আশুগঞ্জ সার কারখানা: বেড়েছে বয়স, কমেছে উৎপাদন
৩৮ বছর আগে প্রথম ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড বা আশুগঞ্জ সারকারখানা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ছাড়াও কারখানাটি কমান্ডভুক্ত (আওতাভূক্ত) আরও কয়েকটি জেলায় ইউরিয়া সারের যোগান দেয়। কিন্তু অধিকাংশ পুরনো যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ায় কারখানার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে বহুলাংশে।
গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রায়ই বন্ধ থাকে উৎপাদন। দৈনিক ১৬০০ টন উৎপাদন ক্ষমতার এ কারখানাটি এখন জোড়াতালি দিয়ে ১১০০ থেকে ১২০০ টন পর্যন্ত সার উৎপাদন করতেই হিমশিম খাচ্ছে। তবে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী এ উৎপাদন ঠিক থাকলেও বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ড্রাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে কারখানাটি। বছর বছর যন্ত্রাংশ মেরামতের বদলে নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজন করলেই উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, ১৯৮১ সালে আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা এলাকার মেঘনা নদীর পাশে ৫৩৬.১৩ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত হয় আশুগঞ্জ সারকারখানা। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ইউরিয়া সার উৎপাদন শুরু করে বিসিআইসির এই কারখানাটি। এরপর ১৯৮৩ সালের ১ জুলাই বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়। বর্তমানে এখানে ১৯১ জন কর্মকর্তা ও ৭০৮ জন কর্মচারী-শ্রমিক কাজ করছেন।
ইউরিয়া সার উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস, পানি ও বাতাস। পানির যোগান দেয়া হয় কারখানা সংলগ্ন মেঘনা নদী থেকেই। উৎপাদিত সার কমান্ডভুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জ এবং হবিগঞ্জ জেলার (কিছু অংশ) ডিলারদের কাছে সরবরাহ করা হয়। দৈনিক ১৬০০ টন করে বছরের ৩৩০ দিনে মোট পাঁচ লাখ ২৮ হাজার টন ইউরিয়া সার উৎপাদন ক্ষমতা রয়েছে সারকারখানাটির। কারখানা চালুর কয়েক বছর এই পরিমাণ সার উৎপাদন করতে সক্ষম হলেও ধীরে ধীরে কমতে থাকে উৎপাদনের পরিমাণ। এর প্রধান কারণ হলো আয়ুস্কাল পেরোনো যন্ত্রপাতিতে বারবার ত্রুটি ও গ্যাস সংকট।
কারখানা সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সাধারণত একটি কারখানার যন্ত্রপাতি ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে সক্ষম। আর সেজন্য যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কালও ধরা হয় সর্বোচ্চ ২০ বছর। এই আয়ুষ্কাল পার হওয়ার পর থেকেই যন্ত্রপাতিগুলোতে নানা ধারণের ত্রুটি দেখা দেয়। কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের অ্যামোনিয়া কম্প্রেসার, প্রসেস এয়ার কম্প্রেসার ও সিংগ্যাস কম্প্রেসার এবং এসনসি বয়লারসহ ৩৮ বছর পুরনো বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে প্রায়ই ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। দাম বেশি হওয়ায় এসব যন্ত্রাংশ নতুন করে সংযোজন করতে না পেরে নিয়মিত মেরামত করে কোনো রকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম।
বাৎসরিক সংস্কার কাজের জন্য ৩০ থেকে ৩৫ দিন উৎপাদন বন্ধ রাখে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে আয়ুষ্কাল পেরোনো যন্ত্রপাতিতে প্রায়ই ত্রুটি দেখা দেওয়ায় বাৎসরিক সংস্কার ছাড়াও কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয় ত্রুটি মেরামতের জন্য। আর যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণে একবার উৎপাদন বন্ধ হলেই পাঁচ থেকে সাত দিন লাগে আবার উৎপাদন শুরু হতে। এতে করে বিসিআইসির দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছেনা কারখানটি। এছাড়া ৩৮ বছর আগে সরবরাহকারী বেশ কিছু যন্ত্রপাতির প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশও খুঁজে পাওয়া যায়না। তখন মেরামতের জন্যও বিপাকে পড়তে হয় কারখানা কর্তৃপক্ষকে। বাধ্য হয়ে বাজারে চাহিদার যোগান দিতে আমদানি করা হয় সার।
গত ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বছরের অধিকাংশ সময় গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকে আশুগঞ্জ সারকাখানায়। মূলত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে নিরবিচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের জন্য সারকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হতো। এর ফলে উৎপাদনও বন্ধ থাকত বছরের ওই সময়টাতে। গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে কোনো উৎপাদনই হয়নি আশুগঞ্জ সারকারখানায়। তখন আমদানি করা সার দিয়েই বাজারের চাহিদা মেটানো হয়েছে।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বিসিআইসির দেয়া লক্ষ্যমাত্রার এক লাখ ৫০ হাজার টনের বিপরীতে এক লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন হয়েছে কারখানাটিতে। আর ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে বিসিআইসির লক্ষ্যমাত্রা দিয়েছে এক লাখ ৮০ হাজার টনের। নতুন করে গ্যাস সংকট ও যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা না দিলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করায় এখন আগের মতো গ্যাস সংকট নেই বলে জানিয়েছে সারকারখানা কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ইউনিটের সভাপতি জালাল উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, আশুগঞ্জ সারকারখানাটি অনেক পুরনো হয়ে গেছে। নতুন করে তো আর এতো বড় কারখানা করা সম্ভব না। তাই যন্ত্রপাতিগুলো বদল করে কারখানাটিকে পুরোদমে উৎপাদনে রাখার উদ্যোগ নেয়া উচিত সংশ্লিষ্টদের। আর কৃষকদের কাছে আমদানিকৃত সার থেকে আশুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদিত সারের চাহিদা বেশি। কৃষক এই সার ব্যবহার করতে করতে এটার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেছে। তাই অন্য সারের দাম কম হলেও আশুগঞ্জ সারকারখানার উৎপাদিত সারই চান কৃষকরা। আমরা সার ডিলাররাও চাচ্ছি আশুগঞ্জ সারকারখানা উৎপাদনে থাকুক।
শত শত কোটি টাকার পুরনো যন্ত্রপাতি বদলে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন না করে বছর-বছর সংস্কার-মেরামতের পেছনেই কোটি কোটি খোয়াচ্ছে সরকার। নিরবিচ্ছন্ন উৎপাদনের জন্য প্রতি অর্থবছরই বাজেট চাওয়া হয় কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে। চলতি অর্থবছরে আশুগঞ্জ সারকারখানার জন্য ১৮০ কোটি টাকার বাজেট পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে। এই বাজেটের সিংহভাগই যন্ত্রপাতি মেরামত ও সংস্কারের জন্য।
আশুগঞ্জ ফার্টিলাইজার অ্যান্ড কেমিক্যাল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ৩৮ বছর পুরনো যন্ত্রপাতি দিয়েই কারখানার উৎপাদন চলছে। আয়ুস্কাল পেরিয়ে যাওয়ায় প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। তখন মেরামতের জন্য উৎপাদন বন্ধ রাখতে হয়। বিষয়গুলো আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। যদি পুরাতন যন্ত্রপাতি বদলে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজন করা হয়- তাহলে উৎপাদন বাড়বে। তখন আশা করছি লক্ষ্যমাত্রার ৮০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন হবে।