোমেডিসিন এবং মুভমেন্ট সায়েন্সের অধ্যাপক অয়ভিন্দ স্যান্ডবাক বলেন, 'অলিম্পিকের সময় যেহেতু ক্রীড়াবিদরা তাদের সর্বোচ্চ শারীরিক সক্ষমতায় থাকে, তাই তখন তাদের কাছ থেকে বিশ্ব রেকর্ড আশা করাটাই স্বাভাবিক, বিশেষ করে দৌড় প্রতিযোগিতাগুলোয়। অন্যান্য ক্ষেত্রে, যেখানে পদক জেতাটাই মূল লক্ষ্য, সেখানে কৌশলগত উপাদানের জন্য রেকর্ড কিছুটা কম হয়ে থাকে।'
আয়ারল্যান্ড ভিত্তিক অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স কোচ এমেট ক্রাউলি বলেন: 'কোন সন্দেহ নেই যে কোভিড-১৯ কিছু ক্রীড়াবিদকে অন্যদের চেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। কিন্তু যারা ভালো অ্যাথলেট তারা ঠিকই সময়মত নিজের সর্বোচ্চটা দিতে পেরেছে। যারা পারেনি তার মূলত বয়স, শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক কারণে পারেনি।'
তিনি ব্রিটিশ সাঁতারু টম ডিনের উদাহরণ টানেন। ছয় মাসের মধ্যে দুইবার করোনায় আক্রান্ত হলেও দুই দুইটি স্বর্ণপদক নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন ডিন।
'দিনশেষে সেরা অ্যাথলেটরাই রাজত্ব করেছে। মহামারি আমাদের শিখিয়েছে আমরা চাইলে আরও দক্ষতার অনুশীলন করতে পারি। মাঝে মাঝে, কমই বেশি,' যোগ করেন ক্রাউলি।
করোনাকালে সবকিছু বন্ধ থাকায় ও কোচদের শরণাপন্ন হতে না পারায়, অনেক অ্যাথলেটকেই প্রয়োজনের তুলনায় কম অনুশীলন করতে হয়েছে।
স্যান্ডবাক বলেন, 'ভালো মানের প্রতিযোগিতার অভাব ও শেষদিকে পূর্ণাঙ্গ অনুশীলন করতে না পারায় কিছু অ্যাথলেট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দলগত খেলা এবং সার্বক্ষণিক কোচের সান্নিধ্য প্রয়োজন এমন খেলাগুলোয় অংশগ্রহণকারী প্রতিযোগীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।'
এই অলিম্পিকে ভাঙা রেকর্ডগুলোর বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন কেউ কেউ। ফিনল্যান্ডের তুর্কু বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিজ্ঞান ও দর্শন গবেষক মিকা হামালাইনেন বলেন, 'টোকিও অলিম্পিকে অ্যাথলেটিক্সে ভাঙা বিশ্বরেকর্ডগুলো আসলে প্রশ্ন তুলছে যে, আসলেই এসব রেকর্ডের পিছনে অসাধারণ কিছু ছিল কি না।'
'অ্যাথলেটরা পায়ে কি পরছে, সেদিকে তাকাতে পারি আমরা। যেমন কারস্টেন ওয়ারহলম কার্বনের স্পাইকসমৃদ্ধ জুতা পরে দৌড়েছেন। জুতার নিচে কী ছিল, সেদিকেও তাকাতে পারেন। এবারের ট্র্যাকের প্রশংসা সব অ্যাথলেটই করেছে।'
হতে পারে পাতলা জুতা, তার নিচে শক্ত পাটাতন অ্যাথলেটদের বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। কিংবা হতে পারে অলিম্পিক স্টেডিয়ামের ট্র্যাক, যেটি দৌড়বিদদের প্রতিটি পদক্ষেপের শক্তি শোষণ করে কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, তার জোরে ভালো করেছে অ্যাথলেটরা।
নরওয়ের হয়ে সোনা জেতার পথে, ওয়ারহলম ৪৫.৯৪ সেকেন্ড ৪০০ মিটার হার্ডলস শেষ করে নিজেই নিজের বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছেন। ওয়ারহলম একাই কিন্তু এতো জোরে দৌড়াননি, তার পিছনের সাতজনের ছয়জনই মৌসুমসেরা, আঞ্চলিক ও জাতীয় রেকর্ড ভেঙেছে।
দিনশেষে তাই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, এই বিশেষ জুতাগুলো কি তাহলে একরকম যান্ত্রিক ডোপ নেয়ার মতোই না?
'এসব [বিশ্ব রেকর্ড] কি কাম্য? আমরা বিশ্বাস করি যে বিশ্ব রেকর্ডের একটা মূল্য আছে। তাই আমরা রেকর্ড অর্জনের জন্য গ্রহণযোগ্য বা পছন্দসই পদ্ধতি বের করি। এখন যদি জুতার প্রযুক্তি দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড অর্জন করা যায়, আপনি কি সেটাই করবেন?' বলেন হামালাইনেন।
এদের সাথে পরিবেশগত ব্যাপারগুলোও যোগ করতে পারি আমরা। আবহাওয়া, প্রতিযোগিতার সময়, দর্শকের উপস্থিতি এগুলোও অ্যাথলেটদের খেলায় প্রভাব ফেলে। রিওর মতো এই অলিম্পিকেও গরম অনেক ভুগিয়েছে অ্যাথলেটদের। আগস্টের গরমে কর্তৃপক্ষ এবার একরকম বাধ্য হয়েই ম্যারাথনের ফাইনাল সরিয়ে নিয়েছিল টোকিও থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে উপকূলীয় শহর সাপ্পোরোতে।
গরমের জন্য মেয়েদের ম্যারাথন নির্ধারিত সময় থেকে এক ঘণ্টা এগিয়ে আনতেও বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দৌড়ের শেষে তাপমাত্রা ঠিকই ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াসে চলে গিয়েছিল। স্বর্ণের আশায় নামলেও ম্যারাথনের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন রুথ চেপেনগেটিচ দৌড় শেষই করতে পারেননি। তার মতো আরও ১৪ জন দৌড়বিদ ম্যারাথন শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে সেদিন।
বিশ্বরেকর্ড ব্যাপারটি যতই আকর্ষণীয় হোক, অনেকে বলে থাকেন, অলিম্পিক মূলত পদক জেতার জায়গা। এ ব্যাপারে ক্রাউলি বলেন, 'রেকর্ড না, অলিম্পিকে দিনশেষে সোনাই সবকিছু। এজন্য আপনাকে কৌশলী হতে হবে।'
'আমার মনে হয় না অ্যাথলেটরা রেকর্ড ভাঙার জন্য খেলতে নামে। হ্যাঁ, রেকর্ড তো থাকবেই। কিন্তু মানুষ চায় তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে, রেকর্ড কখনোই তাদের প্রধান চিন্তা হতে পারে না,' যোগ করেন ক্রাউলি।
- সূত্র- সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট