ইংলিশ ক্রিকেটের মড়া-পোড়ানো ছাই এখন কোথায়?
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড প্রথম টেস্ট ম্যাচে মুখোমুখি হয় ১৮৭৭ সালে, মেলবোর্নে। তবে দেশ দুটির ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে দ্য অ্যাশেজ নামের প্রতীকি ট্রফির লড়াই শুরু হয় আরও কয়েক বছর পর, ১৮৮২ সালে।
১৮৮২ সালে প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট জেতে, তাও আবার ইংল্যান্ডের মাটিতেই, ওভালে আগস্টের শেষদিকে দুইদিন গড়ানো ম্যাচটিতে সাত রানে জয় তুলে নেয় অস্ট্রেলিয়া।
ইংল্যান্ডের লজ্জাজনক হারের চারদিন পর দ্য স্পোর্টিং টাইমস পত্রিকায় ইংরেজ ক্রিকেট নিয়ে বিদ্রুপাত্মক এক লেখা প্রকাশিত হয়। রেজিনাল্ড শারলি ব্রুকসের লেখাটির বিখ্যাত উক্তিটি ছিল-
'ইংলিশ ক্রিকেটকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে ওভালের ২৯ আগস্ট ১৮৮২ তারিখটি, মৃত্যু হয়েছে ইংলিশ ক্রিকেটের। গভীর দুঃখের সঙ্গে বন্ধুরা তা মেনে নিয়েছেন। ইংলিশ ক্রিকেটের মরা পোড়ানো ছাইগুলো চলে গেছে অস্ট্রেলিয়ায়।'
১৮৮২-৮৩ মৌসুমে ইংল্যান্ডের পরবর্তী অস্ট্রেলিয়া সফরে ইংলিশ অধিনায়ক আইভো ব্লাই এই 'ছাই' 'পুনরুদ্ধারের' শপথ নেন, সংবাদমাধ্যমগুলোতে এই সফরকে 'অ্যাশেজ পুনরুদ্ধারে যাত্রা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ওই সফরের সময়
মেলবোর্নের একদল নারী আইভো ব্লাইকে ছোট্ট একটি ছাই রাখার পাত্র দেয়, ওই পাত্রে ছিল বেইলের ভস্ম। সূত্রপাত হয় বিখ্যাত অ্যাশেজ সিরিজের।
আইভো ব্লাইকে দেওয়া ওই পাত্রটিকেই অনেকেই অ্যাশেজের ট্রফি ভেবে ভুল করেন অনেকে, মূলত এই পাত্রটির রেপ্লিকাই অ্যাশেজ সিরিজের ট্রফি হিসেবে দেওয়া হয়। মেলবোর্নে পাওয়া পাত্রটি ব্লাই ব্যক্তিগত উপহার হিসেবে নিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ফ্লোরেন্স মরফি মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব (এমসিসি) জাদুঘরে পাত্রটি দান করেন। তার স্ত্রী ফ্লোরেন্স কিন্তু মেলবোর্নের ওই নারী দলের একজন। প্রকৃত পাত্রটি কখনো সিরিজের ট্রফি হিসেবে দেওয়া হয়নি বা প্রদর্শনীতেও উঠেনি।
অ্যাশেজ শুরুর আগে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার ১৮ সিরিজের ১৩টিতে জয় ছিল ইংল্যান্ডের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর টানা আটটি সিরজ জেতে অস্ট্রেলিয়া। ১৯৩২-৩৩ সালের মৌসুমে ৪-১ এ সিরিজ জিতে আবারও 'অ্যাশেজ' পুনরুদ্ধার করে ইংল্যান্ড। তবে, ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এটিই ছিল ইংল্যান্ডের শেষ সিরিজ জয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর মহাপরাক্রমশালী হিসেবে আবির্ভূত হয় অস্ট্রেলিয়া। ১৯৪৮ সালের সফরে অধিনায়ক ব্রাডমানের দল একটি ম্যাচও হারেনি। ৪-০ তে জয় তুলে নেয়। ১৯৫৩ সালে এসে আবারও সিরিজ জেতে ইংল্যান্ড, এরপর টানা আরও দুটি।
১৯৫৮/৫৯ এর মৌসুমে অ্যাশেজ ফেরে অস্ট্রেলিয়ার ঘরে। ১৯৭০/৭১ এর মৌসুমে রে ইলিংওর্থের নেতৃত্বে আবারও অ্যাশেজ ছিনিয়ে নেয় ইংল্যান্ড। ছয়টি টেস্টের একটি বৃষ্টির জন্য বাতিল হওয়ায় যোগ হয় আরেকটি, সূত্রপাত হয় প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচের। ৭০ এর দশকে ক্রিকেট ইতিহাসে আরও চমক নিয়ে আসে দ্য অ্যাশেজ সিরিজ। ১৯৭৪/৭৫ এর মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার জেফ থমসন ও ডেনিস লিলির অধিনায়কত্বে ধূলিস্মাৎ হয় ইংল্যান্ড। ভাগ্যের পরিহাসই বোধহয়, একশো বছর আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তিই যেন দেখা যায়, ৪৫ রানে জয় পায় অজিরা। ১৯৭৭ সালে অবশ্য দ্য অ্যাশেজের শতবর্ষে দাঁড়িয়ে ৩-০ তে জয় তুলে নেয় ইংলিশরা। ১৯৭৯/৮০'র মৌসুমেই ৩-০ তেই সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়া।
১৯৮১ তে ০-১ এ পিছিয়ে থাকার পরও ইংলিশ অধিনায়ক ইয়ান বোথাম ও ফাস্ট বোলার বব উইলিসের নৈপুণ্যে ৩-১ এ সিরিজ জেতে ইংল্যান্ড। ১৯৮১/৮৩'র মৌসুমে ২-১ এ জিতে প্রতিশোধ নেয় অস্টেলিয়া। ২০০৫ সাল পর্যন্ত এটিই দুই দলের মধ্যে সবচেয়ে কম ব্যবধানে জয় ছিল।
৪-০ তে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে আশির দশকের ইতি টানে অস্ট্রেলিয়া। শুরু হয় অজিদের প্রভাব-প্রতিপত্তির সময়। ২০০৫ সাল পর্যন্ত সবগুলো সিরিজ জেতে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৫ সালে গিয়ে খরা কাটে ইংল্যান্ডের, ২-১ এ সিরিজ জেতে ইংলিশরা। ২০০৬-৭ ও ২০১৩-১৪ মৌসুমে ৫-০ ব্যবধানে ইংল্যান্ডকে হোয়াইট ওয়াশ করে অস্ট্রেলিয়া। ২০০৯, ২০১০/১১, ২০১৩ ও ২০১৫ মৌসুমে জয় পায় ইংল্যান্ড।
২০১৭/১৮'র মৌসুমে অজিদের সিরিজ জয়ের পয় অ্যাশেজ সিরিজে এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া, যদিও ব্যবধান মাত্র এক সিরিজের। মোট ৭১টি সিরিজের ৩৩টিতে জয় পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ৩২টিতে ইংল্যান্ড। বাকি ছয়টি সিরিজ ড্র।
চলতি অ্যাশেজ সিরিজে এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছে অস্ট্রেলিয়া। প্রথম দুই টেস্টেই জিতে সিরিজ জেতার পথেই হাঁটেছে হয়তো অজিরা।
মজার বিষয় হলো ব্লাইয়ের অস্ট্রেলিয়া সফরের পর প্রায় দুই দশক পর্যন্ত এই ঘটনা বিস্মৃত ছিল। ১৯০৩-৪ সালের মৌসুমে তৎকালীন ইংলিশ অধিনায়ক পেলহাম ওয়ারনার ওই সফর নিয়ে 'হাও উই রিকোভারড দ্য অ্যাশেজ' শিরোনামে একটি বই লেখার পর সিরিজটি চালু হয় আবারও। এরপর থেকেই অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ডের এই দ্য অ্যাশেজ টেস্ট সিরিজ চলে আসছে।