বিশ্বকাপের বিখ্যাত পাঁচ পেনাল্টি শ্যুটআউট
গত বিশ্বকাপের নক আউট পর্বে বেশ কয়েকটি ম্যাচ পেনাল্টি শ্যুটআউটে পর্যন্ত গড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গিয়েছে কাতার বিশ্বকাপের নক আউট পর্বের ৪টি ম্যাচ। এই বিশ্বকাপেও সেটি দেখা যাওয়ার জোর সম্ভাবনা রয়েছে।
পেনাল্টি শ্যুটআউটের টানটান উত্তেজনা, জয়ের উল্লাস আর অল্পের জন্য হেরে যাওয়ার কষ্টের শুরুটা হয়েছিল ১৯৭১ সালে। তবে বিশ্বকাপে প্রথম পেনাল্টি শ্যুটআউট হয়েছিল ১৯৮২ সালে, যখন সেমিফাইনালে পশ্চিম জার্মানি ফ্রান্সকে হারায় ৫-৪ গোলে। এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপে মোট ৩০টি পেনাল্টি শ্যুটআউটের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে দুটি হয়েছে ফাইনালে (১৯৯৪ এবং ২০০৬)।
বিশ্বকাপের সেরা ৫টি পেনাল্টি শ্যুটআউট নির্বাচন করেছে আল জাজিরা। সেগুলো হলো:
ব্রাজিল ৩-৪ ফ্রান্স
১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপ
ব্রাজিলের কিংবদন্তি খেলোয়াড় পেলে ১৯৮৬ মেক্সিকো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালের এই ম্যাচকে অ্যাখ্যা দিয়েছেন 'শতাব্দীসেরা ম্যাচ' হিসেবে।
গুয়াদালাজারানের তপ্ত রোদে দুই দলের গতি আর দক্ষতায় কিছুটা ঢিল পড়তে শুরু করেছে। সক্রেটিসের নেতৃত্বে ছন্দময় গতিময় ব্রাজিল মুখোমুখি হয়েছে ইউরোপসেরা ফ্রান্সের বিপক্ষে, যাদের হাতে রয়েছে অন্যতম সেরা ৪ মিডফিল্ডার মিশেল প্লাতিনি, অ্যালেইন জিরেস, জাঁ টিয়ানা এবং লুইস ফার্নান্দেজ।
ব্রাজিলের দুর্দান্ত সাম্বা ফুটবলের সহায়তায় কারেসার গোলে এগিয়ে যায় ব্রাজিল। তারপর নিজের ৩১তম জন্মদিনে মিশেল প্লাতিনি গোল করে সমতায় ফেরান। দুই দল চেষ্টা করতে থাকলেও বল আর জালে জড়াতে পারেনি, অতিরিক্ত সময়ও শেষ হয় ১-১ গোলে।
পেনাল্টি শ্যুটআউটের প্রথমেই সক্রেটিস পেনাল্টি মিস করে বসেন, প্লাতিনিও নিজের নার্ভ ধরে রাখতে না পেরে বল পাঠিয়ে দেন আকাশে। ব্রাজিলের সেন্টার ব্যাক হুলিও সিজারও তাদের ৫ নম্বরটি মিস করে বসেন, তবে ফার্নান্দেজ বলে জালে জড়াতে ভুল করেননি।
ফ্রান্স অবশ্য সেমিফাইনালেই পশ্চিম জার্মানির কাছে ২-০ গোলে হেরে বিদায় নেয়।
দক্ষিণ কোরিয়া ৫-৩ স্পেন
২০০২ জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া বিশ্বকাপ
দক্ষিণ কোরিয়ার ২০০২ বিশ্বকাপ অভিযান ছিল বিতর্কে পরিপূর্ণ। ফুটবলের পাওয়ারহাউজ না হলেও যুগ্ম-স্বাগতিক দল হয়ে পর্তুগাল আর ইতালিকে হারিয়ে দিলে অনেকের চোখ ঘুরে যায় তাদের দিকে। পর্তুগালের বিরুদ্ধে খেলা ম্যাচে দুই পর্তুগিজ খেলোয়াড় লালকার্ড দেখে, অন্যদিকে ইতালির ম্যাচে প্রচুর রেফারিঙয়ের ভুল চোখে পড়ে, যাকে পরবর্তীতে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে ইকুয়েডর ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন বহিষ্কার করে। কোয়ার্টার ফাইনালে এরপর স্পেনের মুখোমুখি হয় দক্ষিণ কোরিয়া।
স্পেনের দুটো গোল বাতিল করা হয়, যার মধ্যে দ্বিতীয়টি নিশ্চিতভাবেই গোল ছিল। বেশ কিছু কঠিন অফসাইড কলও স্পেনের বিরুদ্ধে যায়। ম্যাচের অতিরিক্ত সময় শেষ হয় গোলশূণ্য অবস্থায়, গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। টানা চারবার বল জালে জড়ায় কোরিয়া, অন্যদিকে স্পেনের ২০ বছর বয়সী উইঙ্গার জোয়াকিনের শট ঠেকিয়ে দেয় কোরীয় গোলকিপার, যদিও তিনি গোল লাইন ছেড়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে আসেন। হন মিয়ুং-বো দলের শেষ শট জালে জড়িয়ে কোরিয়াকে সেমিফাইনালে নিয়ে যান। অবশ্য সেমিফাইনালে জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরে যায় তারা।
ব্রাজিল ৩-২ ইতালি
১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপ
৯৪ হাজারেরও বেশি দর্শক পাসাডেনার রোস বোল স্টেডিয়ামে জড়ো হয়েছিল ব্রাজিল আর ইতালির ফাইনাল ম্যাচ দেখার জন্য, মার্কিনরা 'সকার'-এ আগ্রহী নয় এমন ধারণা গুড়িয়ে দিয়ে। ১৯৭০ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালিকে হারিয়েছিল ব্রাজিল, ম্যাচ দেখে মনে হয়েছিল ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে যাচ্ছে। তবে আক্রমণ একের পর এক হতে থাকলেও শেষ শটটা নিতে পারছিলো না ব্রাজিল। দ্বিতীয়ার্ধ পেরিয়ে অতিরিক্ত সময় শেষ হয়ে গেলেও কেউ গোল দিতে না পারায় ম্যাচ গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে।
প্রথমেই ফ্রাঙ্কো বারেসি বল আকাশে পাঠিয়ে দেন, ব্রাজিলের প্রথম শ্যুট নেওয়া মার্সিও সান্তোসের শটও ঠেকিয়ে দেন জিয়ানলুকা পাগলিউকা। এরপর একেএকে আলবার্তিনি, রোমারিও, এভানি, ব্রাঙ্কো সবাই বল জালে জড়ান। এরপর ১৯৮২-এর বিশ্বকাপজয়ী দলের সদস্য ডানিয়েলে মাসোরোর চতুর্থ শট ঠেকিয়ে দেন তাফারেল, তবে ব্রাজিলের অধিনায়ক ডুঙ্গা ঠিকঠাকমতোই তার কাজ শেষ করেন। বাকি ছিল কেবল রবার্তো বাজ্জিও, তিনিও বল আকাশে পাঠিয়ে দিলে ব্রাজিল চতুর্থবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায়।
পশ্চিম জার্মানি ৪-৩ ইংল্যান্ড
১৯৯০ ইতালি বিশ্বকাপ
১৯৬৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারানোর পর তার সাথে যুক্ত হওয়া ভূরাজনীতি এই দুই বিশ্বকাপজয়ী দেশের মধ্যে স্থায়ী প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করে। তাই ১৯৯০ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পেনাল্টি শ্যুটআউটে হার তাদের কাছে ছিল 'কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটা'র মতোই।
সেমিফাইনালে দ্বিতীয়বার হলুদ কার্ড দেখার পর পল গ্যাসকোয়েন ফাইনাল খেলতে পারবেন না নিশ্চিত হয়ে যায়। তাই তিনি পেনাল্টি শ্যুটআউট থেকে নিজেকে বিরত রাখেন, তার বদলে পেনাল্টি নিতে যান ক্রিস ওয়াডল।
ইংল্যান্ডের গোলকিপার পিটার শিলটন দিক অনুমান করলেও প্রতিবার ঝাপ দিতে দেরি করায় জার্মানদের একটা বলও স্পর্শ করতে পারেননি। অন্যদিকে ইংল্যান্ডের চতুর্থ শটে স্টুয়ার্ট পিয়ার্সের শট লেগে যায় জার্মান গোলকিপার বোডো ইল্গনারের পায়ে। এদিকে ওয়াডল এর আগে কখনোই বড় প্রতিযোগিতায় পেনাল্টি নেননি। সেদিন সাহস করে শট নিতে গিয়ে বল গোলপোস্টে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। ইংল্যান্ড ছিটকে পড়ে কোয়ার্টার ফাইনালে, পশ্চিম জার্মানি ফাইনালে গিয়ে ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে জিতে নেয় তাদের তৃতীয় বিশ্বকাপ।
ইতালি ৫-৩ ফ্রান্স
২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ
ফাইনালের নির্ধারিত সময় অমীমাংসিতভাবে শেষ হওয়া শেষবার হয়েছে ২০০৬ সালে, যখন বার্লিনের অলিম্পিক স্টেডীয়ামের ৬৯ হাজার দর্শকের সামনে মুখোমুখি হয় দুই ফুটবল পরাশক্তি ফ্রান্স এবং ইতালি। ম্যাচের প্রথম বিশ মিনিটের মধ্যেই জিদান এবং মাতেরাজ্জি গোল করেন।
তবে ম্যাচের অতিরিক্ত সময় মাতেরাজ্জিকে ঢুস মেরে নিজের শেষ ম্যাচে লালকার্ড দেখে লকাররুমে ফিরে যান জিদান। ফ্রান্স তাদের মূল খেলোয়াড়কে ছাড়াই পেনাল্টি শ্যুটআউটে যেতে বাধ্য হয়। ফরাসি স্ট্রাইকার ট্রেজেগুয়েট পেনাল্টি মিস করলেও ইতালির পিরলো, মাতেরাজ্জি, ডি রসি, ডেল পিয়েরো, সবাই গোল করেন। শেষ শটে গ্রসো বল জালে জড়ালে ইতালি জিতে নেয় তাদের চতুর্থ বিশ্বকাপ।