মার্কিন ফুটবল ঢেলে সাজানো কুইরোজই এখন মার্কিনদের প্রতিপক্ষ
বিশ্বকাপ গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন ৬৯ বছর বয়সী পর্তুগিজ কোচ কার্লোস কুইরোজ, যাকে একসময় পুরো একটি বছর কাটাতে হয়েছিল মার্কিন ফুটবলে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য।
কার্লোস কুইরোজ পাঁচটি মহাদেশে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, ছিলেন চারটি বিশ্বকাপের ডাগআউটে, সামলিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদ আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মতো বড় বড় ক্লাবও। এখন তার সামনে একমাত্র লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপে তার ইরান দলকে নিয়ে আরও একধাপ সামনে এগিয়ে যাওয়া।
১৯৯৮ সালের পুরো বছর ফ্লোরিডার টাম্পার এক অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছেন কুইরোজ, সারা যুক্তরাষ্ট্র চষে বেড়িয়েছেন দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রত্যেক স্তরের ফুটবলার আর কোচদের সাথে কথা বলার জন্য। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের সমস্যা খুঁজে বের করার জন্য, এবং কীভাবে ২০১০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফি উঁচিয়ে ধরতে পারবে তার সমাধানের জন্য।
তার অনুসন্ধান থেকে বের হওয়া প্রতিবেদন 'প্রজেক্ট ২০১০' ছিল অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের অ্যাপোলো ১১ মিশনের মতো। রিপোর্টের কভারে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল এক মার্কিন নভোচারীর ছবি, যার এক হাতে আমেরিকার পতাকা, অন্য হাতে বিশ্বকাপ। কুইরোজ তার সহযোগী পর্তুগিজ-আমেরিকান গোলকিপার কোচ ড্যান গ্যাসপারকে নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন। দুজনে মিলে ১১৩ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের বেশ কিছু সংকটের সমাধান দিয়েছিলেন, যার মধ্যে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের যুব খেলোয়াড়দের পাইপলাইন ঠিক রাখা, যুক্তরাষ্ট্রের বয়সভিত্তিক দলগুলোকে ঢেলে সাজানোর মতো প্রস্তাব। তার প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করেই যুক্তরাষ্ট্রে অনুর্ধ্ব-১৭ আবাসিক প্রোগ্রাম শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, যেটি এখন পুরো দেশজুড়ে কার্যকর। গ্যাসপার পরবর্তীতে বলেছিলেন, "আমার মনে হয় প্রতিবেদনটি বর্তমান মার্কিন ফুটবলের অনেক কিছুর ভিত্তি গড়ে দিয়েছে।" এদিকে গত সোমবার এক সংবাদ কনফারেন্সে কুইরোজ মন্তব্য করেন, "আমি যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের বিকাশে সাহায্য করেছি।"
তবে গ্যাসপার প্রতিবেদন নিয়ে যতটা না আশাবাদী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আন্দোলিত হয়েছেন কুইরোজের কাজের প্রতি মনোযোগ দেখে, "তার কাজের প্রতি ভালোবাসা, কাজের প্রতি তীব্রতা, তার পেশাদারিত্বের মানদণ্ড আমাকে প্রভাবিত করেছে। প্রতি সেকেন্ড, প্রতি মিনিট, প্রতি ঘণ্টা, প্রতি দিনের হিসাব তিনি রাখেন, যে প্রজেক্টে তিনি যুক্ত তার সবকিছু তিনি অর্জন করতে চান।"
প্রজেক্ট ২০১০
কুইরোজের ক্যারিয়ার শুরু হয়েছিল পর্তুগালের তৎকালীন উপনিবেশ মোজাম্বিকের ফুটবল দলের খেলোয়াড় হিসেবে। তবে মার্কিন ফুটবলের কর্তাদের নজর কাড়েন আশির দশকের শেষ দিকে যখন তিনি পর্তুগালের অনূর্ধ্ব-২০ দল নিয়ে পরপর দুইবার বিশ্বকাপ জেতেন। ওই সময়েই তিনি পর্তুগিজ-আমেরিকান ফুটবল কর্মকর্তা ফ্রান্সিস্কো মার্কোস এবং দুই দশক ধরে মার্কিন ফুটবলের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সুনীল গুলাতির সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
গ্যাসপারের সাথে তার সম্পর্ক অবশ্য হঠাৎ করেই শুরু হয়। ১৯৯১ সালে পর্তুগালের জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পান কুইরোজ। পরের বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে চার দেশকে নিয়ে একটি টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। সেখানেই কুইরোজের সাথে পরিচয় হয় গোলকিপিং কোচ গ্যাসপারের, বন্ধুত্ব হয় এবং একইসাথে একটি পেশাদার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কুইরোজের সাথে ফুটবল ও গোলকিপিং নিয়ে গভীর আলোচনার পর কুইরোজ তাকে নিজের ডান হাত বানিয়ে ফেলেন।
এরপর দুইজন পাড়ি জমান পর্তুগালে, দুইজনে কোচিংয়ের দায়িত্ব নেন লিসবনের ক্লাব স্পোর্টিং সিপির। তারপর একে একে নিউ ইয়র্ক মেট্রো স্টারস এবং জাপানের ক্লাব নাগোয়া গ্র্যাম্পাস এইটের দায়িত্ব নেন। সে সময়ই যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল বোর্ডের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট গুলাতি এবং প্রেসিডেন্ট অ্যালান রথেনবার্গ মার্কিন ফুটবল দল নিয়ে বিশ্বকাপ জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা হাতে নেন।
গুলাতির বক্তব্যনুযায়ী, "আমরা চাচ্ছিলাম যেন বাইরের কোনো চোখ এসে আমেরিকার ফুটবলের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে এবং বলে আমাদের কোথায় কোথায় উন্নতির সুযোগ রয়েছে।" বয়সভিত্তিক দলে কুইরোজের সাফল্য এবং একই সাথে তার বহু ভাষায় পারদর্শিতা নজর কেড়েছিল তাদের। ফলে কুইরোজের সাথে কথা বলতে জাপানে উড়ে যান তারা, কুইরোজকে রাজি করান যুক্তরাষ্ট্রে ফিরতে, কাজ করবেন একজন 'টেকনিক্যাল কনসালট্যান্ট' হিসেবে।
ঐ সময়ে ভাবা হয়েছিল কুইরোজের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ফুটবল দলের দায়িত্ব দেওয়া হবে। তবে কুইরোজ তখন নিজের লক্ষ্য নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। কয়েক মাস ধরে তিনি গাড়ি ড্রাইভ করে এবং অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে সারা দেশ চষে বেড়িয়েছেন। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে শুরু করে ফিফার মিটিং-এ গিয়েছেন। কথা বলেছেন কর্মকর্তা থেকে সাংবাদিক পর্যন্ত সবার সাথে। সাথে ছিলেন গ্যাসপারও। গ্যাসপার অবশ্য দাবি জানিয়েছিলেন কুইরোজ এবং তার জন্য আরও ভালো কোন আবাসনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু কুইরোজের এসব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না, তিনি কেবল নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন।
কয়েক মাস ধরে দৌড়াদৌড়ির পর দুজনে দিনের বেলা ১৯৯৮ বিশ্বকাপ ম্যাচ দেখতেন এবং রাতে প্রজেক্ট ২০১০-এর প্রতিবেদনের খসড়া লিখতেন। প্রতিবেদনের ষষ্ঠ পৃষ্ঠাতেই তিনি লেখেন, "আমার প্রিয় বন্ধুরা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভরপুর মানবসম্পদ এবং অপার সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে আশা এবং স্বপ্ন প্রায়ই বাস্তবতায় রূপান্তর হয়। ২০১০ সালের মধ্যে আপনাদের সামনে যুযোগ রয়েছে ফুটবলের অবকাঠামো নির্মাণ করে একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরির, একইসাথে খেলাটিকে অর্থবহভাবে এগিয়ে নেওয়ার জন্য।" তবে তিনি একইসাথে সতর্ক করে দেন, "তবে প্রতিবেদনটি পড়ার সময় দয়া করে আমার অকপটে ভাষায় চটে যাবেন না।"
তৃণমূল পর্যায় থেকে একজন বিশ্বমানের খেলোয়াড় তুলে আনার বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে একেবারে খোলামেলা ভাষায় সমালোচনা করেন দুজনে। তারপর বেশ কিছু জায়গায় সংশোধন করার পর প্রতিবেদনের সম্পাদিত কপি জমা দেন গ্যাসপার। গুলাতি জানান, "আমরা একে রেসিপি বুক হিসেব মনে করিনি, তবে কুইরোজ যা বলেছিলেন, যেভাবে সমস্যা এবং তার সমাধান বের করেছিলেন আমরা সেখান থেকে নানা কিছু করার উদ্যোগ নিয়েছি।"
যুক্তরাষ্ট্রের অবাস্তব আশাবাদ
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা স্বপ্ন দেখা করে ১২ বছরের মাথায় তারা ঘরে বিশ্বকাপ নিয়ে আসতে পারবে। প্রতিবেদনটির প্রস্তাব থেকে ১১ ধাপে ধীরে ধীরে উন্নতির পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
কুইরোজ বলেন, "আমাকে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি অবাক করেছিল তা হল, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দল কতটা 'ভালো' তা নিয়ে সবার মধ্যে বিভ্রম কাজ করে। এসব বিভ্রমগুলোর জন্যই বড় টুর্নামেন্টে বড় দলগুলোর সাথে টক্কর দিতে কতটুকু উন্নতি করতে হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছিল। পর্তুগালে একটি কথা আছে, সবগুলো ডিম এক পাত্রে রেখো না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল। তারা টাকা, সময়, শ্রমের সবকিছু বিনিয়োগ করেছিল কেবল জাতীয় দল প্রস্তুত করতে, কিন্তু খেলোয়াড়দের উন্নতির জন্য কোন পেশাদার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়নি!"
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় দলের প্রতি মনোযোগ কমিয়ে পিরামিডের নিচের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর অনুরোধ করেন কুইরোজ। "আমি যদি অসুস্থ হই, তাহলে আমি ওষুধ খেয়ে ব্যথা কমাতে পাড়ি, কিন্তু তার মানে এই না যে আমি সেরে উঠেছি। বিশ্বকাপে ভালো পারফর্ম করলেই আমার দেশের ফুটবল সংস্কৃতি একধাপে কয়েক লাফ ওপরে উঠে গিয়েছে এমন নয়।"
তিনি এবং গ্যাসপার এরপর 'সাফল্যের ব্লুপ্রিন্ট' আঁকেন। কিশোরদের জন্য তিনি প্রতিযোগিতামূলক লীগ ব্যবস্থা, আন্তঃস্টেট প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় পর্যায়ের অনূর্ধ্ব-১৯ লীগের প্রস্তাব করেন। একইসাথে স্কাউটিং, কাঠামো বিনির্মাণ, কোচদের প্রশিক্ষণসহ আরও নানা বিষয়ে পরামর্শ দেন তারা, যেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবল এবং পরবর্তীতে এমএলএস ঠিক করতে উদ্যোগ নেয়।
কুইরোজ উপসংহারে লেখেন, "আমি আশা করি যে ঈশ্বর আমার আইডিয়াগুলো আপনারা ঠিকঠাকভাবে বুঝবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফুটবলের উন্নতির জন্য কাজে লাগাতে পারবেন। আমি ফুটবলের সবকিছুতে আপনাদের সাফল্য কামনা করছি এবং আমি আজীবন আপনাদের বন্ধু হিসেবে থাকবো।"
বন্ধু থেকে শত্রু
কথাগুলো লেখার প্রায় ২৫ বছর পর, এর মাঝখানে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাব, এবং পর্তুগাল, দক্ষিণ আফ্রিকা, কলম্বিয়া এবং মিশরের জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করার পর, কুইরোজ আবারো যুক্তরাষ্ট্রের মুখোমুখি হচ্ছেন।
২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে ইরানকে নিয়ে ভরাডুবির পর ২০২২ সালে কিছুটা স্থিতিশীল দল নিয়ে আবারো বিশ্বকাপের মঞ্চে হাজির কুইরোজ। গ্রুপ পর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে ওয়েলসকে নাটকীয়ভাবে হারিয়ে গ্রুপের দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে ইরান। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ড্র করতে পারলেই দ্বিতীয় রাউন্ড নিশ্চিত হবে ইরানের, অন্যদিকে পরের রাউন্ডে যেতে হলে জয় আনতেই হবে মার্কিনদেরকে।
সোমবারের প্রেস কনফারেন্সে কুইরোজ জানান, "আগামীকাল আমাদের জন্য খুবই বিশেষ একটি ম্যাচ অপেক্ষা করছে। তবে আমার জন্য এটি আরও বিশেষভাবে স্পেশাল।" তিনি গ্রুপ বি-এর এখন পর্যন্ত সেরা দল হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, "তারা সকার থেকে ফুটবলে রূপান্তরিত হয়েছে, আরও ভালোভাবে 'আধুনিক ফুটবল'-এ। আমি যখন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলাম তার চেয়ে অনেক পরিবর্তিত এই ফুটবল দল। তাই আমরা আমাদের সম্পূর্ণ সম্মান নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে মাঠে নামবো। তবে দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট আশা নিয়েই।"