আম্পান কেড়েছে মাছের ঘের, ভেঙেছে ঘর, করেছে সর্বশান্ত
অন্যের পুকুর ভাড়া নিয়ে মাছ চাষের ঘের বানিয়েছিলেন বরগুনা সদর উপজেলার নিশানবাড়িয়া গ্রামের সেলিম মিয়া। ওই একটি মাছের ঘের ঘিরে অনেক স্বপ্ন ছিল তার। মাছ চাষের অল্প বিস্তর কিছু প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন।
ঘের তৈরি, পোনা ক্রয় এবং মাছের খাবারের জন্য ইতোমধ্যেই ধার-দেনা করে লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছেন দরিদ্র সেলিম মিয়া। আর ক'টা দিন গেলেই মাছ বিক্রি করে দু'লাখ টাকারও বেশি আয় হতো তার। কিন্তু সেই স্বপ্ন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে গেল ঘূর্ণিঝড় আম্পান।
শুধু মাছের ঘের নয়, আম্পান কেড়ে নিয়েছে তাদের সুদীর্ঘ কাল ধরে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও!
১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত পেয়ে বাবা-মা আর দু'টি গরুসহ গত বুধবার আশ্রয় কেন্দ্রে যান সেলিম মিয়া। রাতভর আম্পানের তাণ্ডব শেষে বৃহস্পতিবার সকালে বাবা-মাকে নিয়ে যখন বাড়ি ফেরেন, তখন তাদের বসত ঘরটিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় খুঁজে পান।
কান্না জড়িত কণ্ঠে সেলিম মিয়া বলেন, 'অন্যের পুকুরে ঘের বানিয়ে মাছ চাষ করেছিলাম। আশা ছিল- এবার মাছ বিক্রি করে পুরাতন ঘরটি নতুন করে সংস্কার করব। কিন্তু আমার সবকিছুই শেষ করে দিলো আম্পান। আমি নিজে কষ্ট করে কোথাও না কোথাও থাকাতে পারব, কিন্তু বৃদ্ধ মা-বাবাকে এখন কোথায় রাখব?'
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক সময় আর্থিক অবস্থা ভালোই ছিল সেলিম মিয়ার বাবা হাসেম মিয়ার। কিন্তু একের পর এক ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি বিষখালী নদীর অব্যাহত ভাঙনে সর্বশান্ত হয়েছেন তিনি।
বৃদ্ধ হাসেম মিয়া বলেন, 'আমার অনেকগুলো গরু-মহিষ ছিল। জমি ছিল প্রায় ১২ একর। ঝড়ঝঞ্জা থেকে মুক্ত থাকতে শক্ত করে তুলেছিলাম ঘরও। কিন্তু এসব এখন কিছুই নেই। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং এর ফলে সৃষ্ট নদী ভাঙনে আমার সবকিছু নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।'
সেলিম মিয়ার বৃদ্ধ মা রেনু বেগম বলেন, 'কাঠের ঘর, অনেক পুরান হয়ে যাওয়ায় টিন কাঠ সব আলগা হয়ে গিয়েছিল। তাই একটু হাওয়া এলেই নড়বড় করত। ঘূর্ণিঝড় আম্পান আমাদের মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকুও কেড়ে নিল।'
তিনি বলেন, 'সেলিম অল্প টাকায় মানুষের সঙ্গে কাজ করে। ও কি আর ঘর তুলতে পারবে? আমরা এখন কোথায় থাকব?'
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিষখালীর কোল ঘেঁষে নদী তীরবর্তী এই এলাকার দুই কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ অনেক আগেই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। গত বছর চরম ঝুঁকিপূর্ণ এক কিলোমিটার এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাঁচ শতাধিক পরিবারের বসতি এরকম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায়। প্রত্যেকেই ঝড় ঝঞ্জায় শঙ্কিত থাকেন। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ছুটে বেড়ান আশ্রয়ের সন্ধানে। সিডরে গণকবর রচিত হয়েছিল এই এলাকারই মৃত বাসিন্দাদের।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুস সাত্তার বলেন, 'এখান থেকে বিষখালী নদীর ওপারে পাথরঘাটার কালমেঘায় ব্লক দিয়ে দিয়ে নদীভাঙন রোধ করা হয়েছে। আমরা দাবি করেছিলাম- একটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত করা হোক এই এলাকায়। সিডরে সাইক্লোন শেল্টার দূরে হওয়ার কারণে পথেই ভেসে গেছে মানুষ, তৈরি হয়েছিল গণকবর।'
তিনি বলেন, 'প্রতি বছর গণকবরে নির্দিষ্ট দিবসে বরগুনা প্রেসক্লাব এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ঘটা করে পুস্পস্তবক অর্পণসহ দোয়া অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু জীবিত লোকজনের জন্য নির্মিত করা সম্ভব হয়নি একটি সাইক্লোন শেল্টারও। বর্তমান পরিস্থিতিতে জনস্বার্থে অত্র এলাকায় একটি সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করা জরুরি।'
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আমীর হোসেন বলেন, 'প্রায় দুইযুগ ধরে ভাঙছে বরগুনা সদর উপজেলার বিষখালী নদীর তীরবর্তী আজগরকাঠি, নলটোনা, আমতলা নিশানবাড়িয়া এলাকা। ইতোমধ্যে কয়েক হাজার পরিবার ভিটেমাটি হারিয়েছে। নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসলি জমি। এছাড়া ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নিঃস্ব হচ্ছে এখানকার মানুষ।'
তিনি বলেন, 'সদর উপজেলার ১০নং ইউনিয়নের ২নং ব্লকের প্রত্যেকটি পরিবারের বাড়ি একাধিকবার ভেঙে গেছে। বাকি পরিবারগুলোর বাড়ি-ঘর প্রচণ্ড হুমকির মুখে। আবহাওয়া অধিদপ্তর বন্যার খবর প্রচার করার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাগ-বোঁচকা বেঁধে দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ান এখানকার মানুষ। এখানে দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র তো দূরের কথা, একটি পাকা বাড়িও নেই।'
সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ নেওয়াজ সেলিম বলেন, 'ঘূর্ণিঝড়ের পর আমি ওই এলাকা ঘুরে দেখেছি। সেলিম মিয়াদের বাড়িতেও গিয়েছিলাম। সহায় সম্বল বলতে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও কেড়ে নিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান।'
তিনি বলেন, 'নদী ভাঙন প্রবণ এই এলাকার ব্লক দিয়ে নদী ভাঙন রোধ করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। তাছাড়া এই এলাকায় একাধিক সাইক্লোন শেল্টার নির্মাণ করাও জরুরি। এ বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলব।'
বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, 'ঘূর্ণিঝড় আম্পানে বরগুনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, ইতোমধ্যেই তাদের দিকে আমরা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে টিন ও নগদ অর্থসহ খাদ্যসহায়তা দিচ্ছি। জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারের পাশে আমরা দাঁড়াব। একটি পরিবারও সাহায্যের আওতার বাইরে থাকবে না।'