পাঁচদিন ধুঁকে ধুঁকে হার, হোয়াইটওয়াশ বাংলাদেশ
পাঁচ দিনের টেস্টে ১৫টি সেশন। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে ভাগাভাগি হয় সেশনে। গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেটে টেস্ট ক্রিকেট তো আরও অনিশ্চিত। দীর্ঘতম এই ফরম্যাটে ম্যাচের রং বদলায় ক্ষণে ক্ষণে। যদিও চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্টের গল্পটা হলো ভিন্ন। যে গল্পে সবই প্রায় নিশ্চিত ছিল। ফল কী হতে পারে, আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। পাঁচ দিনে অনুষ্ঠিত ১৩টি সেশনের সবগুলোতেই রাজত্ব করেছে লঙ্কানরা। ব্যাটিং ব্যর্থতার পাশাপাশি ক্যাচ মিসের মহড়া দেওয়া বাংলাদেশ ম্যাচের পুরোটা সময় ধুঁকে ধুঁকে মেনে নিলো আরেকটি হার।
চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ১৯২ রানে হেরেছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল। এই হারে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের এই সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হলো বাংলাদেশ। শুনতে প্রহসন মনে হতে পারে, তবে ব্যাটিংয়ে চরম দুঃসময়ে থাকা বাংলাদেশের উন্নতিই হয়েছে কিছুটা। সিলেট টেস্টেও বাংলাদেশকে ৫১১ রানের লক্ষ্য দেয় লঙ্কানরা, ঘরের মাঠের দলটি হারে ৩২৮ রানে। এবার একই লক্ষ্যে হারের ব্যবধান কমেছে, এসেছে একটি ৩০০ ছাড়ানো ইনিংসও। যে ইনিংসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ ইনিংস।
শ্রীলঙ্কার প্রথম ইনিংসে চরম বাজে ফিল্ডিং করে বাংলাদেশ, শান্ত-জাকিরদের হাত ফসকে বেরোয় সাতটি ক্যাচ। সুযোগ কাজে লাগিয়ে ছয় হাফ সেঞ্চুরিতে ৫৩১ রান তোলে লঙ্কানরা। যা টেস্ট ইতিহাসে সেঞ্চুরিবিহীন সর্বোচ্চ রানের সংগ্রহ। জবাবে চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় ১৭৮ রানেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশ, প্রথম ইনিংসেই পিছিয়ে পড়তে হয় ৩৫৩ রানে।
৭ উইকেটে ১৫৭ রান তুলে শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ইনিংস ঘোষণা করলে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ৫১১। দ্বিতীয় ইনিংসে কিছুটা উন্নতি করা বাংলাদেশ ৩১৮ রানে অলআউট হয়। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে খেলা ২৬ টেস্টের ২০টিতে হারলো বাংলাদেশ। ৫টি ম্যাচ ড্র হয়, বাংলাদেশের জয় একটিতে। টেস্টে এ নিয়ে ষষ্ঠবারের মতো শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে হোয়াইটওয়াশ হলো বাংলাদেশ।
অবস্থা বিবেচনায় পুরো ম্যাচে একটি সেশন ছিল বাংলাদেশের দখলে, কিন্তু তাতে অবশ্য শ্রীলঙ্কার কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না। তৃতীয় দিন শেষ বিকেলে দ্বিতীয় সেশনে নেমে ৮৯ রানে ৬ উইকেট হারায় শ্রীলঙ্কা, শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেটে ১০২ রান তুলে দিনের খেলা শেষ করে সফরকারীরা। ততোক্ষণে তাদের ৪৫৫ রানের লিড দাঁড়িয়ে গেছে। তাই সেশনটি বাংলাদেশে দখলে গেলেও বিপদ হয় শ্রীলঙ্কার, এমনকি ফায়দা মেলেনি শান্তদেরও। সেশনটি কেবল রেকর্ড হিসেবে থেকে যাবে স্কোরকার্ডেই।
বিশাল লক্ষ্য পাড়ি দিতে নেমে চতুর্থ দিনেই বাংলাদেশের হার প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। অদ্ভুত সব শট খেলে আত্মাহুতির মিছিলে যোগ দেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা, ৭ উইকেটে ২৬৮ রান তুলে দিনের খেলা শেষ করে তারা। মেহেদী হাসান মিরাজ ৪৪ ও তাইজুল ইসলাম ১০ রানে অপরাজিত থাকেন। বাকি থাকা তিন উইকেটে পঞ্চম দিন সকালে সোয়া এক ঘণ্টা ব্যাটিং করে বাংলাদেশ। এই ইনিংসে কেবল মিরাজ ছিলেন ব্যতিক্রম, দারুণ ব্যাটিং করা ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান অপরাজিত থেকে মাঠ ছাড়েন।
চট্টগ্রাম টেস্টে বলার মতো যা মিলেছে বাংলাদেশের, এর মধ্যে মিরাজের ইনিংসটি অন্যতম। ডানহাতি এই অলরাউন্ডার শেষের তিন ব্যাটসম্যানের সঙ্গে যথাক্রমে ৪৬, ৩৮ ও ৩১ রানের জুটি গড়েন। প্রতিটি জুটিতেই তার রান ছিল বেশি। শেষ দিনে তাইজুল, খালেদ ও হাসান হয়ে যাওয়ায় সম্ভাবনা জাগিয়েও সেঞ্চুরির দেখা পাননি মিরাজ। সাবলীল ব্যাটিংয়ে ১১০ বলে ১৪ চারে অপরাজিত ৮১ রান করেন তিনি। এর আগে জয় ২৪, জাকির ১৯, শান্ত ২০, মুমিনুল ৫০, সাকিব ৩৬, লিটন ৩৮, শাহাদাত ১৫ ও তাইজুল ১৪ রান করেন।
ব্যাট হাতে দারুণ ছন্দে থাকা কামিন্দু মেন্ডিস টেস্টে প্রথমবারের মতো বোলিং করে ৩ উইকেট পান, তার প্রথম শিকার সাকিব আল হাসান। ব্যাটে-বলে আলো কেড়ে ম্যাচসেরা হন তিনি। সিলেট টেস্টের দুই ইনিংসেই করেন সেঞ্চুরি, তাই সিরিজ সেরার পুরস্কার গেছে তার ঝুলিতে। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসে সবচেয়ে ভোগানো লাহিরু কুমারা ৪টি উইকেট নেন। এ ছাড়া প্রবাথ জয়সুরিয়া ২টি ও বিশ্ব ফার্নান্দো একটি উইকেট পান।
হতাশার পাঁচ দিনে মিরাজের ইনিংসের পাশাপাশি তাইজুলের লড়াই ও হাসান মাহমুদের বোলিং উল্লেখ করার মতো। শেষ বিকেলে বিপদ বাড়লেই নাইট ওয়াচম্যান করা হয় বাঁহাতি এই স্পিনারকে। তাইজুল উইকেটে যান, গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। সিলেট টেস্টের প্রথম ইনিংসে বিপর্যয়ের মাঝে পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান ওয়ে ওঠেন তিনি, ৮০ বলে করেন ৪৭ রান। বল মোকাবিলা ও রান; দুটোই বাংলাদেশের ইনিংসের সর্বোচ্চ ছিল, পরের ইনিংসে ১৫ বলে ৬ রান করে আউট হন।
চট্টগ্রাম টেস্টেও একই তাইজুলকে দেখা গেছে। প্রথম ইনিংসে নাইট ওয়াচম্যান হিসেবে তিন নম্বরে নামা এই বাঁহাতি ৬১ বল টেকেন, যা বাংলাদেশের ইনিংসের তৃতীয় সর্বোচ্চ। তার করা ২২ রানও ইনিংসের তৃতীয় সেরা। দ্বিতীয় ইনিংসে নাইট ওয়াচম্যান হতে হয়নি তাকে। ৯ নম্বরে নেমে ২৮ বলে ১৪ রান করেন তিনি। সব মিলিয়ে দুই টেস্টে ১৮৪ বল খেলেছেন তাইজুল।
দুই টেস্টের চার ইনিংসে তিনি রান করেছেন ৮৯, যা অনেক ব্যাটসম্যানের চেয়েও বেশি। ওপেনার মাহমুদুল হাসান জয়, অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, লিটন কুমার দাস ও শাহাদাত হোসেন দিপুর চেয়ে বেশি রান তাইজুলের। চরম হতাশার টেস্টে উজ্জ্বল ছিলেন অভিষিক্ত হাসান মাহমুদ। ডানহাতি এই পেসার ম্যাচে ৬ উইকেট নিয়ে অভিষেক পর্ব রাঙিয়ে নিয়েছেন। প্রথম ইনিংসে তার বলে কয়েকটি ক্যাচ পড়ার পরও ২ উইকেট নেন তিনি। শ্রীলঙ্কার দ্বিতীয় ইনিংসে ধস নামানো হাসান নেন ৪ উইকেট।