ব্রাজিলের হলুদ জার্সির পেছনের বেদনাদায়ক ইতিহাস
হলুদ রঙা জার্সিতে সবুজ কলার, বাঁদিকে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশনের ব্যাজ, তার ওপরে সবুজ রঙের ছোট ছোট পাঁচটি তারা, সঙ্গে নীল শর্টস ও সাদা মৌজা; এমন সব উজ্জ্বল এবং স্বতন্ত্র রং দেখে ব্রাজিল দলকে চিনতে কারো ভুল হওয়ার কথা নয়।
ব্রাজিলের খেলা মানেই হলুদ ঝড়ের অপেক্ষা। গত শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে পেলে, জোরজিনহো, জিকো, রোনাল্ডো, রোনালদিনহো এবং সক্রেটিসের মতো খেলোয়াড়েরা ফুটবলকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। কাকা থেকে নেইমার, একে একে সবাই বছরের পর বছর ধরে মুগ্ধ করছেন ফুটবলপ্রেমীদের, ব্রাজিলকে বানিয়েছেন কোটি মানুষের প্রিয়দল। মুগ্ধতা এবং জাদু, এ দুটি শব্দ যেন সমার্থক হয়ে গেছে দলটির সাথে।
তাদের চিরচেনা হলুদ জার্সি দেখলেই হৃদয় স্পন্দিত হয় ভক্তদের, মনের চোখে ভেসে ওঠে ফুটবল বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড়দের কথা, তাদের চমৎকার কৌশলী খেলার কথা। তাদেরই বদৌলতে হলুদ রঙের সাথে মিশে গেছে কোটি ভক্তের আবেগ।
তাইতো কেবল কাতার নয়, ব্রাজিলের ম্যাচের দিন অনেক দেশ ছেয়ে যায় হলুদের ঢেউয়ে। এই রং যেন এখন 'আনন্দের আন্তর্জাতিক প্রতীক।'
ব্রাজিল আর ফুটবলের মধ্যকার যে সম্পর্ক রয়েছে, তা বোধহয় আর কোনো দেশে নেই। অন্যান্য দেশ হয়তো ফুটবল খেলে ভালো লাগা থেকে কিংবা এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা করে, কিন্তু ব্রাজিলিয়ানদের কাছে ফুটবল ধর্মের মতো! বিশ্বকাপ বাদে অন্য সময়েও দেশটির রাস্তা কিংবা অলিগলিতে হাঁটলে সর্বদা দেখা মিলবে ব্রাজিলের জার্সি পরিহিত লোকজন।
হলুদ রঙা জার্সিটি তাদের কাছে পরম পবিত্র বস্তু। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিলের অধিনায়ক কার্লোস আলবার্তো বলেন, 'হলুদ জার্সি গায়ে দিলে আমরা অবশ্যই গর্ববোধ করি, তবে এর সঙ্গে একটা দায়িত্ববোধ এসে যায়, যে দায়িত্ববোধ অনুপ্রাণিত করে, উন্মাদ করে।'
হলুদ জার্সি পরলে ব্রাজিলিয়ানরা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে- এমনটা মনে করেন বর্তমান দলটির গোলরক্ষক অ্যালিসন বেকার।
তবে অবাক হওয়ার মতো বিষয়, ব্রাজিলের জার্সি সবসময় এমন ছিল না। আগে তারা খেলত সাদা জার্সি গায়ে দিয়ে। কেন জার্সির বদল হলো? এর পেছনে আছে এক শোকাবহ ইতিহাস।
মারাকানা ট্র্যাজেডি
১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মতো ফুটবল বিশ্বকাপ ঘরে তোলে ব্রাজিল। জার্সি বদলের গল্প জানতে হলে যেতে হবে আরও আট বছর আগে, ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপে।
সেবছর আয়োজক দেশ ছিল স্বয়ং ব্রাজিল। স্বাগতিক দেশটি ফাইনালে মুখোমুখি হয় উরুগুয়ের; কানায় কানায় পরিপূর্ণ মারাকানা স্টেডিয়াম। অসীম আশা নিয়ে প্রায় দুই লাখ ব্রাজিল দর্শক উদগ্রীব হয়ে ছিলেন বিশ্বকাপ জয়ের ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে।
খেলার ৪৭ মিনিটে ব্রাজিল একটি গোল করলেও ৬৬ মিনিটে সমতা ফেরায় উরুগুয়ে। সেই ম্যাচে জয় নয়, ন্যূনতম ড্র হলেই ব্রাজিল প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হতে পারত। কিন্তু খেলার প্রায় শেষ পর্যায়ে, ৭৯ মিনিটে এসে উরুগুয়ের স্ট্রাইকার ঘিঘিয়ার গোলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায় ব্রাজিলিয়ানদের জুলে রিমে জেতার স্বপ্ন; যে হারের প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী।
কান্নায় ভেঙে পড়েন গ্যালারিতে থাকা দর্শক, দেশবাসীরা যেন ডুবে যান শোকের সাগরে। হারের যন্ত্রণার সাথে যোগ হয়েছিল মৃত্যুর মিছিল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে মারাকানার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন এক ব্রাজিলিয়ান ভক্ত, হার্ট অ্যাটাকে মারা যান আরও তিন জন। ভিলেন বনে যান ব্রাজিলের জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা; তাদের অনেকে পরবর্তী দুই বছর কোনো খেলায় অংশ নেননি।
সবচেয়ে বেশি দোষারোপ করা হয়েছিল গোলরক্ষক বারবোসাকে। ২০০০ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ অপমান এবং ঘৃণা বয়ে বেড়াতে হয়েছিল তাকে। মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, 'ব্রাজিলে সর্বোচ্চ সাজার মেয়াদ ৩০ বছরের জেল, কিন্তু আমাকে সাজা ভোগ করতে হচ্ছে ৫০ বছর ধরে। অথচ সে ভুলের জন্য আমি দায়িই নই।'
হাজার সমালোচনা-ঘৃণা-অপমানের পর একসময় দেশবাসীর রাগ গিয়ে পড়ে জার্সির ওপর। তাদের হয়তো মনে হয়েছিল, যত নষ্টের গোড়া ওই জার্সি। সাদা রঙা শার্টে নীল কলার, সাদা শর্টস এবং সাদা মৌজাকে তাদের মন হতে লাগল 'দেশপ্রেমহীন', যা দেশটির পতাকাকে প্রতিফলিত করে না।
পতাকাটির সবুজ রং নির্দেশ করে দেশটির বিস্তীর্ণ বন, দেশটির সম্পদকে ফুটিয়ে তোলে হলুদ এবং নীল গোলক। আর সাদা তারকা প্রতিনিধিত্ব করে ১৮৮৯ সালের ১৫ নভেম্বরে রিও ডি জেনেরিও থেকে দেখা আকাশকে, যেদিন দেশটি সাম্রাজ্য থেকে রূপান্তরিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রে। এমন অর্থবহ পতাকাকে ফুটিয়ে না তোলায় হারের ক্ষোভ অনেকে প্রকাশ করেছিলেন জার্সির ওপর।
এরপর শুরু হয় নতুন পথচলা। ব্রাজিলের ফুটবল ফেডারেশন নতুন জার্সির নকশা করার জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। কোহেইও দ্যা মাইন্যা পত্রিকায় প্রকাশিত হয় জার্সি আঁকার প্রতিযোগিতার বিজ্ঞাপন। শর্ত ছিল, হলুদ, সবুজ, নীল ও সাদা; অর্থাৎ পতাকার সব রং থাকতে হবে নতুন নকশায়। জয়ী নকশার জার্সি পরিধান করা হবে ১৯৫৪ সালে আসন্ন সুইজারল্যান্ডের বিশ্বকাপে।
তখন পত্রপত্রিকায় আঁকাআঁকি করতেন ১৮ বছর বয়সী আলদির গার্সিয়া শ্লী। উরুগুয়ে সীমান্তের কাছাকাছি ছোট শহর রিও গ্রান্ডে ডো সুল-এ নিজ বাড়িতে বসে চারটি রঙের ১০০টি ভিন্ন সমাহার প্রস্তুত করেন তিনি। কিন্তু দিনশেষে উপলব্ধি করেন, জার্সিটা হতে হবে পুরোটাই হলুদ, কলার হবে সবুজ, সাথে পরা হবে সাদা মৌজা।
রঙের এমন 'ঐকতান' এবং নকশার সরলতার জন্য মোট ৪০১টি প্রতিদ্বন্দ্বী নমুনার মধ্যে গার্সিয়ার এই নকশা বিচারকদের নজর কাড়তে সমর্থ হয়। এই নতুন জার্সি পরেই ১৯৫৪ সালে মার্চে বিশ্বকাপে খেলতে নামে ব্রাজিল দল। প্রথম ম্যাচেই চিলিকে হারায় ১-০ গোলে। এর পরের বিশ্বকাপে অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে ফাইনালে সুইডেনকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ ট্রফি হাতে পায় ব্রাজিল। তবে এ ফাইনাল ম্যাচে হলুদ নয়, অন্য নীল জার্সিটিই পরেছিল সেলেসাওরা।
হলুদ জার্সি পরে ব্রাজিল প্রথমবার জুলে রিমে হাতে তোলে ১৯৬২ সালে। তবে সেসময়ের গণমাধ্যম সাদাকালো ছিল বলে জার্সির রং দেখার সৌভাগ্য হয়নি বিশ্ববাসীর। কিন্তু দু-দু'বার বিশ্বকাপ জিতেও যেন ক্ষান্ত হয়নি ব্রাজিল। আবার ১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে তারা তৃতীয়বারের মতো জিতে নেয় ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি। আর রঙিন টেলিভিশন পর্দায় সম্প্রচারিত হয়েছিল বলে ফুটবল প্রেমীদেরও প্রথমবারের মতো সৌভাগ্য মেলে বিখ্যাত হলুদ জার্সি দেখার।
ব্রাজিলকে সেদিন এক নতুনভাবে দেখেছিল বিশ্ববাসী। উজ্জ্বল সূর্যকিরণের মতো হলুদ রং যেন হয়ে ওঠে কোটি ব্রাজিলিয়ান ভক্তদের মুখে হাসি ফোটানোর কারণ।
সেসময়ের কথা স্মরণে কার্লোস বলেন, 'আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড় হলেন পেলে। ওই দলটিই ছিল সবার সেরা। আমাদের আজকের দলের সঙ্গেও তাদের তুলনা চলে না।'
তার মতে, পেলেদের কাছাকাছি ছিল ১৯৮২ সালের জিকো এবং সক্রেটিসদের দল। কিন্তু তারা সেই টুর্নামেন্টে জয়ী হতে পারেননি।
গার্সিয়া এখন কোথায়?
২০১৮ সালে ৮৩ বছর বয়সে ত্বক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ব্রাজিলের আইকনিক জার্সির নকশাকার আলদির গার্সিয়া শ্লী। ৩০ বছর ধরে ব্রাজিলের পেলোতাস শহরের ফেডেরাল ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেছিলেন তিনি।
ব্রাজিলবাসী এবং কোটি ভক্তকে যে অসামান্য উপহার দিয়েছেন, সেজন্যে তাদের মনে বেঁচে থাকবেন গার্সিয়া। জার্সি পরিবর্তন করার আগে একটিবারও জেতেনি ব্রাজিল, আর এরপর? তারা এখন পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন! এদিকে কাতার বিশ্বকাপে কোনো হার ছাড়াই পৌঁছে গেছে নক আউট পর্বে। তাহলে কি এবার মিশন হেক্সা সফল হতে চলেছে নেইমার-কাসিমেরোদের?
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: নীতি চাকমা