‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক কিছুই বদলে গেছে’
দীর্ঘ ২৪ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার, পেশাদার ক্রিকেট শুরু আরও আগে। বাংলাদেশের ক্রিকেটেও শোয়েব মালিকের পদচারণার অনেকদিন হয়েছে। ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলে আসছেন পাকিস্তানের তারকা এই ক্রিকেটার। ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের বেশ কয়েকটি আসরে খেলা ৪০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার বিপিএলেও নিয়মিত খেলে আসছেন।
স্বভাবতই বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক পরিবর্তন দেখেছেন মালিক। রংপুর রাইডার্সের হয়ে এবারের বিপিএলে খেলা অভিজ্ঞ এই অলরাউন্ডার রোববার জানিয়েছেন তার সেই পর্যবেক্ষণের কথা। এ ছাড়াও ৪৯৮ টি-টোয়েন্টি খেলে সেঞ্চুরি করতে না পারার অপূর্ণতা, ৪০ বছর বয়সেও দারুণ ফিট থাকা, পাকিস্তান দলে খেলার ইচ্ছাসহ আরও অনেক বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন মালিক।
প্রশ্ন: রংপুর রাইডার্সে নাঈম শেখ, শামীম হোসেনের মতো তরুণ ক্রিকেটার আছে। অধিনায়ক নুরুল হাসান সোহান বেশ কিছু দিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেললেও সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। খুব কাছ থেকে দেখার পর তাদের নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? কিংবা কোনো পরামর্শ?
শোয়েব মালিক: আমার ভাবনা খুবই সাধারণ, কঠোর পরিশ্রম করে যাও। সবটুকু প্রতিভাই ওদের আছে। আমি নিশ্চিত, পরিশ্রম করে গেলে ওরা ধারাবাহিক পারফরম্যান্স দিতে শুরু করবে। ওদের খেলায় প্রতিভার ঝলক আমি দেখেছি। আশা করি, ওরা দলের জন্য ভালো করবে। এই দলের হয়ে মন, বাংলাদেশের হয়েও করবে।
প্রশ্ন: এসব তরুণ ক্রিকেটার আপনার সঙ্গে কথা বলে? প্রশ্ন থাকে তাদের?
মালিক: হ্যাঁ, তারা আমাকে অনেক প্রশ্ন করে। যেহেতু আমি দলের সবচেয়ে বেশি বয়সী ক্রিকেটার, অনেকেই আমার কাছে আসে এবং নানা কিছু জানতে চায়। আমারও ওদেরকে সহায়তা করতে পেরে ভালো লাগে। ব্যাপারটা দলের ভেতর নিজের অভিজ্ঞতা ভাগভাগি করে দেওয়া। এমনকি অন্য দল থেকে কেউও যদি আসে, আমি তার সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করি। যে কোনো ক্রিকেটারের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি সব সময়ই তৈরি।
প্রশ্ন: অনেক দিন ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেট দেখছেন, খেলছেন। এখানকার ক্রিকেটে কতোটা পরিবর্তন এসেছে?
মালিক: বাংলাদেশের ক্রিকেটে অনেক কিছুই বদলে গেছে। এখানকার ক্রিকেটের পরিচিত আছে এখন বিশ্বের সব জায়গায়। তারাও তো এখন বিশ্বের নানা জায়গার লিগগুলোতে সুযোগ পাচ্ছে। নিজেদের কন্ডিশনে বাংলাদেশের সাফল্যের হার তো দুর্দান্ত।
একটা জায়গায় তাদের এখনও উন্নতির জায়গা আছে, তা হলো দেশের বাইরের পারফরম্যান্সে। তবে এই দেশে প্রতিভার কথা যদি বলি, যথেষ্টই আছে। এখন প্রয়োজন হলো তাদেরকে পর্যাপ্ত সুযোগ দেওয়া, যেন তারা নিজেদের খেলায় উন্নতি করতে পারে এবং দেশের বাইরেও ভালো করতে পারে।
প্রশ্ন: আপনার বয়স চলছে ৪০, ফেব্রুয়ারিতে ৪১- এ পা দেবেন। এই বয়সেও খেলে যাওয়ার প্রেরণা কী?
মালিক: বিশ্বাস করুন, যদিও আমার বয়স দলে সবচেয়ে বেশি, তবে আমার ফিটনেস আপনি তুলনা করতে পারেন ২৫ বছর বয়সী কোনো ক্রিকেটারের সঙ্গে। আমাকে যা অনুপ্রাণিত করে তা হলো, আমি এখনও মাঠে আসা উপভোগ করি। আমি অনভুব করি, সেই ক্ষুধাটা এখনও আছে। এই দুটি ব্যাপার যতদিন আছে, ক্রিকেট খেলা চালিয়ে যাব।
এ কারণেই অবসরের কথা চিন্তাও করছি না আমি। যদি সম্ভব হয়, আমি অবসর নিতে চাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলে কিংবা পরিপূর্ণ ক্রিকেট খেলে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত সেই প্রক্রিয়াই (অবসরের) শুরু হয়নি এবং নিজের ক্রিকেট আমি উপভোগ করছি। যেখানেই সুযোগ মেলে, আমি যাই এবং খেলি।
প্রশ্ন: তাহলে কি পাকিস্তানের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলার ইচ্ছা এখনও আছে আপনার?
মালিক: টেস্ট ও ওয়ানডে থেকে তো অবসর নিয়েছি। টি-টোয়েন্টি আমি এখনও খেলতে প্রস্তুত আছি, পুরোপুরিই তৈরি আছি এবং যখনই সুযোগ পাই, নিজের সেরা দিয়ে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মোহাম্মদ রফিকের বিপক্ষে খেলেছেন। এবার তিনি সহকারী কোচ, অনুশীলনে তাকে খেলেছেন; এই অভিজ্ঞতাটা কেমন?
মালিক: আমি তাকে বয়স জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন যে তার বয়স ৫৭ বছর (৫২ বছর)। তবে এখনও তিনি নেটে যেভাবে বল করেন, এমনকি অনুশীলনে ফুটবলে তিনি যেভাবে খেলেন, এখনও তিনি বেশ ফিট!
তার বিপক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছি। দেশের জন্য তিনি সত্যিই ভালো করেছেন। মানুষ হিসেবেও তিনি দারুণ। কোচিং স্টাফের অন্যরাও ক্রিকেটারদের নানাভাবে সাহায্য করেন। এই কোচিং স্টাফ বেশ তরুণ হলেও তাদের সবচেয়ে ভালো দিক হলো, ম্যাচ হারলেও তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে না। এটিই সবচেয়ে জরুরী। কৃতিত্ব তাই তাদের প্রাপ্য। গোটা দলকে একসুতোয় গেঁথে রাখছেন তারা। অনুশীলনের সম্ভাব্য সেরা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা।
প্রশ্ন: পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ে বদল এসেছে। এতে কি আপনার জাতীয় দলের ফেরার সম্ভাবনা বেড়েছে?
মালিক: দেখুন ভাই, ওসব নিয়ে আমি একটুও ভাবি না। ওই ধরনের ভাবনা আমার মাথা ও মনে আসেই না। কারণ, আমি একজন ক্রিকেটার এবং জীবনে অনেক কিছু দেখা হয়ে গেছে। এই পর্যায়ে এসে, এসব ব্যাপার আমাকে আর ভাবায় না।
একজন অ্যাথলেট হিসেবে… এই বার্তাটি সব অ্যাথলেটের জন্যই, দলীয় খেলায় কখনোই ভাবার কিছু নেই যে কে তোমার পক্ষে আছে, কে নেই। লক্ষ্য থাকা উচিত ঘাম ঝরানোয়, কঠোর পরিশ্রমে ভরসা রাখা এবং নিজের প্রতি ও আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখা।
প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যখন আসে, এই ফরম্যাট নিয়ে কী মনে হয়েছিল? কতোটা বদলেছে?
মালিক: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট শুরুর সময় ১৩০-১৪০ রান অনেক ক্ষেত্রেই ছিল যথেষ্ট। এখন উইকেট যদি ভালো হয়, ২২০-২৩০ রানও নিরাপদ নয়। শুরুর দিনগুলোর চেয়ে তাই অনেক কিছুই এখন বদলে গেছে। ক্রিকেটার হিসেবে সবার দায়িত্ব সময়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা, যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে টিকে থাকা যায় এবং নিজের খেলার ধারাবাহিক থাকা যায়, দলের জন সহায়ক থাকা যায়। বছরের পর বছর ধরে আমি এটাই করার চেষ্টা করছি যেন সময়ের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকা যায়, যাতে যেখানেই খেলতে যাই না কেন, দলের চাহিদা যেন মেটাতে পারি।
প্রশ্ন: দুই ফরম্যাট থেকে অবসর নিয়েছেন, এখনও টি-টোয়েন্টি খেলছেন। কখনও কি মনে হয়েছে, এটাই আপনার ফরম্যাট?
মালিক: মোটেই তা নয়। তিনশর কাছাকাছি (২৮৭টি) ওয়ানডেও খেলেছি আমি! কখনই ভাবিনি যে এটাই আমার সংস্করণ বা এ রকম কিছু। ক্রিকেটার হিসেবে দায়িত্ব হলো নিজের কাছে জিজ্ঞেস করা, এরপর মনের ভেতর থেকে যা আসবে, সেটায় অটল থাকা। নিজের জন্য লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই এটা করে আসছি।
প্রশ্ন: বিশ্বের বিভিন্ন লিগে খেলার অভিজ্ঞতা আছে আপনার। সেসবের তুলনা বিপিএলের ক্রিকেটীয় মান কেমন?
মালিক: ক্রিকেটের মান এখানে খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। কারণ, ব্যাটসম্যানরা এখানে ব্যাটিং বান্ধব উইকেট তেমন পায় না। কন্ডিশনও এখানে একেক জায়গায় একেকরকম। চট্টগ্রামে একরকম, ঢাকায় আরেকরকম, সিলেটে আবার ভিন্ন। একেক ভেন্যুতে একেকরকম কন্ডিশন পেলে খেলায় উন্নতির সেরা সুযোগ মেলে। এ জন্যই বাংলাদেশে আসতে এবং এখানে খেলতে।
প্রশ্ন: বোলিং অনুশীলনে বেশ সময় দিলেন, বোলিংয়ে নতুন কিছু যোগ করার চেষ্টা করছেন?
মালিক: বোলিংয়ে গোটা দুয়েক বৈচিত্র নিয়ে কাজ করছি। কারণ, টি-টোয়েন্টিতে অফ স্পিনাররা আক্রমণে আসা মাত্রই ব্যাটসম্যানরা আগ্রাসী হতে শুরু করে। এ জন্যই কিছু বৈচিত্র নিয়ে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছি আমি এবং কাজ করছি সেসব নিয়ে।
প্রশ্ন: স্পিনের বিপক্ষে আপনি দুর্বার, ডাউন দ্য উইকেটে গেলেই ধরে নেওয়া হয় যে ছক্কা হবে। এটার রহস্য কী? স্পিনারদের কীভাবে দেখেন?
মালিক: ছক্কা হয় যদি বল জায়গায় থাকে। বল যদি আমার স্লটে না থাকে, তখন সেভাবেই সামলাতে হয়। এটা অনুশীলন থেকে আসে। কঠোর পরিশ্রম থেকে আসে। পরিশ্রম ছাড়া ধারাবাহিকভাবে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। পরিশ্রমই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এরপর নিজের ওপর বিশ্বাস।
প্রশ্ন: ৪৯৮টি টি-টোয়েন্টি খেলেছেন, ১২ হাজারের বেশি রান করেছেন। কিন্তু সেঞ্চুরির স্বাদটা পাননি। ব্যাটিং পজিশনের কারণে এটা স্বাভাবিকই। এরপরও শেষ বেলায় সেঞ্চুরির অপূর্ণতা কাটানোর ইচ্ছা আছে কিনা?
মালিক: হ্যাঁ, আমি নিশ্চিতভাবেই চেষ্টা করব, হয়তো ওপেন করা শুরু করতে হবে (হাসি)! আমি মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করি। দলের চাওয়া থাকে, খেলা শেষ করে আসা। দলের জন্য ফিনিশার হওয়া নিয়েই তাই মূলত আমার ভাবনা থাকে। এ জন্যই হয়তো আপনারা আমার কাছ থেকে সেঞ্চুরি পাননি।
একবার মনে আছে আমার, ওপেন করেছিলাম এবং ৯৫ রানে অপরাজিত ছিলাম। পরে মনে হচ্ছিল, আর পাঁচ-ছয় রান যদি হতো! তবে ব্যাপারটি হলো, আমি সব সময় দলের জন্য খেলি এবং ফিনিশারের ভূমিকাটাই সবচেয়ে প্রাধান্য পায়। যদি কখনও সুযোগ আসে, শতরানের কাছাকাছি যদি যেতে পারি, সেঞ্চুরির সব চেষ্টাই করব।