'কান্না নয়, আমরা শুধুই গর্বিত', স্বপ্নভঙ্গের পরেও উন্নত শির মরক্কানরা
অনেকটা অঘটনের জন্ম দিয়ে কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গিয়েছিল মরক্কো। প্রথমে স্পেন, তারপর পর্তুগাল, অবশেষে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের মুখোমুখি হতে হয়েছে অ্যাটলাস লায়নদের। প্রথম দুটি বাধা বেশ ভালোভাবে পার হলেও ফরাসিদের কাছে টিকতে পারেনি আশরাফ হাকিমি-জিয়েশদের দল। কিন্তু তাই বলে মরক্কোর বিপক্ষে খুব হেসেখেলে জয় পায়নি ফ্রান্স। পুরো ম্যাচেই মরক্কানদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হলো, সারা বিশ্বের মরক্কানদের কাছে এই পরাজয় কোনো পরাজয়ই নয়! বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠতে না পারলেও, তাদের চোখের পানিতে আজ দুঃখের চেয়ে আনন্দ ও গৌরবই মিশে আছে বেশি! কারণ মরক্কো যে ইতিহাস গড়েছে, টুর্নামেন্টের শুরুতে দল এবং দেশের মানুষের কাছেই তা ছিল অকল্পনীয়!
আফ্রিকা ও আরব অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে কাতার বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে উঠে ইতিহাস গরেছে মরক্কো। কিন্তু বৃহস্পতিবার ফ্রান্সের বিপক্ষে শেষ হাসি হাসতে পারেনি আফ্রিকান সিংহরা। থিও হার্নান্দেজ ও মুয়ানির গোলে ২-০ ব্যবধানে হেরেছে মরক্কো। তবে আগামী শনিবার বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে মোকাবিলা করবে কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুইয়ের দল।
ম্যাচ শেষে ওয়ালিদ রেগ্রাগুই বলেন, "আমরা আমাদের সেরাটা দিয়েছি। আমরা ফ্রান্সের মতো দলের জন্য ম্যাচজুড়ে বাধা সৃষ্টি করেছি, সেটিই আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। আমার খেলোয়াড়রা মরক্কো দলের একটি অসাধারণ ইমেজ তৈরি করেছে, বিশ্ববাসীর সামনে নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শন করেছে। তারা যে নতুন করে ইতিহাস রচনা করতে চেয়েছিল তা অনেকের পক্ষেই মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল।"
গেল আগস্টে মাত্র মরক্কোর দায়িত্ব নেওয়া এই মরক্কান কোচ আরও বলেন, "কোনো অলৌকিক উপায়ে তো বিশ্বকাপ জেতা যায় না, তার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়- আর আমরা সেটাই করে যাচ্ছি।"
মরক্কান সমর্থকদের অতুলনীয় ভালোবাসা
বৃহস্পতিবার কাতারের সুক ওয়াকিফে হাজার হাজার মরক্কানের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গত কয়েকদিনে কাতারে এক টুকরো মরক্কো বানিয়ে ফেলেছেন এই দলটির সমর্থকরা; তাদের ভিড়ে ফ্রান্সের জার্সি খুঁজে পাওয়াই ছিল কঠিন!
মরক্কো সরকারের পক্ষ থেকে বাড়তি ফ্লাইট চালু করায় এবং বিনামূল্যে ৫০০০ টিকিট বিতরণ করার সুযোগে অনেকেই কাতারে উড়ে এসেছেন খেলা দেখতে। অসংখ্য গণমাধ্যম, টিভি-রেডিও স্টেশন তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। ম্যাচ হারের পরেও অশ্রুসিক্ত নয়নে মরক্কোকে নিয়ে গর্বিত থাকার কথা জানিয়েছেন তারা।
বৃহস্পতিবার কাতারের আল-বাইত স্টেডিয়ামকে প্রথম দেখায় মরক্কান বন্দর নগরী ক্যাসাব্লাংকা বলে ভুল করার সম্ভাবনা ছিল! গোলবারের পেছনে স্বল্প সংখ্যক ফরাসিদের উপস্থিতি মরক্কান জনসমুদ্রের মধ্যে খুবই নগণ্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছিলো।
মরক্কোর লাল জার্সি ও পতাকা নিয়ে হাজারো মরক্কান যখন সমস্বরে উল্লাস করছিলেন স্টেডিয়ামে, তাদের সেই উত্তেজনা ও দলের প্রতি ভালোবাসার সাথে আর কোনোকিছুরই তুলনা হয় না! কিন্তু কিক অফের মিনিট পাঁচেক পরেই যখন ফরাসি লেফট ব্যাক থিও হার্নান্দেজ গোল করলেন, স্টেডিয়ামে তখন পিনপতন নীরবতা! গ্যালারিভর্তি সমর্থকরা তখন স্তব্ধ।
কিন্তু এরপরেই আবার সবাই মিলে উৎসাহ দিচ্ছিলেন খেলোয়াড়দের, 'দিমা মাগরেব' (আজীবনের জন্য মরক্কো) স্লোগানে মুখরিত করে তুলেছি্লেন পুরো এলাকা। কিন্তু ম্যাচের ৭৯ মিনিটে ফরাসি ফরোয়ার্ড কলো মুয়ানি দ্বিতীয় গোলটি করে মরক্কানদের আশার আলো নিভিয়ে দেন।
তবে সেমিফাইনালে হেরে গেলেও বিশ্বকাপে মরক্কোর দুঃসাহসিক যাত্রা যে ফুটবলবোদ্ধাদের নজর কেড়েছে তা স্পষ্ট। সাবেক ইংলিশ ডিফেন্ডার মিকাহ রিচার্ডস বিবিসি ওয়ানকে বলেন, "আমার এই ম্যাচটা খুবই ভালো লেগেছে, এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে আমার দেখা সেরা ম্যাচ। এত এত মরক্কান সমর্থকদের উল্লাস এবং যে আবহ তারা তৈরি করেছে সেটা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।"
ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক অ্যালান শিয়ারার যোগ করেন, "মরক্কো এ বিশ্বকাপে যা অর্জন করেছে, যে নৈপুণ্য ও প্রচেষ্টা দেখিয়েছে, তাতে তাদের অত্যন্ত গর্বিত হওয়া উচিত। তাদের ভক্তরাও ছিল অসাধারণ এবং তারাও পুরো সময়টা উপভোগ করেছে। কিন্তু দলের মধ্যে কিছু ঘাটতি থাকায় শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি মরক্কো।"
'আমরা জানি আমরা বিশাল একটা অর্জন করেছি'
বিশ্বকাপের তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচ হলো এমন একটি ম্যাচ যেখানে সত্যিকার অর্থে কেউই অংশগ্রহণ করতে চায় না। কিন্তু মরক্কোর ক্ষেত্রে তা একেবারেই আলাদা।
বেলজিয়াম, স্পেন, পর্তুগালের মতো ইউরোপের হেভিওয়েট দলগুলোকে পরাজিত করে আসার পর শনিবারের ম্যাচটির দিকেই তাদের চোখ। কাতারের খলিফা আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে ক্রোয়েশিয়াকে হারাতে পারলে মরক্কো পেয়ে যাবে বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী দল যা তাদের প্রচেষ্টার একটি উপহার হয়ে থাকবে।
সাউদাম্পটনের প্রাক্তন উইঙ্গার সুফিয়ান বুফল এবং সেভিয়ার স্ট্রাইকার ইউসেফ আন-নাসেরি ম্যাচের আগে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে মাঠে নেমেছিলেন, কিন্তু তবুও শেষ রক্ষা হয়নি। কিন্তু ম্যাচ জিততে না পারলেও, মরক্কোতে ও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রতিটি মরক্কানের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন এই খেলোয়াড়রা।
এর আগের ম্যাচে পর্তুগালকে হারানোর পর মরক্কানদের উদযাপনের চিত্র ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। মায়ের হাত ধরে মরক্কান খেলোয়াড়ের নাচার ভিডিও দেখে আবেগাপ্লুত হয়েছেন অনেকে।
বৃহস্পতিবার ম্যাচ শেষে আশরাফ হাকিমি ও ফ্রান্স ফরোয়ার্ড কিলিয়ান এমবাপ্পে আলিঙ্গন করেন এবং একে অপরের জার্সি বদল করেন। অন্যদিকে, মরক্কান অধিনায়ক রোমান সাইস ইনজুরির কারণে আগেই ম্যাচ থেকে ছিটকে গেলেও, শেষ মুহূর্তে মাঠে ফিরে এসেছিলেন তার ছেলের হাত ধরে, দেখছিলেন চারপাশে তাকিয়ে কী করা যায়।
তবে একথা স্বীকার করতেই হবে যে ইনজুরির বিষয়টি মরক্কানদের ভালোমতোই ভুগিয়েছে। ইনজুরির কারণে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচে তারা ওয়েস্ট হ্যা, ডিফেন্ডার নায়েফ আগুয়ার্ডকে পায়নি। বায়ার্ন মিউনিখে খেলা ফুল-ব্যাক নুসাইর মাজরাউইকেও হাফ টাইমে তুলে নেওয়া হয়।
ম্যাচ শেষে মাঠেই মাথানত করে সিজদা দিয়েছেন মরক্কোর খেলোয়াড়রা। আর সামনে গ্যালারি থেকে দর্শকরা অভিবাদন জানিয়েছেন ইতিহাস সৃষ্টি করা এই দলটিকে।
জনৈক মরক্কান সমর্থক মোহাম্মদ বিবিসি স্পোর্টকে বলেন, "শনিবারের ম্যাচটাকে সবাই পরাজিতদের খেলা বলে থাকে। কিন্তু আমাদের কাছে তৃতীয় স্থান অর্জন করাটাও অনেক কিছু, কারণ আমরা অপ্রত্যাশিত সাফল্য পেয়েছি এবার। আজ কোনো কান্না নয়, বরং আমাদের খেলোয়াড়রা দেশ ও সমর্থকদের জন্য যা করেছেন তাতে আমরা ভীষণ গর্বিত।"
মরক্কান কোচ ওয়ালিদ রেগ্রাগুইয়ের ভাষ্যে, "এটা আমাদের জন্য আরও এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার মতো। আমাদের খেলোয়াড়দের অনেকেই ৬০-৭০% ফিট ছিল, তাই আমরা পিছিয়ে গিয়েছি। কিন্তু আমার মনে হয় আমরা অনেক বড় কিছু অর্জন করেছি। আমরা গণমাধ্যমে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি দেখেছি, সবাই আমাদের নিয়ে গর্বিত। আমরা মরক্কানদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, যদিও আজ আমাদের হতাশ হতে হয়েছে।"
ওয়ালিদ আরও বলেন, "আমাদের মনে হয়েছে আমরা আরও দূর এগোতে পারতাম, কিন্তু কিছু ছোটখাটো ব্যাপার থাকেই, যার ফলে সবচেয়ে যোগ্য দলটিই জয়ী হয়। আমরা আফ্রিকান ফুটবল ও আমাদের দল সম্পর্কে ভালো ইমেজ তৈরি করতে পেরেছি। আমরা আমাদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছি। মানুষ সবসময়ই আমাদের সম্মান দিয়ে এসেছে, কিন্তু এখন হয়তো আরেকটি বেশি সম্মান দেওয়া হবে আমাদের।"
সূত্র: বিবিসি