বালু তোলা শ্রমিক ছেলেটি ব্রাজিল যাচ্ছে প্রশিক্ষণ নিতে
বাবার কষ্টের সংসার, তিন বেলা খাওয়াই সেখানে রীতিমতো প্রশান্তির ব্যাপার। এমন পরিবারের সদস্য হয়ে ফুটবল খেলাটা বিলাসিতার মতোই ছিল রনি মিঁয়ার জন্য। তবু ভালোবাসার টানে ফুটবল খেলতে চলে যেত রনি। কিন্তু বুট কেনার টাকা ছিল না, ছিল না কোনো সুযোগ সুবিধা। যেন স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে নদী পাড় হওয়া!
তবুও থামে না রনি, দৃষ্টি তার বহুদূরে। সুযোগ হয় বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) লেখপড়া করার। এখানেও বিপত্তি, বেতন দিতে না পেরে থেমে যায় বিকেএসপি অধ্যায়। সংগ্রাম চালিয়ে যায় রনি, ফুটবল পায়েই স্বপ্ন বুনতে থাকে হবিগঞ্জের এই কিশোর ফুটবলার। এর মাঝে ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমনের নজরে পড়ে সে। তাতেই বদলে যায় রনির ভাগ্য, উন্নত প্রশিক্ষণ নিতে রোনালডো, রোনালদেনিহো, নেইমারদের দেশ ব্রাজিলে যাচ্ছে সে।
২০১৮ সালে ঢাকায় নিযুক্ত ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূত জোয়াও তাবাজারা দ্য অলিভিয়েরা জুনিয়র বাংলাদেশ থেকে কিশোর ফুটবলারদের প্রশিক্ষণের জন্য ব্রাজিলে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। তার সহযোগিতা ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের চেষ্টায় ২০১৯ সালে প্রথমবারের মতো চারজন কিশোর ফুটবলার ব্রাজিলে প্রশিক্ষণ নেয়। এবার দ্বিতীয়বারের মতো ১১ জন যাচ্ছে ব্রাজিলে। তাদের মধ্যে একজন রনি।
বৃদ্ধ বাবা তৈয়ব আলী পাহাড় থেকে কাঠ কেটে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। বাবার এই কষ্ট সহ্য না করতে পেরে নদীতে বালু তোলার মেশিনে কাজ নেয় রনি। এর আগে সাভারের বিকেএসপিতে ভর্তি হলেও বেতন দিতে না পারায় বিকেএসপি ছাড়তে হয় তাকে তাকে।
বিকেএসপি ছাড়লেও ফুটবল ছেড়ে থাকতে পারেনি রনি। কাজের ফাঁকে এলাকায় বিভিন্ন ফুটবল টুর্নামেন্টে নিয়মিত অংশ নিত রনি। তেমনই এক টুর্নামেন্টে রনির খেলা দেখে চোখ আটকে যায় ব্যারিষ্টার সুমন। রনিকে নিয়ে এসে নিজের ফুটবল একাডেমিতে ভর্তি করে দেন তিনি।
একাডেমিতে নাম লেখানোতেও ছিল বাধা। বড় ভাইকে বিদেশ পাঠাতে রনির বাবা জমি বন্ধক রেখেছিলেন। সেই টাকা পরিশোধ করতে রনির আরেক ভাই রাজমিস্ত্রির কাজ নেন। রনি বালু তুলতো। ফুটবল খেললে টাকা উপার্জনের পথ থাকবে না, পরিবারের সমস্যা বাড়বে। ব্যারিস্টার সুমনকে এসব জানিয়ে দেয় রনি।
সবকিছু শুনে রনিকে এক লাখ টাকার চেক দেন সুমন। সেই টাকা দিয়ে রনিদের বন্ধকি জমি ছাড়ানো হয়। পাশাপাশি সুমনের একাডেমিতে খেলার সুযোগ হয় রনির। এই একডেমিতে তিন বছর ধরে খেলছে সে। গত বছর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনূর্ধ্ব-১৭ গোল্ডকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয় সিলেট বিভাগ। সেই দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার ছিলো রনি মিঞা।
সর্বশেষ সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলার সেরা ফুটবলার নিয়ে গড়া হয় বিভাগীয় দল। সেখানে জায়গা পায় রনি। এরপর দেশের ৮ বিভাগ থেকে সেরা ৪০ ফুটবলারের মধ্য থেকে ব্রাজিল সফরের জন্য ১১ জনকে বাছাই করা নেওয়া হয়। সেই বাছাইয়েও জায়গা করে নেয় রাইটব্যাক হিসেবে খেলা রনি।
ব্রাজিলে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ পাওয়ার পর সংবাদমাধ্যমকে রনি বলে, 'কখনও ভাবিনি যে ফুটবলে ফিরতে পারব। আমাদের অভাবের সংসার। অথচ ফুটবল খেলতে পেলে-নেইমারদের দেশে যাচ্ছি। কী যে ভালো লাগছে, তা বলে বোঝানো যাবে না।' বর্তমানে ব্যারিস্টার সুমনের ফুটবল একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি চুনারুঘাট কাচুয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে রনি।