দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে ১৭ বছর পর বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন ভারত
অক্ষর প্যাটেলের করা ইনিংসের ১৫তম ওভারে ঝড় বইয়ে দিলেন হেনরিখ ক্লাসেন। ২টি চার ও ২টি ছক্কাসহ ২৪ রান তুলে বল-রানের ব্যবধান নিয়ে এলেন হাতের নাগালে। ৩০ বলে দরকার ৩০ রান, তখনই দক্ষিণ আফ্রিকার দৃষ্টি সীমানায় প্রথম বিশ্ব শিরোপাটি হাজির হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু পরের ওভারেই ক্লাসেন ফিরলেন, এক ঝটকায় ফিঁকে হয়ে উঠলো দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন। তাতে আর রঙ লাগলো না, ম্যাচের পরের অংশটুকুতে দাপট দেখালেন ভারতের বোলাররা। প্রোটিয়াদের গায়ে চোকার অপবাদ ফিরিয়ে দিয়ে ১৭ বছর পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা ঘরে তুললো ভারত।
শনিবার বার্বাডোজের কেনিসংটন ওভালে রুদ্ধশ্বাস ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৭ রানে হারিয়েছে ভারত। এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শিরোপা জিতলো তারা। সংক্ষিপ্ততম এই ফরম্যাটের প্রথম বিশ্ব আসরে (২০০৭ সালে) চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে শিরোপার আশায় তারা। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠলেও লঙ্কান বাধায় স্বপ্নভঙ্গ হয় ভারতের। ১০ বছর আবারও ফাইনালে উঠে এবার কোনো বাধাকেই সামনে দাঁড়াতে দিলো না তারা, অপরাজিত থেকে ঘরে তুললো দ্বিতীয় শিরোপা।
শেষ ওভারেও অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার স্বপ্ন বেঁচে ছিল, ৬ বলে জয়ের জন্য দরকার ছিল ১৬ রান। স্ট্রাইকে তখনও ডেভিড মিলার, এ কারণে প্রোটিয়া শিবিরে তখনও শিরোপা স্বপ্ন তরতাজা। ভারতের পেসার হার্দিক পান্ডিয়ার করা ফুলটস উড়িয়ে মেরেছিলেন মিলার, মনে হচ্ছিল সীমানা ছাড়া হয়ে যাবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য এক ক্যাচে তাকে থামান সূর্যকুমার যাদব। প্রথমে বল হাতে নিয়ে রাখতে না পেরে মাঠের ভেতরে বল উপরে ছুঁড়ে বাইরে থেকে এসে তা তালুবন্দী করেন সূর্যকুমার। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ মিলিয়ে সাতটি সেমি-ফাইনাল খেলার পর ফাইনালে উঠেও প্রথম বিশ্ব শিরোপাটা ছুঁয়ে দেখা হলো না দক্ষিণ আফ্রিকার। যে অবস্থা থেকে তারা ম্যাচ হেরেছে, এক ম্যাচ পরই তাদের গায়ে ফিরে এলো চোকার অপবাদ।
টস জিতে আগে ব্যাটিং করতে নামে ভারত। দাপুটে শুরুর পর হঠাৎ-ই বিপদে পড়ে জুটি গড়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান ম্যাচসেরা বিরাট কোহলি ও অক্ষর প্যাটেল। এই জুটির পর শিবম ধুবের সঙ্গেও জুটি গড়েন বিশ্বকাপে অবশেষে ব্যাটকে কথা বলাতে পারা কোহলি। তার এবং অক্ষরের ব্যাটে ৭ উইকেটে ১৭৬ রান তোলে ভারত, যা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। জবাবে কুইন্টন ডি কক ও ট্রিস্টান স্টাবসের পর হেনরিখ ক্লাসেন ও ডেভিড মিলারের ব্যাটে ঠিক পথে থাকলেও শেষ তিকে ভারতের দারুণ বোলিংয়ের বিপক্ষে কুলিয়ে উঠতে পারেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রোটিয়াদের ইনিংস শেষ হয় ৮ উইকেটে ১৬৯ রানে।
বড় লক্ষ্য তাড়া করে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শিরোপার স্বাদ নিতে রেকর্ড গড়ে জিততে হতো দক্ষিণ আফ্রিকাকে। কিন্তু রান তাড়ায় তিন ওভারের মধ্যেই দুই উইকেট হারিয়ে বসে প্রোটিয়ারা। প্রথমবারের মতো কোনো বিশ্বকাপের ফাইনালে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকা ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে ওপেনার রিজা হেনড্রিকসকে হারায়। তার স্টাম্প উপড়ে নেন ভারতীয় পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ। পরের ওভারে অধিনায়ক এইডেন মার্করামকে ফিরিয়ে দেন ভারতের আরেক পেসার আর্শদীপ সিং।
১২ রানে ২ উইকেট হারানোর চাপ কাটিয়ে তোলেন ডি কক ও স্টাবস। তাদের ব্যাটে পাওয়ার প্লের ৬ ওভারে ২ উইকেটে ৪২ রান তোলে প্রোটিয়ারা। এই জুটি আরও কিছুটা পথ পাড়ি দেয়, যোগ করে ৩৮ বলে ৫৮ রান। ২১ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ৩১ রান করা স্টাবসকে ফিরিয়ে এই জুটি ভাঙেন অক্ষর। এরপরও ঠিকভাবেই এগোয় দক্ষিণ আফ্রিকা। চতুর্থ উইকেটে ক্লাসেনের সঙ্গে ২৩ বলে ৩৬ রান যোগ করে বিদায় নেন ডি কক। বাঁহাতি এই ওপেনার ৩১ বলে ৪টি চার ও একটি ছক্কায় ৩৯ রান করেন।
ডি কককে হারালেও চাপ বোঝেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। মিলারকে একপাশে রেখে ঝড় তোলেন ক্লাসেন। অক্ষরের করা ১৫তম ওভারে ২টি করে চার ও ছক্কাসহ ২৪ রান তোলেন ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান। ম্যাচ চলে আসে হাতের মুঠোয়, জেতার জন্য তাদের দরকার দাঁড়ায় ৩০ বলে ৩০ রান। কিন্তু ১৭তম ওভারে ক্লাসেনকে ফিরিয়ে মোড় ঘুরিয়ে দেন হার্দিক পান্ডিয়া। ২৭ বলে ২টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৫২ রানের জুড়ো ইনিংস খেলেন থামেন ক্লাসেন, ভাঙে মিলারের সঙ্গে তার ২২ বলে ৪৫ রানের জুটি।
১৮তম ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকার চাপ আরও বাড়ান জাসপ্রিত বুমরাহ, মাত্র ২ রান খরচায় তুলে নেন মার্কো ইয়ানসেনের উইকেট। ১২ বলে তখন দরকার ২০, কিন্তু ১৯তম ওভারে মাত্র ৪ রান দেন আর্শদীপ সিং। শেষ ওভারে ১৬ রানের দরকার পড়লে তা আর তুলতে পারেনি প্রোটিয়ারা। মিলার ১৭ বলে ২১ রান করেন। শেষ ওভারে ৮ রান দিয়ে ভারতের জয় নিশ্চিত করা হার্দিক ৩ ওভারে ২০ রানে নেন ৩ উইকেট। ৪ ওভারে ১৮ রানে ২ উইকেট শিকার বুমরাহর। আর্শদীপও নেন ২ উইকেট, ৪ ওভারে তার খরচা ২০ রান। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে স্টাবসকে ফেরানো অক্ষর ছিলেন খরুচে। ১ উইকেট নেওয়া বাঁহাতি এই স্পিনার ৪ ওভারে দেন ৪৯ রান।
এর আগে ব্যাটিং করা ভারতের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেন আসরজুড়ে রানখরায় থাকা কোহলি। ডানহাতি এই ওপেনার ৫৯ বলে ৬টি চার ও ২টি ছক্কায় ৭৬ রানের ম্যাচ বাঁচানো ইনিংস খেলেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটা তার ১৫তম হাফ সেঞ্চুরি, যা আসরটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। রানে ফেরার এই ইনিংস দিয়ে সংক্ষিপ্ততম ফরম্যাটের এই বিশ্ব আসরের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হয়ে গেছেন কোহলি। ৩৫ ম্যাচে ৩৩ ইনিংসে ব্যাটিং করে ৫৮.৭২ গড়ে ১ হাজার ২৯২ রান করেছেন ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান। ৪৪ ইনিংসে ৩৪.৮৫ গড়ে ১ হাজার ২২০ রান নিয়ে রোহিত শর্মা দুই নম্বরে।
অল্প রানের ব্যবধানেই ৩ উইকেট হারানো ভারতকে ঠিক পথে ফেরানোর আসল কাজটি অবশ্য অক্ষর করেছেন। বাঁহাতি এই অলরাউন্ডার উইকেটে গিয়েই নিজেকে মানিয়ে নেন। চাপ কাটিয়ে ৩১ বলে একটি চার ও ৪টি ছক্কায় ৪৭ রানের কার্যকর এক ইনিংস খেলেন তিনি। আউট হওয়ার আগে কোহলির সঙ্গে ৫৪ বলে ৭২ রানের জুটি গড়েন তিনি। অক্ষরের বিদায়ের পর দুবের সঙ্গে আরেকটি জুটি গড়েন ফাইনালে দলের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া কোহলি। আউট হওয়ার আগে দুবের সঙ্গে ৩৩ বলে ৫৭ রানের জুটি গড়েন তিনি। যেখানে তার অবদানই বেশি, ২০ বলে করেন ৩৩ রান, দুবের অবদান ১৩ বলে ২২।
কোহলি ফেরার পর দুবে বেশি রান তুলতে পারেননি। ১৬ বলে ৩টি চার ও একটি ছক্কায় ২৭ রান করেন তিনি। এদিন ভারতের অধিনায়ক রোহিত পারেননি, ৫ বলে ৯ রান করেন ভারত অধিনায়ক। পন্ত রানের খাতা খুলতে পারেননি। ৩ রান করেই থামেন সূর্যকুমার। হার্কি পান্ডিয়া ২ বলে ৫ ও রবীন্দ্র জাদেজা ২ রান করেন। ভারতকে শুরুতেই চাপে ফেলা দক্ষিণ আফ্রিকার বাঁহাতি স্পিনার কেশব মহারাজ ৩ ওভারে ২৩ রানে ২ উইকেট নেন। ৪ ওভারে ২৬ রান খরচায় আনরিখ নরকিয়ার শিকারও ২ উইকেট। একটি করে উইকেট পান মার্কো ইয়ানসেন ও কাগিসো রাবাদা।