‘এখন থেকে কেউ-ই আর নারী আম্পায়ার নিয়ে আপত্তি জানাবে না’
অনভিজ্ঞ বলে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ম্যাচে সাথিরা জাকির জেসির অধীনে খেলতে নাখোশ ছিলো মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও প্রাইম ব্যাংক ক্রিকেট ক্লাব; তথ্যটি দিয়েছেন খোদ বিসিবির আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ মিঠু। তবে বিষয়টি এতোটুকুতেই থাকেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যসহ কিছু সংবাদমাধ্যমে খবর হয়েছে, নারী আম্পায়ার বলেই ক্লাব দুটি আপত্তি জানায়। এতে জড়ানো হয় তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারের নাম।
এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় ওঠে, ক্রিকেটারদের কাঠগড়ায় তুলে তাদের মণ্ডুপাত করেন অনেকেই। যদিও বেশিরভাগ সমালোচনাকারীরই জানা নেই গত ২৫ এপ্রিল মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে আম্পায়ার ইস্যুতে কী হয়েছিল। বিষয়টি নিয়ে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেছেন ইফতেখার আহমেদ। তিনি জানান, খুশি মনে জেসিকে আম্পায়ার হিসেবে মেনে নেয়নি দল দুটি, তারা নাখোশ ছিল। তবে এতে ক্রিকেটারদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। 'নারী আম্পায়ার' বলে আপত্তি, এই বিষয়টি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হলেও বিসিবির এই পরিচালক এখানে ইতিবাচক বিষয় দেখছেন। এমন আলোচনার কারণে ভবিষ্যতে আর কেউ নারী আম্পায়ার নিয়ে আপত্তি তুলবেন না বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগের অন্ত ছিল না, এ নিয়ে অতীতে অনেক সমালোচনা হয়েছে। ম্যাচ চলাকালীন বিভিন্ন ঘটনায় ক্রিকেটারদের পাশাপাশি ক্লাব কর্মকর্তাদের উত্তেজনা প্রকাশ করার ঘটনা একটা সময় নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। সব মিলিয়ে প্রিমিয়ার লিগে দায়িত্ব পালন করা আম্পায়ারদের জন্য কঠিন কাজই। জেসির কথাতেও সেটা স্পষ্ট, 'মেয়েদের আন্তর্জাতিক ম্যাচ থেকেও এখানে অনেক চাপ থাকে। এখানে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা খেলে। পাশাপাশি ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের চাপও থাকে আলাদা। এই অবস্থায় আমার জন্য গোটা বিষয়টি ছিল বেশ চ্যালেঞ্জের।'
জেসিকে নিয়ে ক্লাব দুটোর বক্তব্য কী ছিল? ক্রিকেটারদের কি কোনো আপত্তি ছিল? ইফতেখার আহমেদ বলেন, 'কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছিল না। এখানে অনেকেই খেলোয়াড়দের জড়াচ্ছে, এটা নিয়ে আমাদের পর্যন্ত কিছু আসেনি। তামিম, মুশফিকদের নাম জাড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলা করা হচ্ছে, এটা সঠিক নয়। প্রাইম ব্যাংকের ম্যানেজার শিকদার আবুল হাশেম কঙ্কন ও মোহামেডানের তরিকুল ইসলাম টিটো স্বীকার করেছেন, অনভিজ্ঞ আম্পায়ার দেওয়ার কারণে তারা আপত্তি জানিয়েছে, মহিলা আম্পায়ার বলে নয়। মূলত তারা অখুশি ছিল। তারা খুশি ছিল না যে অনভিজ্ঞ আম্পায়ার কেন দিয়েছি।'
অনভিজ্ঞর আলোচনায় বিরক্ত ইফতেখার আহমেদ। বিসিবি পরিচালকের প্রশ্ন জেসিকে কীভাবে অনভিজ্ঞ বলা হয়। তিনি বলেন, 'জেসি অনভিজ্ঞ হয় কীভাবে। সে ইমার্জিং এশিয়া কাপে আম্পায়ারিং করেছে, অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ম্যাচে করেছে, যা আন্তর্জাতিক ম্যাচ। দ্বিতীয় বিভাগ, প্রথম বিভাগ; সবখানেই দায়িত্ব পালন করেছে। অনভিজ্ঞ বলার সুযোগ কোথায়। কিন্তু এখানে খেলোয়াড়দের যেভাবে জড়ানো হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। আমার কাছে ক্রিকেটারদের পক্ষ থেকে এমন কিছু আসেনি। দুই দল বলেছে, অনভিজ্ঞ হওয়ায় জেসিকে এখানে না দিতে।'
যদিও মোহামেডানের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। অভিযোগ বা আপত্তির কথা মোহামেডানের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি বলে দাবি তার। টিবিএসকে তিনি বলেন, 'আমি আপত্তি জানাইনি, অখুশিও হইনি। আম্পায়ার দেখেছি, আমার ধারণা ছিল না। আজ আমার আম্পায়ার্স কমিটির চেয়ারম্যানের সাথে কথা হলো, তিনি বললেন জেসি প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বিভাগে আম্পায়ারিং করে এসেছে। আমি বলেছি, মেয়েটা ভালো ম্যাচ পরিচালনা করেছে। ফিল্ডিং দল চাপ প্রয়োগ করায় প্রথম দিকে চাপে ছিল, পরে সামলে নিয়েছে। সে আমাদের বিপক্ষে একটা ভুল সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তাও অভিযোগ করিনি। কারণ সে এখানে প্রথম ম্যাচ করতে এসেছে এবং ভালোভাবে পরিচালনা করেছে। আমরা সন্তুষ্ট, তাহলে অভিযোগ দিলাম কীভাবে। আমরা তার ব্যাপারে কোনো অভিযোগ দিইনি, এ নিয়ে কথাও বলিনি। এটা কোত্থেকে এলো, এটা আমার প্রশ্ন।'
আম্পায়ার কমিটির প্রধান দুই দলের অখুশির না থাকার বলেছেন, এটা জানানোর পর তরিকুল বলেন, 'না, আজও তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমাকে তো এমন বলেনি। আমি তাকে প্রশ্ন করেছি, এটা আপনি কোথায় পেলেন। তিনি হয়তো মিড গাইডেড হয়েছেন, কেউ হয়তো তাকে বলেছে না। তিনি হয়তো সেটার ওপর মন্তব্য করেছেন। তবে আমরা কিছু বলিনি, মোহামেডান কিছু বলেনি। মোহামেডানে ক্রিকেট নিয়ে কোনো আলোচনা হলে তো সবার আগে আমি জানবো। আমি আপত্তি বা অভিযোগ করিনি, আমাদের পক্ষ থেকেও কেউ কিছু বলেনি ওইরকম।'
ইফতেখার আহমেদ একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, জেসিকে নিয়ে নাখোশ থাকার ব্যাপারটি ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসকে (সিসিডিএম) জানায় ক্লাব দুটি। যদিও এমন কিছু হয়নি। সিসিডিএমের প্রধান সালাউদ্দিন চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'আমার কাছে কোনো আপত্তির কথা জানায়নি কোনো ক্লাব। মাঠে তারা কী বিস্ময় প্রকাশ করেছে, সেটা তাদের ভেতরের ব্যাপার। আমাকে তো অফিসিয়ালি কিছু বলেনি। যদি আমার কাছে বিষয়টি আসতো তাহলে আমি কমিটিতে ব্যাপারটি তুলতাম, কথা বলতাম। কিন্তু আমার কাছে এমন কিছুই আসেনি।'
আনুষ্ঠানিক বা লিখিত অভিযোগ না করার পরও বিসিবির দায়িত্বশীল একজন হিসেবে বিষয়টি সংবাদমাধ্যমে বলাটা কতোটা যুক্তিসঙ্গত ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে ইফতেখার আহমেদ বলেন, 'আমি বলেছিলাম, তারা অখুশি ছিল। তারা খুশি হয়ে জেসিকে মেনে নেয়নি। তারা নাখোশ ছিল। আমি সব মিলিয়ে বলেছি। শুধু ওই ম্যাচে দুই ক্লাবের আপত্তির কারণে বলিনি। আমি বলতে চেয়েছি, আম্পায়ারদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। আমি আম্পায়ারদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি, যেহেতু আম্পায়ারদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। যে আউটটা অনফিল্ড আম্পায়ারের এখতিয়ারের মধ্যে নেই, এমন ঘটনায় ব্যাপারটি এসেছে।'
'রনির পায়ে সীমানার দড়ি লাগে (মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংক ম্যাচের ঘটনা), এই আউট দেওয়ার এখতিয়ার আম্পায়ারের নেই। এ ক্ষেত্রে খেলোয়াড় বলবে, আউট কি আউট না। ডিআরএস না থাকলে ৭০ গজ দূর থেকে এটা দেখা সম্ভব নয়। আবার আরেকটি ম্যাচে কনকাশন নিয়ে ২০ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল। ওটাও আম্পায়ারের এখতিয়ারের মধ্যে নেই। শুধু শুধু আম্পায়াররা বদনামের ভাগী হচ্ছেন। এ নিয়ে মূলত কথা হয়েছে একটি পত্রিকার সঙ্গে। সেখান থেকে আপত্তি জানানোর ব্যাপারটি আসে। আর সবকিছু কিন্তু অফিসিয়ালি দেয় না। পত্রিকার রিপোর্ট দেখেও আমরা রিভিউ করি। এলবিডব্লিউ নিয়ে খারাপ সিদ্ধান্ত গেলে আমি আম্পায়ারদের ডেকে বলি, এখানে একটা ভুল সিদ্ধান্ত গেছে। এখানে ঘটনা ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে, নারী বিদ্বেষের ব্যাপার জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যার কোনো ভিত্তি নেই।' যোগ করেন তিনি।
কথাগুলো বলার যৌক্তিকতার প্রসঙ্গে ইতিবাচক দিক তুলে ধরলেন আম্পায়ার কমিটির প্রধান। পুরো ঘটনায় তিনি 'মঙ্গল' খুঁজে পাচ্ছেন। তার ভাষায়, 'এই ঘটনায় প্লাসপয়েন্ট দেখেন, এসব হওয়াতে ভবিষ্যতে এটা নিয়ে আর কথা উঠবে না। এখন থেকে আর কেউ নারী আম্পায়ার নিয়ে আপত্তি জানাবে না। নারী আম্পায়ার নিয়ে আর কোনো অভিযোগ উঠবে না। এ কারণে আমি মিডিয়াকে সাধুবাদ জানাই। নারী কিংবা জুনিয়র আম্পায়ার হোক, তাদের আমার সুযোগ দিতে হবে। না হলে আমি কীভাবে আম্পায়ারদের তৈরি করব। কেউ ভুল করলে সেটার পর্যালোচনা হবে, আম্পায়ারকে বলব ভুল করেছেন আপনি। বাজে আম্পায়ারিং করার কারণে আমি তাদের জাতীয় লিগে দায়িত্ব দিই নাই। এটার তো প্রক্রিয়া থাকতে হবে।'
'দেশের মাটিতে সামনে মেয়েদের বিশ্বকাপ আছে, আমাদের দুটি মেয়ে দায়িত্ব পালন করলে সবাই খুশি হবে না, দেশ খুশি হবে না? তো তাকে যদি আমি আগে সুযোগ না দিই, এটা কীভাবে করবো! তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহরা এটা নিয়ে কোনো আপত্তি জানায়নি। অফিসিয়ালরা আলাপ করেছে, যেটা তারা পরিষ্কার করে দিয়েছে। আমি এটা নিয়ে আলোচনা না করে যদি চুপ থাকতাম তাহলে এটা আসতো না (নারী আম্পায়ার)। দুই দিকই দেখতে হবে। এতে ভালোই হয়েছে, এটা নিয়ে আর অভিযোগ উঠবে না। আম্পায়ার বিভাগ যাদের দেবে, তারা দায়িত্ব পালন করবেন।'
আলোচনা-সমালোচনার ফলে নারী আম্পায়ারসহ অনভিজ্ঞতা নিয়েও আর প্রশ্ন উঠবে না বলে মনে করেন ইফতেখার আহমেদ। পাশাপাশি আরও একবার তিনি মনে করালেন, এই ঘটনায় ক্রিকেটারদের সম্পৃক্ততা নেই, 'এখন অনভিজ্ঞতা নিয়েও অভিযোগ উঠবে না। আইসিসির আন্তর্জাতিক প্যানেলের অনুমোদিত আম্পায়ার, আপনি আর কী চান তাহলে! মিডিয়া যেভাবে সত্যিটাকে তুলে এনেছে, এটা আমাদের সমাজের জন্য ভালো হবে। এটা আমার ব্যক্তিগত মত। সব মিলিয়ে এই ঘটনায় একটা ব্যাপার ভালো হয়েছে যে, এটা নিয়ে আর কেউ উচ্চবাচ্য করবে না। অনভিজ্ঞ বা নারী আম্পায়ার, এসব নিয়ে আর কথা উঠবে না। অনেকে খেলোয়াড়দের নাম জড়িয়েছে, তবে আমরা খেলোয়াড়দের নাম শুনিনি। ওদেরই ব্যাচের মেয়ে, সাকিবের সঙ্গে পড়েছে জেসি। কেন বলবে তামিম, মুশফিকরা এমন। অনেকেই ফোন করেছে, তামিম ফোন করে বলেছে 'মিঠু ভাই আমরা তো কিছু বলিনি।' মূলত ক্লাব অখুশি ছিল। ক্লাব বলেনি নারী আম্পায়ার বলে জেসির অধীনে খেলতে চাই না।'