ট্রুম্যানের কথায় বোলিং অ্যাকশন বদলে যেভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন রবার্টস
এক সময় ক্রিকেটে ফাস্ট বোলিংয়ের শেষ কথা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয়ান অঞ্চল থেকে ৭০ ও ৮০'র দশকে উঠে এসেছেন কিংবদন্তি সব ফাস্ট বোলার। আর তাদের কল্যাণে ক্রিকেটে সেই সময়টায় বলতে গেলে এককভাবে রাজত্ব করেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্যারিবীয় পেসারদের এই ধারাটা শুরু হয় অ্যান্ডি রবার্টসের মাধ্যমে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৯ বছর চলেছে যেটি। এই সময়টায় টেস্ট ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হওয়া মানেই ছিল দুর্ধর্ষ ফাস্ট বোলিংয়ের সামনে পড়া।
ল্যারি কনস্টেনটাইন, চার্লি গ্রিফিথ, ওয়েস হলের মতোর ফাস্ট বোলাররা যুগে যুগে এসেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট মানচিত্রে। কিন্তু ক্যারিবীয়রা ফাস্ট বোলিংয়ের গডফাদার মানে একজনকেই। সেটি স্যার অ্যান্ডি রবার্টস। বর্তমানে ৭৩ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি বোলারের এক সময়ের সতীর্থ মাইকেল হোল্ডিংই যেমন বলেছেন, 'অ্যান্ডি যখন কিছু বলতো, আপনি তা শুনতে বাধ্য। কারণ সে খেলাটা এতটাই ভালো বোঝে।'
৭০ এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলিং চতুষ্টয়ের কথা ক্রিকেটের খোঁজ রাখা লোক মাত্রই জানেন। মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট ও জোয়েল গার্নারের সঙ্গে অ্যান্ডি রবার্টস- এই চারজন মিলে পরিচিত ছিলেন 'কোয়ার্টেট' নামে। যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৪ সালে রবার্টসের অভিষেকের মধ্য দিয়ে। সাবেক ওয়েস্ট ইন্ডিজ কিংবদন্তি নিজের মুখেই শুনিয়েছেন, কীভাবে গড়ে উঠেছিল বিশ্ব কাঁপানো সেই ফাস্ট বোলিং গ্রুপটি। যার পথ প্রদর্শক ছিলেন রবার্টস নিজেই।
'আমাকে বেশি কৃতিত্ব দেওয়ার কারণ- আমি ব্যাটসম্যানদের শক্তি আর দুর্বলতার জায়গা ধরতে পারতাম। টিম মিটিংয়ে সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করতাম।' ক্যারিয়ারের শুরুতে রবার্টস অনেকটা একাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণ টেনে নিয়েছেন। কিন্তু সব বদলে যায় ১৯৭৬ সালে যখন ক্যারিবীয়রা ত্রিনিদাদে ভারতের কাছে ছয় উইকেটের ব্যবধানে হেরে বসে। জয়ের জন্য ভারতের লক্ষ্য ছিল ৪০৬! এরপরই স্পিনের ওপর ভরসা হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
১৯৭৬ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে ৩-০ ব্যবধানে সিরিজ জেতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। শুরু হয় ফাস্ট বোলিংয়ের এক নতুন যুগ। নিজের বাকি সতীর্থদের নিয়ে রবার্টসের বিশ্লেষণ, 'আমরা প্রত্যেকে আলাদা ধরনের ছিলাম। আমাদের মধ্যে কলিন ক্রফট শারীরিকভাবে সবচেয়ে বেশি মারমুখী ছিল। জোয়েল আকারে বড় হলেও শান্তশিষ্ট ছিল। হোল্ডিংয়ের গতি ছিল সবচেয়ে বেশি, আর ওর দৌড়ানো দেখেই ব্যাটসম্যানরা ভড়কে যেত। আমার সবথেকে বড় অস্ত্র ছিল ভ্যারিয়েশন।'
সমালোচনাকে ভালোভাবেই নিতেন রবার্টস। যদি সেটি যৌক্তিক হতো এবং সেখান থেকে শেখার মতো কিছু থাকতো। ১৯৭৪ সালে হ্যাম্পশায়ারের হয়ে খেলার সময় রবার্টস একটি পত্রিকায় একটি আর্টিকেল পড়েন, যেটি লিখেছিলেন সাবেক ইংলিশ কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার ফ্রেড ট্রুম্যান। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, রবার্টস যদি তার ডান হাত আরেকটু ওপরে নিয়ে বল ছোঁড়েন তাহলে তিনি আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠবেন। সেটি পড়ার পর রবার্টস নেটে নিজের ডান হাত আরও ওপরে নিয়ে বল করা শুরু করেন, আর সেখানেই তিনি আউটসুইং করতে শেখেন!
নিজেকে প্রতিনিয়ত আরও ভালো করে তোলার ইচ্ছা আর পরীক্ষা করার কারণেই রবার্টস তার ট্রেডমার্ক বল আবিষ্কার করেন। শুরুর দিকে রবার্টসের ভ্যারিয়েশন ছিল কেবলই স্লোয়ার বল। এরপর তিনি দুই ধরনের বাউন্সার রপ্ত করেন। একটি বাউন্সার কিছুটা কম গতির বল, যেটি ব্যাটসম্যানরা মাঝেমাঝে সহজেই খেলতে পারতেন। ঠিক পরের বলটাই করতেন সর্বোচ্চ গতির বাউন্সার। যেটি তাকে এনে দিয়েছে অসংখ্য উইকেট।
তিনি যখন স্লোয়ার বাউন্সার করতেন তখন বলটিকে খুবই শক্ত করে ধরতেন। আর দ্রুত গতির বাউন্সার মারার সময় ধরতেন হালকা করে। এর কারণে রবার্টস দুটো বাউন্সার মারার সময় একই গতিতে হাত ঘোরাতে পারতেন। যা ব্যাটসম্যানকে ধোঁকায় ফেলে দিতো, 'সবাই আপনার চেষ্টাটা দেখবে, কিন্তু কাজ হওয়ার সময় সব একইরকম দেখাতো। আমি নিজেকে বলতাম, আমি যদি ১০০ মাইল গতিতে বল করতে পারি, আবার ৯০ মাইল গতিতেও পারি তাহলে ব্যাটসম্যানকে ভাবতে হবে যে কী আসতে যাচ্ছে। আর আমি যদি সব বলই ১০০ মাইল গতিতে করি তাহলে ব্যাটসম্যানের জন্য সমস্যস হবে না, কারণ সে জানেই কী আসতে যাচ্ছে।'
রবার্টস নিজের বোলিংয়ে আরও নতুনত্ব নিয়ে আসেন নিজের উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে। প্রতিটি বলেই তার হাতের এঙ্গেল থাকতো ভিন্ন ভিন্ন, নিজের রান-আপও বদলে ফেলতেন রবার্টস। সবসময় ব্যাটসম্যানের থেকে এগিয়ে থাকাকেই গুরুত্ব দিতেন এই কিংবদন্তি ফাস্ট বোলার৷
তবে রবার্টসের এত এত অবদানের মধ্যে সবচেয়ে বড়টা তার বোলিং ছিল না। বরং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপগুলোতে যে প্রতিভাবান ক্রিকেটার ছড়িয়ে আছে, সেটি আলোর মুখে এনেছিলেন তিনি। রবার্টসের অভিষেকের আগে কেবল চারটি বড় দ্বীপ পুঞ্জ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা আসতেন। ছোট দ্বীপগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। রবার্টসই এন্টিগা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট খেলা প্রথম ক্রিকেটার।
'ছোট দ্বীপগুলোর দিকে তাকানো হতো না। আমার জীবনে সরাসরি দেখা প্রথম কোনো টেস্ট ম্যাচ ছিল আমার নিজের অভিষেক ম্যাচ। আমাদের সময় বিষয়গুলো অনেক বেশি কঠিন ছিল, কারণ আমাদের সামনে কোনো মানদণ্ড ছিল না। আমি জানি যে আমার থেকে ভালো খেলোয়াড় ছিল যারা খেলার সুযোগই পায়নি। তবে আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে আমাকে বাদ দেওয়ার কাজটা আমি কঠিন করে তুলব। তাই আমার মধ্যে সেই অনুপ্রেরণাটা ছিল।'
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪৭ টেস্টে ২০২ উইকেট নেওয়া রবার্টসই প্রথম দেখিয়েছেন, কীভাবে সব দ্বীপ থেকে মিলিয়ে দল গড়লে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট উপকৃত হতে পারে। রবার্টসের পর তিন এন্টিগুইয়ান- ভিভ রিচার্ডস, কার্টলি এম্ব্রোস ও রিচি রিচার্ডসন ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ১৯৮০-১৯৯৫ সালের মধ্যে কোনো টেস্ট সিরিজ না হারা দলের সদস্য। ১৯৮১ সাল থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এন্টিগাতে টেস্ট ম্যাচ আয়োজন করে আসছে।
এত কিছুর পথিকৃৎ হয়েও, নিজের ঘরের মাঠের দর্শকদের সামনে খেলতে পেরেও রবার্টসের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ১৯৭৬ সালের সেই ইংল্যান্ড সফরটাই, 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য ইংল্যান্ডে জেতা। সেখানে আমার আত্মীয়-স্বজনরা থাকতেন। তারা আমাকে বলতেন, তারা কেবল ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোনো টেস্ট ম্যাচ জিতলেই মাথা উঁচু করে থাকতে পারতেন।'