বাংলাদেশকে কাঁদিয়ে সাফের ফাইনালে নেপাল
সাফ চ্যাম্পিয়ন আসে, সাফ চ্যাম্পিয়ন চলে যায়। কোনোবারই হাসি ফোটে না বাংলাদেশের মুখে। প্রতিবারই লেখা হয় হৃদয় ভাঙার গল্প, হারই হয়ে থাকে অমোঘ নিয়তি। আরও একবার লেখা হলো সেই একই গল্প। নিয়তিও মুচকি হেসে প্রতিপক্ষের মুখে ফোটালো হাসি। ৭৯ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে থেকেও জয় ছিনিয়ে নিতে পারল না জামাল ভূঁইয়ার দল। দারুণ ফুটবল খেলা নেপাল প্রথম বারের মতো উঠল সাফের ফাইনালে।
বুধবার মালদ্বীপের জাতীয় ফুটবল স্টেডিয়ামে অলিখিত সেমি-ফাইনালে নেপালের বিপক্ষে ১-১ গোলে ড্র করেছে বাংলাদেশ। দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট নিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত হয় নেপালের। বাংলাদেশকে আরও একবার বিদায় নিতে হলো গ্রুপ পর্ব থেকেই। বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেন ফরোয়ার্ড সুমন রেজা। ৮৮তম মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করে দলকে উল্লাসে মাতান অঞ্জন বিস্তা।
নেপালের অবিরত আক্রমণে বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু বাঁজপাখির মতো ঝাঁপিয়ে প্রতিবারই দলকে বিপদমুক্ত করেছেন গোলরক্ষক আনিসুর রহমান জিকো। যদিও এই জিকোকেই ৭৯তম মিনিটে লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়তে হয়। দলকে বিপদমুক্ত করতে ডি-বক্সের বাইরে যাওয়া জিকোর হাতে বল লাগলে রেফারি তাকে সরাসরি লাল কার্ড দেখান। বাকিটা সময় বাংলাদেশের গোলপোষ্টের দায়িত্বে ছিলেন আশরাফুল ইসলাম রানা। ঠিক দিকে ঝাঁপিয়েও অঞ্জনের নেওয়া পেনাল্টি শট ফেরাতে পারেননি তিনি।
১৬ বছর পর সাফের ফাইনালে ওঠার স্বপ্ন দেখছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ ২০০৫ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সাফের ফাইনালে খেলে দলটি। সে সময় নেপালের বিপক্ষেও দারুণ রেকর্ড ছিল বাংলাদেশের। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত সাফের প্রতিটি ম্যাচে নেপালকে হারায় বাংলাদেশ। কিন্তু এরপর নেপালকে আর হারাতে পারেনি তারা।
সাফের ১৩তম আসরের এই ম্যাচের আগে সর্বশেষ চার ম্যাচে নেপালের বিপক্ষে একটি ম্যাচ জেতে বাংলাদেশ। নেপালের জয়ও ছিল একটি, বাকি দুটি ম্যাচ ড্র হয়। এবার নেপাল বাধা পেরিয়ে যাওয়ার খুব কাছে পৌঁছে গিয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ সময়ে স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় পুড়তে হলো অস্কার ব্রুজোনের দলকে।
ম্যাচে বাংলাদেশের চেয়ে বল দখল ও আক্রমণ সাজানোয়ও অনেক এগিয়ে ছিল নেপাল। গোছালো আক্রমণে বারবার বাংলাদেশের রক্ষণভাগে হানা দিয়ে গেছে তারা। ম্যাচে ৬৭ শতাংশ সময় বল পায়ে রাখেন রোহিত চাঁদ-আইয়ুশরা। গোলমুখে তাদের নেওয়া ১৮ টি শটের ৩টি লক্ষ্যে ছিল। ৩৩ শতাংশ সময় বল দখলে রাখা বাংলাদেশ ১০টি শট নেয়, এর মধ্যে ৪টি লক্ষ্যে ছিল।
ফাইনালে উঠতে হলে এই ম্যাচটি জিততেই হতো বাংলাদেশকে। আগের তিন ম্যাচে এক জয়, এক ড্র ও এক হারে চার পয়েন্ট জমিয়েছিল বাংলাদেশ। এই ম্যাচে জিতলে ৭ পয়েন্ট নিয়ে ফাইনালে উঠতো জামাল ভূঁইয়ার দল। কিন্তু হারে ৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা থামাতে হলো তাদের। অন্যদিকে নেপালের জন্য কাজটি আরেকটু সহজ ছিল, ড্রতেই চলতো তাদের। শেষ পর্যন্ত সেই ড্র নিয়েই ফাইনালের টিকেট কাটে তারা।
শুরুতে বাংলাদেশের রক্ষণভাগ ছিল চরম অগোছালো। দ্বিতীয় মিনিটেই তারিক কাজীর ভুলে বল পেয়ে যায় নেপাল। প্রতিপক্ষের আক্রমণ ফেরাতে ডি-বক্সের একটু বাইরে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন তপু বর্মণ। যদিও ফ্রি-কিক থেকে কোনো সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি তারা। তবে অবিরত আক্রমণ করে যাচ্ছিল নেপাল। বাংলাদেশ সেভাবে আক্রমণে যেতে পারছিল না। বলও দখলও নিতে পারছিল না, উল্টো মিস পাসে নেপালকে বল বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
যদিও আসল কাজটি বাংলাদেশই আগে করে। নবম মিনিটে এগিয়ে যায় তারা। ডান প্রান্তে ডি-বক্সের একটু দূরে ফ্রি-কিক পায় বাংলাদেশ। দারুণ একটা ফ্রি-কিক নেন অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া। নেপালের রক্ষণভাগের দেয়ালে লেগে বল একটু উঁচু হয়ে আসে। ডি-বক্সে কিছুটা ফাঁকায় থাকা সুমন রেজা দারুণ হেডে বল জালে জড়ান। মতিনের বদলে এদিন প্রিমিয়ার লিগের সর্বোচ্চ এই গোলদাতাকে মাঠে নামানো হয়।
১৩তম মিনিটে দারুণ একটি সুযোগ তৈরি করে নেপাল। কাট ব্যাক থেকে পাওয়া বল লক্ষ্যে রাখতে পারেননি ম্যাচ সেরা রোহিত চাঁদ। তার নেওয়া শট উপর দিয়ে চলে যায়। ২২ তম মিনিটে সহজ সুযোগ নষ্ট করে বাংলাদেশ। গোলদাতা সুমন বল নিয়ে ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন, বামেই দাঁড়ানো ছিলেন অরিক্ষিত ইব্রাহিম। তাকে দিলে ট্যাপ-ইনে বল জালে জড়াতে পারতেন ইব্রাহিম। কিন্তু সুমনই শট নেন, তার বাঁ পায়ের নেওয়া দুর্বল শট সহজেই ধরে ফেরেন নেপাল গোলরক্ষক কিরণ কুমার লিম্বু।
পরের মিনিটে বিস্তার ফ্রি কিক অনেকটা লাফিয়ে ফিস্ট করে দলকে বিপদমুক্ত করেন আনিসুর রহমান জিকো। দুই মিনিট পর বক্সের ডান দিক দিয়ে বাংলাদেশের অরক্ষিত ফরোয়ার্ড সাদউদ্দিন তাড়াহুড়ো শট নেন। বল বেরিয়ে যায় দূরের পোস্টের অনেক বাইরে দিয়ে। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে আয়ুশ খালানের হেড ক্রসবারের উপর দিয়ে চলে যায়।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে মাঝমাঠ দিয়ে আক্রমণে ওঠেন রাকিব। কিন্তু ডিফেন্ডাররা পথ আগলে দাঁড়ানোর পর দুই পাশে থাকা সতীর্থকে বল না বাড়িয়ে নিজেই শট নেন। তার শট উড়ে যায় অনেক উপর দিয়ে। সমতায় ফিরতে মরিয়া নেপালের দুটি আক্রমণ ফিরিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখেন জিকো। ৫০তম মিনিটে আয়ুশের ফ্রি কিক পাঞ্চ করে ফেরান তিনি। তিন মিনিট পর অনন্ত তামাংয়ের ব্যাক হেডও তাকে ফাঁকি দিতে পারেনি।
৫৫তম মিনিটে সুবর্ণ সুযোগ নষ্ট করেন সুমন রেজা। ডান দিক দিয়ে নেপালের ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন এই ফরোয়ার্ড। চিপ বা লব করলে গোল হতে পারত, কিন্তু গোলরক্ষক বরাবর শট নিয়ে হতাশ করেন তিনি। ৬৫তম মিনিটে আবারও রক্ষাকর্তা জিকো। নবযুগ শ্রেষ্ঠার হেড ফেরান তিনি।
৭৯তম মিনিটে আসে বিপদ। বিপলু আহমেদের ব্যাক পাস নবযুগ ধরার আগেই ছুটে এসে বিপদমুক্ত করেন জিকো। ধাক্কায় পড়ে যান নেপালের ফরোয়ার্ড এবং বল জিকোর হাতে লাগে। তাকে সরাসরি লাল কার্ড দেখান রেফারি। পোস্ট সামলানোর দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামেন আশরাফুল ইসলাম রানা।
নির্ধারিত সময়ের দুই মিনিট বাকি থাকতে স্বপ্নভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। বক্সে হেড করতে গিয়ে অনেকটা ফলো থ্রুয়ে পড়ে যান অঞ্জন। বেশ কয়েকবার রিপ্লে দেখানো হলেও সাদউদ্দিনের সঙ্গে তার তেমন কোনো সংঘর্ষ হতে দেখা যায়নি। কিন্তু পেনাল্টির বাঁশি বাজান রেফারি। স্পট কিক থেকে গোল করেন অঞ্জন।