অন্যরকম ভালোবাসা
২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যা। ময়মনসিংহ শহরের বদরের মোড় দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন আনোয়ারা বেগম। হঠাৎ চোখে পড়লো শতবর্ষী এক বৃদ্ধা রাস্তায় পড়ে আছেন। আশেপাশে খুঁজে তার সঙ্গের কাউকে না পেয়ে চিন্তায় পড়ে গেলেন আনোয়ারা। এমনিতে সন্ধ্যা, তার ওপর বৃষ্টি এমন বৈরি আবহাওয়ায় একজন বৃদ্ধাকে নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন তিনি।
হাত দিয়ে ইশারা করে তাকে কিছু বলতে চাইছেন ওই বৃদ্ধা। দেখে মায়া হলো আনোয়ারার। কাছে গেলেন। কিন্তু বৃদ্ধা কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু জানালেন, তার নাম চারুবালা চক্রবর্তী। দুর্বল শরীরের কারণে তিনি চলাফেরাও করতে পারছেন না।
এরমধ্যেই ভিড় জমে গেছে আশেপাশে। সবাই তাকে দেখে আফসোস করলেও তার সাহায্যে কেউ-ই এগিয়ে আসেনি।
এরপর একটি রিকশা ডেকে বৃদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন আনোয়ারা। খুঁজতে থাকলেন চারুবালার স্বজনদের। কিন্তু অনেকক্ষণ ঘুরেও কোনো লাভ হলো না। শেষ পর্যন্ত শহরের নৌমহল এলাকায় তাকে নিজ বাড়িতেই নিয়ে গেলেন আনোয়ারা।
বাড়িতে নিয়ে প্রথমে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলো। দেওয়া হলো পুষ্টিকর খাবার। আর সেদিন থেকেই আনোয়ারার বাড়িতে রয়ে গেলেন চারুবালা চক্রবর্তী।
নিয়মিত তার সেবা করেন আনোয়ারা। কিছুদিন পর মেলে বৃদ্ধার স্বজনদের খোঁজ। শহরের নাটকঘর লেন এলাকায় বৃদ্ধার বাড়ি। এক ছেলে ও এক মেয়ে আছে চারুবালার। কিন্তু তারা কেউ-ই তাদের মাকে ফেরত নিতে রাজি হয়নি। আনোয়ারা জানতে পারেন, সন্তানরাই তাদের মাকে সেদিন রাতে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল।
সাত বছর কেটে গেছে। চারুবালা এখনও থাকেন আনোয়ারার বাড়িতে। বয়স ১০০ ছুঁই ছুঁই। এখন তিনি আগের থেকে অনেক সুস্থ। কথাও বলতে পারেন অল্প অল্প। তবে নিজ হাতে খেতে পারেন না। মাঝে মাঝেই বিছানা নষ্ট করে ফেলেন। আনোয়ারা নিজে সেগুলো পরিষ্কার করেন।
কথা হয় আনোয়ারা সঙ্গে। তিনি বলেন, গত সাত বছরে বৃদ্ধার কোনো সন্তানই তাকে দেখতে আসেনি। জন্মদাতা মা, যিনি ছোট থেকে বাচ্চাদের লালন-পালন করে মানুষ করেছেন তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়াটা খুবই অমানবিক। বিষয়টি আমার খারাপ লেগেছে। তাই আত্মউপলব্ধি থেকে তাকে আমার বাড়িতে নিয়ে এসেছি। আমরা দু’জনই একে অপরকে মা বলে ডাকি।
তিনি আরও বলেন, উনি প্রায়ই বিছানা নষ্ট করে ফেলেন। সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য একজন লোক রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি।
ভিন্ন ধর্মের একজন মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘উনি ভিন্ন ধর্মের অনুসারী তাতে কী। আমরা সবাই মানুষ। আগে মানুষ, পরে ধর্ম। মানুষ যদি বেঁচেই না থাকে তবে ধর্ম দিয়ে কী হবে। মানবতার প্রতি ভালোবাসার টানেই আমি তার সেবা করছি।’’
যে সন্তানদের জীবনের সবটুকু দিয়ে ভালবেসে বড় করেছেন সে সন্তানরাই তাকে রাস্তায় ফেলে গেছেন। সেদিনকার কথা মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন চারুবালা। কিন্তু তবু সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন তিনি। সন্তানদের মঙ্গল কামনা করে তিনি বলেন, ‘‘সৃষ্টিকর্তা যেন ওদের ভালো রাখে। সময়মতো যেন ওরা খাবার খেতে পারে। খুব ইচ্ছে করে ওদের দেখতে।’’
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আকিকুল ইসলামের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। তাদের দুই সন্তান রয়েছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ও মেয়ে চিকিৎসক।
আকিকুল ইসলাম বলেন, প্রথমে আমরা আনোয়ারার কাজকে সমর্থন না দিলেও বৃদ্ধার প্রতি তার ভালোবাসা দেখে মেনে নিয়েছি। অন্যদের মতো বৃদ্ধা চারুবালাও এখন আমাদের পরিবারের একজন।