ভারত ৫-০ বাংলাদেশ, ফের হোয়াইটওয়াশ শান্তরা
ফরম্যাট বদলেছে, ভেন্যু বদলেছে, ফরম্যাট বিবেচনায় খেলোয়াড়ও বদলেছে। ভারত সফরে বদলায়নি কেবল বাংলাদেশের ভাগ্য। চরম হতাশার ব্যাটিংয়ে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ হোয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ। টি-টোয়েন্টি সিরিজে ব্যাটিং হতাশাও আরও বাড়ে। আজ তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে আগের সব হতাশা যেন ছাপিয়ে গেল। হতশ্রী বোলিংয়ে রানচাপায় পড়ে বাংলাদেশ মেনে নিলো আরও একটি বড় হার। কয়েকদিনের ব্যবধানে নিতে হলো আবারও হোয়াইটওয়াশের তেতো স্বাদ। জয়হীন থেকেই ভারত সফর শেষ হলো নাজমুল হোসেন শান্তর দলের।
শনিবার হায়দরাবাদের রাজিব গান্ধী আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টিতে সূর্যকুমার যাবদের দলের বিপক্ষে ১৩৩ রানের বিশাল ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। রানের হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় হার। আগের বড় হার ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, ১০৪ রানে। ২-০ ব্যবধানে টেস্ট সিরিজ হারা সফরকারীরা টি-টোয়েন্টি সিরিজ হারলো ৩-০ ব্যবধানে। দুই বা তার চেয়ে বেশি ম্যাচের সিরিজে এ নিয়ে টি-টোয়েন্টিতে একাদশতম বারের মতো হোয়াইটওয়াশ হলো বাংলাদেশ। সংক্ষিপ্ততম এই ফরম্যাটে প্রতিপক্ষকে পাঁচবার হোয়াইটওয়াশ করেছে তারা।
আগে ব্যাটিং করতে নেমে বাংলাদেশের বোলারদের ওপর দিয়ে ঝড় বইয়ে দেন সেঞ্চুরিয়ান সঞ্জু স্যামসন ও সূর্যকুমার, রিয়ান পারাগ, হার্দিক পান্ডিয়ারা। এই কজনের ব্যাটে ২৯৭ রানের বিশাল সংগ্রহ গড়ে ভারত। যা টি-টোয়েন্টিতে তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ, এই ফরম্যাটের ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। বাংলাদেশের বিপক্ষে এটা কোনো দলের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। জবাবে আগের দুই টি-টোয়েন্টির চেয়ে বাংলাদেশ দ্রুত রান তুললেও সেটা যথেষ্ট হয়নি, লক্ষ্যের বেশ আগেই থেমে যায় সফরকারীরা। ৭ উইকেটে বাংলাদেশের ইনিংস হয় ১৬৪ রানে, এই সিরিজে এটাই তাদের সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ। হাফ সেঞ্চুরি করা তাওহিদ হৃদয় ও লিটন কুমার দাস ছাড়া কেউই রানের দেখা পাননি।
বিশাল লক্ষ্য তাড়ায় তেড়েফুঁড়ে শুরু করার চেষ্টা করে বাংলাদেশ, যদিও এই চেষ্টায় সফল হয়নি তারা। ইনিংসের প্রথম বলেই মায়াঙ্ক যাদবের বলে ক্যাচ তুলে বিদায় নেন পারভেজ হোসেন ইমন। শুরুতেই উইকেট হারালেও খেলার ধরনে পরিবর্তন আনেনি বাংলাদেশ। দ্রুত রান তোলার চেষ্টার করতে থাকেন তানজিদ হাসান তামিম ও অধিনায়ক শান্ত। যদিও দরকার অনুযায়ী ব্যাটিং করতে পারেননি তারা, বড় হয়নি এই জুটিও।
৩.১ ওভারে দলীয় ৩৫ রানে আউট হন তানজিদ, ১২ বলে ৩টি চারে ১৫ রান করেন তিনি। ষষ্ঠ ওভারে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে ভারতের উইকেটরক্ষক স্যামসনের হাতে ধরা পড়েন ১১ বলে একটি করে চার ও ছক্কায় ১৪ রান করা শান্ত। পাওয়ার প্লে ৬ ওভার থেকে ৫৯ রান তোলে বাংলাদেশ। পরের জুটিতে দলকে ঠিক পথে রাখেন লিটন কুমার দাস ও তাওহিদ হৃদয়। চতুর্থ উইকেটে ৩৮ রানের জুটি গড়েন এ দুজন। তাদের ব্যাটে ১১ ওভারে ৩ উইকেটে ১০৭ রান তোলে বাংলাদেশ।
২৫ বলে ৮টি চারে ৪২ রান করা লিটনের বিদায়ে ভাঙে এই জুটি। এরপর হৃদয় একাই যা লড়াই করেছেন, বাকিরা ছিলেন কয়েক বলের অতিথি। ৪২ বলে ৫টি চার ও ৩টি ছক্কায় ইনিংস সেরা ৬৩ রান করে অপরাজিত থাকেন হৃদয়। টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৯ বলে ৮ রান করেন। ভারতের লেঘ স্পিনার রবি বিষ্ণয় ৪ ওভারে ৩০ রানে ৩টি উইকেট নেন। ৪ ওভারে ৩২ রানে ২টি উইকেট নেন মায়াঙ্ক যাদব। একটি করে উইকেট পান ওয়াশিংটন সুন্দর ও নিতিশ কুমার রেড্ডি।
এর আগে ব্যাটিং করতে নামা ভারত দাপুটে শুরু করে। শেখ মেহেদি হাসানের করা ইনিংসের প্রথম ওভার থেকে তোলে ৭ রান। পরের ওভারে চলে চার-বৃষ্টি। আগের ম্যাচে দারুণ বোলিং করা তাসকিন আহমেদকে টানা ৪টি চার মারেন স্যামসন। ২ ওভারে ২৩ রান তোলা ভারত অবশ্য পরের ওভারেই হোঁচট খায়। তানজিম হাসান সাকিবের শর্ট বল তুলে মারতে গিয়ে শেখ মেহেদির হাতে ধরা পড়েন অভিষেক শর্মা।
প্রথম উইকেট হারানোর চাপ মুহূর্তের জন্যও বুঝতে হয়নি ভারতের। ম্যাচসেরা স্যামসন মারকুটে মেজাজেই ছিলেন, তার সঙ্গে যোগ দেন এই ফরম্যাটে 'খুনে মেজাজী' হিসেবে পরিচিত ভারতের অধিনায়ক সূর্যকুমার যাদব। মুহূর্তেই জমে ওঠে তাদের জুটি, দুজনই ব্যাট হাতে ঝড় তোলেন। হুহু করে বাড়তে থাকে ভারতের রান। স্যামসন-সূর্যকুমারের ব্যাটে পাওয়ার প্লে ৬ ওভার থেকে ৮২ রান তোলে ভারত।
স্বাগতিকদের দলীয় সংগ্রহ ১০০ ছাড়ায় ৭.১ ওভারেই। বাংলাদেশের সব বোলারদের উপর দিয়ে সাইক্লোন বইয়ে দেন ভারতের এই দুই ব্যাটসম্যান। প্রথম ওভারে ১৬ রান খরচা করা তাসকিন দ্বিতীয় ওভারেও দেন ১৬ রান। প্রথম ওভারে ১১ রান দিয়ে উইকেট নেওয়া তানজিম পরের ওভারে দেন ১৯ রান। সপ্তম ওভার করা রিশাদ খরচা করেন ১৬ রান।
আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের যে মাঠে 'ফিজ' হয়ে ওঠেন মুস্তাফিজুর রহমান, সেই মাঠেও আজ তিনিও সুবিধা করতে পারেননি। প্রথম দুই ওভারে ২৬ রান খরাচা করেন তিনি। বর্ণনাতেই পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বোলারদের ওপর দিয়ে কেমন ঝড় বইয়ে দিয়েছেন স্যামসন ও সূর্যকুমার। মাত্র ২২ বলে হাফ সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন স্যামসন, যা ভারতের হয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দ্রুততম।
সূর্যকুমারও সময় নেননি, ২৩ বলেই তুলে নেন ক্যারিয়ারের ২১তম হাফ সেঞ্চুরি। এর আগের ওভারে ছক্কা-বৃষ্টি নামান স্যামসন। দশম ওভারে বাংলাদেশের লেগ স্পিনার রিশাদকে টানা ৫ ছক্কা মারেন ডানহাতি এই ওপেনার। ১০ ওভারে ভারতের স্কোরকার্ডে যোগ হয় ১ উইকেটে ১৫২ রান, স্যামসন পৌঁছে যান তার টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির কাছে।
১৩তম ওভারের প্রথম বলে শেখ মেহেদিকে চার মেরে সেঞ্চুরিতে পূর্ণ করেন ভারতের এই ওপেনার। ৪০ বলেই স্যামসন পৌঁছান তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারে। তার সেঞ্চুরিটি টি-টোয়েন্টিতে ভারতের দ্বিতীয় দ্রুততম, ফরম্যাটটির ইতিহাসের দশম দ্রুততম। ভারতের পক্ষে দ্রুততম সেঞ্চুরির মালিক রোহিত শর্মা, ২০১৭ সালে ইন্দোরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৫ বলে সেঞ্চুরি করেন ভারতের সাবেক টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক।
সেঞ্চুরির পর বেশি পথ পাড়ি দেওয়া হয়নি স্যামসনের। ১৪তম ওভারে মুস্তাফিজকে তুলে মারতে গিয়ে টাইমিংয়ের গড়বড়ে ডিপ স্কয়ারে ধরা পড়েন ৪৭ বলে ১১টি চার ও ৮টি ছক্কায় ১১১ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেন ডানহাতি এই ওপেনার। এটাই তার টি-টোয়েন্টির ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস। দ্বিতীয় উইকেটে মাত্র ৭০ বলে ১৭৩ রানের জুটি গড়েন স্যামসন-সূর্যকুমার।
টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় উইকেটে এটা ভারতের দ্বিতীয় সেরা জুটি, যেকোনো উইকেটে তৃতীয় সেরা। স্যামসনের বিদায়ের পরের ওভারে থামেন সূর্যকুমার। এর আগে ৩৫ বলে ৮টি চার ও ৫টি ছক্কায় ৭৫ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলেন ভারত অধিনায়ক। এ দুজনের বিদায়ের পরও থামেনি ভারতের ব্যাটিং ঝড়। উইকেটে গিয়েই তাণ্ডব শুরু করেন রিয়ান পারাগ ও সিরিজ সেরা হার্দিক পান্ডিয়া। চতুর্থ উইকেটে মাত্র ২৬ বলে ৭০ রানের জুটি গড়েন এ দুজন।
পারাগ ১৩ বলে একটি চার ও ৪টি ছক্কায় ৩৪ ও হার্দিক ১৮ বলে ৪টি করে ৪ ও ছক্কায় ৪৭ রানের ক্যামিও ইনিংস খেলেন। ৪ বলে ৮ রানে অপরাজিত থাকেন রিঙ্কু সিং। পুরো ইনিংসজুড়ে বাংলাদেশের বোলারদের শাসন করে গেছেন ভারতের ব্যাটসম্যানরা। কোনো বোলারই ইকোনমি ১০ এর নিচে রাখতে পারেননি। তানজিম ৩টি উইকেট, কিন্তু ৪ ওভারে তার খরচা ৬৬ রান। যা বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে সর্বোচ্চ।
টি-টোয়েন্টিতে আগের খরুচে বোলিং ছিল মাশরাফি বিন মুর্তজা ও রুবেল হোসেনর, দুজনেরই খরচা ছিল ৬৪ রান করে। একটি উইকেট নেওয়া তাসকিন আহমেদ ৪ ওভারে দেন ৫১ রান। ৪ ওভারে সবচেয়ে কম ১১.২৫ ইকোনমিতে ৪৫ রান দেওয়া শেখ মেহেদি কোনো উইকেট পাননি। এক উইকেট নিতে ৪ ওভারে মুস্তাফিজের খরচা ৫২ রান। সবচেয়ে ২৩.০০ ইকোনেমিতে রান দেওয়া রিশাদ ২ ওভারে ৪৬ রানে থেকেছেন উইকেটশূন্য। ক্যারিয়ারের শেষ টি-টোয়েন্টি খেলতে নামা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ২ ওভারে ২৬ রানে একটি উইকেট পান।