ক্রিকেট উপভোগ করছেন না সাকিব
বাংলাদেশ দলের প্রাণ ভোমরা তিনি। তাকে ঘিরে আবর্তিত হয় দলের পরিকল্পনা। সেই সাকিব আল হাসানই ক্রিকেট খেলাটা আর উপভোগ করছেন না। এমনকি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার মতো মানসিক ও শারীরিক অবস্থাও এই মুহূর্তে তার নেই বলে জানিয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডার।
রোববার দুবাইয়ের উদ্দেশে দেশ ছাড়ার আগে বিমানবন্দরে সাকিব জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যেতে চান না তিনি। এমন মানসিক অবস্থায় খেলতে গেলে সেটা দলের জন্য ক্ষতি হবে বলে মনে করেন তিনি। এ ছাড়া সব সময় চালকের আসনে থাকতে চাওয়া সাকিবের কাছে নিজেকে যাত্রী মনে হচ্ছে। তাই বিরতি চান তিনি। বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আরও অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলেন সাকিব। প্রশ্নোত্তর আকারে তা তুলে ধরা হলো-
কেমন আছেন?
সাকিব: ভালো।
কোথায় যাচ্ছেন?
সাকিব: দুবাই।
দুবাই কেন? দল যাবে ১২ তারিখ। আপনি আগে কেন?
সাকিব: তো কী হয়েছে? এটা কি প্রশ্ন কোনো (হাসি)?
আসল কাহিনী কী? দলের সঙ্গে যেতে পারতেন..
সাকিব: আমি আসব তো। দেশে ফিরে আবার দলের সঙ্গে যাব।
শুটিং আছে নাকি শাহরুখ খানের সঙ্গে?
সাকিব: ও রকমই একটা, দেখতে পারবেন।
দুবাইয়ে বিশ্বকাপ খেলার সময় রাজ পরিবারের একজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আপনাকে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে চাচ্ছে?
সাকিব: আমি তো ভেবেছিলাম আফগানিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে কথা হবে (হাসি)। আসলে দেখা তো হয়, আলাপ আলোচনাও হয়। সামনেরটা সামনেই দেখা যাবে। যদি হয় কিছু, সামনে জানা যাবে।
আফগানিস্তান সিরিজ কেমন কাটলো? নিজের মূল্যায়ন যদি করেন…
সাকিব: স্বাভাবিকভাবে আমার ব্যক্তিগত দিক থেকে চিন্তা করলে অবশ্যই হতাশাজনক। আমার নিজের প্রতি নিজের যে প্রত্যাশা, মানুষ যেভাবে প্রত্যাশা করে, বিসিবি যেভাবে প্রত্যাশা করে অবশ্যই ওভাবে করতে পারেনি। এ জন্য অবশ্যই আমি হতাশ।
দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে যেটা বলতে হয়, মানসিক ও শারীরিক যে অবস্থায় আছি, আমার কাছে মনে হয় না আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা সম্ভব খুব একটা। এই কারণে আমার মনে হয়, যদি আমি একটা বিরতি পাই, আমি যদি ওই আগ্রহটা ফিরে পাই, তাহলে আমার খেলাটা সহজ হবে। কারণ আফগানিস্তান সিরিজে আমার কাছে মনে হয়েছে আমি একজন যাত্রী, যেটা আমি হয়ে কখনোই হয়ে থাকতে চাই না। আমি খেলাটা একদমই উপভোগ করতে পারিনি। পুরোটা সিরিজটাই, টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু হয়নি। আমার মনে হয় না এ রকম মন মানসিকতা নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় সিরিজ খেলাটা ঠিক হবে। আমি এই কথা জালাল ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করেছি। জালাল ভাই বলেছেন, দুদিন উনিও চিন্তা করবেন। আমাকে চিন্তা করার সময় দিয়েছেন। তারপর একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বা উচিত বলে আমি মনে করি।
যেটা বললাম, এখন পর্যন্ত যেটা আমার কাছে মনে হচ্ছে এ রকম যদি আমার মন মানসিকতা থাকে, ফিজিক্যাল কন্ডিশন থাকে, মেন্টাল কন্ডিশন থাকে, এটা দলের জন্যই ক্ষতি হবে। যেটা আগেও বললাম আমি যেটা নিজে মনে করি, আমার নিজের প্রতি নিজের যে সম্মান, মানুষ যেটা প্রত্যাশা করে, যে ধরণের পারফরম্যান্স আশা করে, সেটা যদি আমি করতে না পারি, সেখানে আসলে যাত্রী হয়ে থাকাটা আসলে খুবই দুঃখজনক হবে। সতীর্থদের সঙ্গে চিট করার মতোই একটা ব্যাপার হবে বলে মনে করি।
তাহলে কি দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ খেলতে চাচ্ছেন না?
সাকিব: এটা আসলে সিদ্ধান্তের ব্যাপার। পাপন ভাইয়ের (বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন) সঙ্গে কথা বলার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পুরো সিরিজটাই খেলতে যাব। এ জন্যই আমার নাম অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু আমার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা যেভাবে দেখছি বা আমার কিছু সময় দরকার বলে মনে করি। সেটা এমন হতে পারে ওয়ানডে সিরিজটা ব্রেক নিয়ে যদি টেস্ট সিরিজটা খেলতে পারি, তাহলে ভালো মানসিক ও শারীরিক কন্ডিশনে থাকতে পারব। এগুলো আসলে সব কিছুর আলোচনার ওপর নির্ভর করবে কী করলে ভালো হয়। আমার বর্তমান পরিস্থিতি এটা।
যদি এই পরিস্থিতিতে খেলতে যাই, সতীর্থ ও দেশের সঙ্গে চিট করার মতো বিষয় হবে। যেই জিনিসটা অবশ্যই আমি চাই না। আমি চাই যে, যখন আমি খেলব, মানুষ যেভাবে প্রত্যাশা করে, আমার নিজের প্রতি নিজের যে প্রত্যাশা, দল আমাকে যেভাবে চিন্তা করে, সেভাবে যেন পারফর্ম করতে পারি সেই অবস্থায় গিয়ে। হ্যাঁ, কোনো গ্যারান্টি নেই যে যখন খেলতে নামব, তখন পারফর্ম করতে পারব ভালো পরিস্থিতিতে থাকলেও। অন্তত আমি জানতে পারব যে আমি আমার সেরা সময়ে আছি দেশের হয়ে পারফর্ম করতে। কিন্তু আমি যদি জানিই যে, আমার কোনো সম্ভাবনা নেই, সেখানে সময় নষ্ট করা, অন্য একটা জায়গা নষ্ট করা এবং দেশের ক্রিকেটের সঙ্গে গাদ্দারি করার মতো বিষয় বলে মনে করি।
টানা খেলার কারণে এটা হচ্ছে?
সাকিব: টানা খেলা বলব না, বর্তমানে আমার ক্যারিয়ার যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখানে আমার লম্বা একটা পরিকল্পনা দরকার।
দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টও খেলতে চান না?
সাকিব: এটা নিয়ে আরেকটা বিষয় আছে। মিডিয়া থেকেই জেনেছি, বোর্ডে আমি যে চিঠিটা দিয়েছি ছয় মাসের জন্য, এটা কখনোই ছয় মাসের ছিল না। এটা এই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত। মাঝ নভেম্বর পর্যন্ত। আমি এই সময়ে কোনো টেষ্ট খেলব না। আমি ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে মনোযোগ দেব। কারণ পরপর দুটি বিশ্বকাপ আছে। ওই জায়গায় আমি মনোযোগ দিতে চাচ্ছিলাম। আমার কাছে বিশ্বাস ছিল এই দুটি বিশ্বকাপে বড় কিছু করা সম্ভব। এ কারণে পুরোটা মনোযোগ সেদিকে দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু এটার মানে এই না যে আমি টেষ্ট ক্রিকেট একবারেই ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলাম।
যেহেতু টেস্ট ক্রিকেটে দলের একটা ভারসাম্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে, এখন আমার কাছে মনে হয়েছে আমি যদি এই মুহূর্তে সাদা বলে মনোযোগ দেই, সবকিছু চিন্তা করে আমার বয়স, ক্যারিয়ার, কিছু ফিজিক্যাল ফিটনেস নিয়ে, তাহলে হয়তো ভালো করতে পারতাম। একটা সমস্যা হচ্ছে, আমি জানি না যে আমার সামনে কী আছে। সিরিজ ধরে ধরে আমার জন্য পরিকল্পনা করা কঠিন। আমি যদি পুরো বছরের পরিকল্পনা জেনে যেতে পারতাম বা জেনে যেতে পারি, আমার জন্য অবশ্যই সেটা ভালো হবে। আমি আমার মতো করে পরিকল্পনা করতে পারব। আমার নিজস্ব পরিকল্পনা, পারিবারিক পরিকল্পনা, অন্য যে কোনো কিছু, আমার ব্যক্তিগত জীবনও কিংবা ক্রিকেট ক্যারিয়ার দুটি দিক থেকেই ভালো হতো। এই বিষয়গুলো পরিস্কার থাকাটা খুব জরুরি। আবারও বলছি ওইটা ছয় মাসের কখনই ছিল না। যদি চিঠিটা আপনাদের কাছে আসে, অবশ্যই দেখতে পারবেন। খুব সম্ভবত ২২ নভেম্বর বা বিশ্বকাপ শেষ হওয়া পর্যন্ত টেস্ট খেলব না এমন কিছু।
আপনি বললেন চিঠি দিয়েছেন, তারপরও যোগাযোগে ঘাটতি। ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা হতে পারতো। কথা হতে পারতো…
সাকিব: কথা হয়েছে। নিয়মিতই কথা হয়েছে। কোনটা খেলব না খেলব। আসলে এই দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়েই বেশি কথা হয়েছে। বাকিগুলো নিয়ে এতো বেশি কথা হয়নি। আমার জন্য গুরুত্বপূ্র্ণ যে, জানা জরুরি সামনের এক মাস বা ছয় মাস কী করছি। সব সময় এ রকম ক্যালেন্ডারই তো তৈরি হয়। সেটা জানতে পারলে আমার জন্য পরিকল্পনা করতে সহজ হতো।
চিঠি দিয়েছেন বললেন, আনুষ্ঠানিক কোনো কথা হয়েছে?
সাকিব: আমি চিঠি দিয়েছি, কিন্তু বলিনি যে ওয়ানডে সিরিজ খেলবে না বা টেস্ট খেলব না। যেভাবে পরিস্থিতিটা বললাম সেটাই আমি নিজের অবস্থান আসলে জানিয়েছি জালাল ভাইকে (ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের চেয়ারম্যান)। উনি বলেছেন, ''তুমিও দুদিন চিন্তা করো।" উনারাও করুক। তারপর হয়তো আলোচনা করে কোনো একটা সিদ্ধান্ত আসবে।
তাহলে কি ওয়ানডে খেলতে চাচ্ছেন না?
সাকিব: আমি আসলে যেটা বললাম, আমি খুব খোলা মনে আছি। এখন আমি ক্রিকেট খেলার পরিস্থিতিতে নেই। আমি ওই পরিস্থিতিতে যখন আসব, তখন অবশ্যই চাইব, ক্রিকেট খেলব।সব কিছুই নির্ভর করছে বিসিবি ও আমার দুই জায়গা থেকে আলোচনার মাধ্যমে সুন্দর পরিস্থিতি তৈরি করা। যেখানে গেলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভালো হবে। আমার জন্যও ভালো হবে।
একটু পরিস্কার হওয়ার জন্য জানতে চাওয়া, আপনি বললেন যে প্রস্তুত হওয়ার জন্য সময়ের প্রয়োজন। এটা তো দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজে। এটা কি শ্রীলঙ্কা সিরিজেও হতে পারে?
সাকিব: শ্রীলঙ্কা সিরিজ, আসলে আমার জন্য বলা কঠিন। আসলে দুই মাস পর কী চিন্তা হবে সেটা এখন বলাটা কঠিন। এমনও হতে পারে আমি ওয়ানডে সিরিজটা ব্রেক দিয়ে টেস্ট সিরিজটাও খেলতে পারি। ১৫-২০ দিনের ব্রেক আমার জন্য অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। দুই মাস পরেরটা আমারটা বলা কঠিন যে আমি কোন মানসিকতায় থাকব বা ফিটনেসে কোন অবস্থায় থাকব। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ যে বোর্ডকে জানানো আমি কোন অবস্থায় আছি।
বিপিএল নিয়ে নাজমুল হাসান বলেছেন, বিপিএল তিন নম্বরে…
সাকিব: আসল কথা হচ্ছে, এটা কি কোনো প্রশ্ন করার জিনিস বোর্ড প্রেসিডেন্টকে আমি কী বলেছি তাকে জানানো? একজনের মতামত থাকতেই পারে। এটা নিয়ে আবার পাপন ভাইকে জিজ্ঞেস করা, এটাই তো হাস্যকর মনে হয়।
লম্বা সময় ধরে খেলা, বায়ো বাবলে থাকার ব্যাপার আছে। এখন সবার সঙ্গে কথা বলা জরুরী কিনা যে কে কোনটা খেলবে?
সাকিব: অনেকেরই হতে পারে। আমাদেরকে দিয়ে দিতো যে কার কোনো ফরম্যাটে খেলতে ইচ্ছা আছে, কোনটায় ইচ্ছা নাই। যেমন আপনি দেখেন, মুস্তাফিজ বলেছে যে টেস্ট খেলবে না, বিরতিতে আছে যতদিন বায়ো বাবল থাকছে। ওরটা ও আরও ভালো বলতে পারবে। এ রকম যদি সবার কাছে অপশনটা দিয়ে দেওয়া যায়, সবার মতামত নেওয়া হয় কিংবা বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আমার জন্য মনে হয় এটা সবার জন্য ভালো।
গতবার তো সবার জন্য করা হয়েছিল…
সাকিব: এবার আসলে হয়নি এখনও। ওই ফর্মটা পাইনি যেখানে জানাবো যে, আমি টেস্ট, ওয়ানডে বা অন্যকিছু কেলতে চাই।
কবে নাগাদ আপনার সিদ্ধান্তটা আসতে পারে?
সাকিব: জালাল ভাই বলেছেন যে, ''তুমি দুদিন চিন্তা করো।" উনিও চিন্তা করবেন। উনিও হয়তো কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর হয়তো আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গেলে কি আবার ফিরে আসবেন?
সাকিব: যেতে হলে তো যেতে হবে। আমি সব কিছুর জন্য খোলা আছি। আমার মানসিক ও শারীরিক অবস্থা সেরা পারফর্ম করা মতো অবস্থায় নেই। এই জিনিসিটা বোর্ডকে জানিয়েছি।
আপনি দেশের ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন। বিশ্বের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। এসব কর্থাবার্তা যখন হয়, আপনি কি যোগ্য সম্মান পান?
সাকিব: যেটা হচ্ছে যে, আমি পরিস্কার থাকতে চাই। অনেক সময় দেখা যায় আগাম ধারণার থেকে মিস লিডিং কিছু তথ্য মানুষের কাছে যায়। এতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। আমি পরিষ্কার থাকতে চাই, এ জন্য পরিষ্কার করে গেলাম।