মরক্কো: গর্জন শুনিয়ে অ্যাটলাস চূড়ার সিংহদের বিদায়
বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে হারের যন্ত্রণার চেয়েও নিজেদের অর্জন নিয়েই বেশি গর্বিত হবে মরক্কো। আফ্রিকার দলরাও যে ফুটবল খেলতে পারে আর বিশ্বমঞ্চে সেরাদের বিপক্ষে সমানে সমানে লড়তে জানে, সেটিই প্রমাণ করল মরক্কো। বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে জয়ের স্বপ্ন নিয়ে নামলেও কাজটা যে সহজ হবে না সেটি জানতেন মরক্কোর খেলোয়াড় এবং সমর্থকেরা। শেষ পর্যন্ত পেরেও উঠেনি অ্যাটলাসের সিংহরা।
শুধু প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনাল খেলাই নয়, আরও কয়েকটি প্রথমের সঙ্গে জুড়ে আছে মরক্কোর নাম। বিশ্বকাপে আফ্রিকান দেশগুলোর যা কিছু প্রথম, তার বেশিরভাগ জায়গাতেই পথপ্রদর্শক তারা।
বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে কোনো ম্যাচ থেকে পয়েন্ট অর্জন করা প্রথম আফ্রিকান দল মরক্কো। ১৯৭০ বিশ্বকাপে বুলগেরিয়ার বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করার মাধ্যমে এই কৃতিত্ব গড়ে তারা। বিশ্বকাপে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে নক-আউট পর্বে উঠা দলও মরক্কো। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে শেষ ষোলোয় পৌঁছায় অ্যাটলাসের সিংহরা। যেটি রাস্তা দেখিয়েছিল ক্যামেরুনের প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠার, ১৯৯০ বিশ্বকাপে।
আর এবার কাতার বিশ্বকাপে তো সব প্রত্যাশার সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের দল। সেমি-ফাইনালে আসার পথে 'এফ' গ্রুপের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মরক্কো। যেই গ্রুপে ছিল বেলজিয়াম, গত বিশ্বকাপের রানার্স-আপ এবং এবারের আরেক সেমি-ফাইনালিস্ট ক্রোয়েশিয়া। বেলজিয়ামকে ২-০ গোলে হারানো ম্যাচটি মরক্কোর ইতিহাসেরই অন্যতম বড় জয়।
শেষ ষোলোতে মরক্কো বিদায় করে টুর্নামেন্টের আরেক ফেভারিট স্পেনকে। দুর্দান্ত ফুটবল খেলতে থাকা স্প্যানিশরা মরক্কোর কাছে টাইব্রেকারে ধরাশায়ী হয়। তিনটি শট ঠেকিয়ে জয়ের নায়ক হন গোলরক্ষক ইয়াসিনে বুনু।
কোয়ার্টার-ফাইনালে পর্তুগালের বিপক্ষে মুখোমুখি হওয়ার আগেও খুব বেশি বাজি ছিলো না মরক্কোর পক্ষে। কিন্তু পাশার দান উলটে দিয়ে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপে জেতার স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দেন হাকিমি-এন নেসইয়েরিরা। সেই সাথে ইতিহাস গড়ে সেমি-ফাইনালে উঠে মরক্কো।
সেমি-ফাইনালের প্রতিপক্ষ বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের বিপক্ষে ধারে-ভারে যে সুযোগ ছিল না, সেটি জানতেন মরক্কোর সবাই। কিন্তু দলের মধ্যে যে একতা এবং আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠেছিল, সেটির উপর ভর করে ফ্রান্সকে হারানোর স্বপ্ন দেখেছিল গোটা মরক্কো। ফ্রান্সের শক্তির বিপক্ষে শেষ পর্যন্ত পেরে উঠেনি তারা।
মরক্কোর এতদূর আসাকে অঘটন বলা যাবে না কিছুতেই। তাদের এই সাফল্যের পেছনের গল্পটা তৈরি হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। মরক্কোর এই দলের ১৪ জন খেলোয়াড়ই জন্ম নিয়েছেন মরক্কোর বাইরে। হাকিম জিয়েশ, আশরাফ হাকিমি, নুসায়ের মাজরাওই, ইয়াসিনে বুনু, এন নেসইয়েরিদের সবাই খেলেন ইউরোপের সব বড় বড় ক্লাবে। একটি দলে এত সব তারকা থাকতে তাদের এই পারফরম্যান্স মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না।
পুরো টুর্নামেন্টে মরক্কো গোল খেয়েছে মাত্র ৩ টি। যার দুটি সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে, অপরটি কানাডার বিপক্ষে আত্মঘাতী। মরক্কোর খেলা মুগ্ধ করেছে পুরো বিশ্বকেই। ওয়ালিদ রেগরাগুই নিজের দলকে খেলিয়েছেন প্রতি আক্রমণভিত্তিক ফুটবল। জমাট রক্ষণের সাথে বিদ্যুৎগতির প্রতি আক্রমণে মরক্কো ঘায়েল করেছে বড় বড় প্রতিপক্ষকে।
মরক্কোর এই দলের বেশ কয়েকজন এখনও বেশ তরুণ, তাই ২০২৬ বিশ্বকাপে নিজেদের অপূর্ণ আশা পূর্ণ করার উদ্দেশ্যেই দল গোছাবেন রেগরাগুই। আর তাদের পেছনে থাকবে পুরো আফ্রিকা, মরক্কোর জয় মানে যে আফ্রিকারও জয়।