আইসোলেশন সেন্টারে রঙহীন, প্রাণহীন ঈদ
পবিত্র ঈদুল ফিতরকে প্রাণহীন, রঙহীন করে দিয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। আর আইসোলেশন সেন্টারে এই ঈদ যেন আরও বেশি বিবর্ণ। নেই কোনো আমেজ, নেই কোনো আয়োজন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নিয়েই প্রিয়জনবিহীন ঈদ উদযাপন করছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। জীবনে এমন ঈদ আসবে, সেটি কল্পনাও করেননি তারা। তবুও দেশমাতৃকার টানে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন করোনা যোদ্ধারা।
সাকিব হাসান ধ্রুব করোনা যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনের একজন যোদ্ধা। বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ৩৯তম ব্যাচের স্বাস্থ্য ক্যাডারের এই কর্মকর্তার বাবা একজন প্রকৌশলী আর মা সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। একমাত্র বোনও চিকিৎসক। সাকিবের পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার রামরাইল ইউনিয়নের সুহাতা গ্রামে। কিন্তু তারা এখন ঢাকার কাঁঠালবাগান এলাকায় বসবাস করেন।
ঈদের দিনেও প্রিয়জনদের ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। সাধারণত ঈদের দিনের শুরুটা হয় মায়ের হাতে তৈরি সেমাই খেয়ে। এরপর বাবার সঙ্গে জায়নামাজ নিয়ে মাঠে যান নামাজ পড়তে। ফিরে এসে খাওয়া-দায়াও করে জম্পেশ আড্ডাও দেন বন্ধুদের সঙ্গে। এবারের ঈদটা তার জন্য একটু 'স্পেশাল' ছিল। কারণ মাত্র দেড় মাস আগেই বিয়ে করেছেন সাকিব। স্ত্রীকে নিয়ে ঈদের অনেক পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে সবকিছুই ভেস্তে গেছে।
ডা. সাকিব হাসান ধ্রুব বলেন, ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মায়ের হাতের সেমাই খেয়ে, বাবার সঙ্গে নামাজে যেতাম। বাসায় অনেক মেহমান আসতেন। তাদের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিতাম। কিন্তু এবার আর সেটা করতে পারলাম না। গতকাল (রোববার) রাত থেকে আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছি। আমার সঙ্গে একজন নার্সও দায়িত্ব পালন করছেন। আজকে ঈদের নামাজও পড়তে পারিনি। মায়ের হাতের সেমাইও খাওয়া হয়নি। করোনা রোগীদের সঙ্গেই ঈদ কাটছে। ঈদের দিনে প্রিয়জনদের ছেড়ে আইসোলেশন সেন্টারে পড়ে আছি। গতকাল রাত থেকেই পরিবারের জন্য কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু করোনা রোগীদের দিকে তাকিয়ে, সেই কষ্ট ভুলে থাকছি। সবমিলিয়ে বিবর্ণ ঈদ কাটাচ্ছি যেন।
তিনি বলেন, আজপর্যন্ত করোনা আক্রান্ত ১৭ জন রোগী আইসোলেশনে রয়েছেন। সকাল ৮টা থেকে আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালন করছি, এখানে ঈদের কোনো আমেজ নেই। একেবারেই প্রাণহীন-রঙহীন এক ঈদ। রোগীদের মনে যেমন আনন্দ নেই, তেমনি আমাদেরও একই অবস্থা। সকালে আমাদের জন্য চালের রুটি, ডিম, সবজি ও সেমাই দেয়া হয়েছে। আর রোগীদের দেয়া হয়েছে সেমাই, দুধ, মাল্টা, রুটি ও ডিম। দুপুরের খাবারে দেয়া হয়েছে মোরগ-পোলাও। খাবারের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু বাড়ির লোকজনদের জন্য খুব খারাপ লাগছে। সকালে ভিডিওকলে বাবা-মা ও স্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এমন ঈদ উদযাপন করতে হবে সেটা কখনও ভাবিনি। রোগীদের কথা চিন্তা করে, আমি নিজেই ঈদের দিন আইসোলেশন সেন্টারে দায়িত্ব পালনের জন্য ঊর্ধ্বতনদের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছি। এই ঈদ আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। পরিবারের কাউকে কাছে না পেলেও, রোগীদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। তারাও তো পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারছেন না। সকাল থেকে কয়েকজন সহকর্মী এসে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমাদের ঊর্ধ্বতনরাও সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছেন। এভাবেই ঈদের দিন কাটছে আমাদের।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের ৩৯তম ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা ডা. ইনজামামুল হক সিয়াম নিজেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কয়েকদিন আগে তিনি সুস্থ্ হয়েছেন। কিন্তু, নিজের সহকর্মীকে উৎসাহ দিতে, ঈদের দিন সকালেই ছুটে গেছেন আইসোলেশন সেন্টারে। দীর্ঘক্ষণ সহকর্মীর সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন তিনি।
ডা. ইনজামামুল হক সিয়াম বলেন, করোনা মানেই মৃত্যু নয়। কিন্তু অবহেলা করলেও চলবে না। করোনা যুদ্ধে জয়ী হতে আমাদের মানসিকভাবে চাঙা থাকতে হবে। ঈদের দিনও আমার সহকর্মীরা পরিবার ফেলে দায়িত্ব পালন করছেন। আমরা সবাই মিলে এই যুদ্ধে লড়ব এবং জয়ী হব।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রোববার পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ১০০ জন। এদের মধ্যে মারা গেছেন দুইজন। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৫৭ জন। প্রতিদিনই নতুন করে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সর্বশেষ গতকাল রোববার নতুন করে চারজন আক্রান্ত হয়েছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ একরাম উল্লাহ বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নতুন চিকিৎসকদের নিয়োগ দিয়েছে সরকার। নবীন হয়েও তারা যেভাবে দায়িত্ব পালন করছে, সেটি ইতিবাচক এবং প্রশংসনীয়। ঈদের দিনেও পরিবার ফেলে আইসোলেশন সেন্টারে আন্তরিকভাবে সেবা দিচ্ছে তারা। আমরা সার্বক্ষণিক তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং তাদেরকে উৎসাহ দিচ্ছি।