করোনা প্রতিরোধে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ কতটুকু কার্যকর?
করোনা মহামারি সংক্রমণের শুরু থেকেই বহু মানুষ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ভিটামিন ও মিনারেলসহ বিভিন্ন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।
বিজ্ঞানীরাও রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন সাপ্লিমেন্টের ভূমিকা নিয়ে গবেষণার পিছে বহু সময় ঢেলেছেন। তবে অন্য যেকোনো ভিটামিনের তুলনায় ভিটামিন 'ডি' নিয়ে গবেষকদের আগ্রহের পরিমাণ ছিল বেশি।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফউসি কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে ভিটামিন গ্রহণের ধারণাকে বেছে নিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি জানান, ভিটামিনের ঘাটতি থেকে বাঁচার জন্য তিনি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করেন। পাশাপাশি অন্যদের ভিটামিন গ্রহণের "পরামর্শ দিতে আপত্তি নেই" বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
প্রথম প্রশ্ন হল- কেন ভিটামিন ডি?
ক্যালসিয়ামের সাথে মিলিতভাবে ভিটামিন-ডি হাড়ের সুস্থতা নিশ্চিত করে। অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয় প্রতিরোধে এই ভিটামিনের ভূমিকা সক্রিয়। এছাড়া, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় রাখতে ভিটামিন-ডির ভূমিকা নিয়ে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গবেষণায় ইতিবাচক ফলাফল মিলেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানিরা শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণের সাথে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্টের সম্পর্ক খোঁজার জন্য বহু গবেষণা পরিচালনা করেছেন। কিছু গবেষণা তাৎপর্যপূর্ণ কোনো ফলাফল খুঁজে না পেলেও, অপর কয়েকটি গবেষণার তথ্য অনুযায়ী শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে ভিটামিন-ডি কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
কোভিডের সাথে সম্পর্ক
যুক্তরাষ্ট্রের আনুমানিক ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীই যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন-ডি পান না। অন্যদিকে, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি মানুষের দেহে ভিটামিন-ডি ঘাটতি আছে।
মহামারির শুরুতে গবেষকরা দেখতে পান যে, কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়া ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকের দেহে ভিটামিন-ডি ঘাটতি আছে। বিশেষত, স্থূল, বয়স্ক এবং গাঢ় বর্ণের মানুষের মাঝে এই ঝুঁকি বেশি।
বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভিটামিন-ডি প্রয়োগ কার্যকর কিনা তা নিয়ে বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে ভিটামিন-ডি এর নিম্ন হারের সাথে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ার উচ্চঝুঁকি সম্পর্কিত বেশ কিছু পর্যবেক্ষণমূলক গবেষণা ও বিশাল সংখ্যক পর্যালোচনা সহজলভ্য।
ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার কলেজ অব মেডিসিন ইন ফিনিক্সের ফ্যামিলি অ্যান্ড প্রিভেন্টিভ মেডিসিনের অধ্যাপক ডক্টর শাদ মারভাস্তি জানান, "বেশ কিছু গবেষণা থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার তা হল, দেহে সংক্রমণ পূর্ব মাত্রার (ভিটামিন-ডি) সাথে সংক্রমণ পরবর্তী অবস্থার দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে।"
তিনি জানান, দেহে ভিটামিন ডি ঘাটতির সাথে সাইটোকাইন বৃদ্ধি সম্পর্কযুক্ত। সাইটোকাইন এক ধরনের রাসায়নিক বার্তাবাহক যা মূলত প্রদাহের জন্য দায়ী। একই সাথে প্রতিরক্ষামূলক ইমিউনো কোষের নিম্নহারের জন্যও দায়ী ভিটামিন-ডি ঘাটতি।
সেপ্টেম্বরে জামা নেটওয়ার্ক ওপেনে প্রকাশিত ৪৮৯ জন রোগীর উপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, যাদের দেহে ভিটামিন ডি ঘাটতি রয়েছে তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ টেস্টে পজিটিভ হওয়ার আপেক্ষিক ঝুঁকি ১.৭৭ গুণ বেশি।
অপর গবেষণার তথ্যানুযায়ী, স্বাভাবিক মাত্রার ভিটামিন-ডি সম্পন্নদের থেকে উচ্চ ভিটামিন-ডি সম্পন্ন কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে করোনা পজিটিভ হওয়ার হার কম।
তাহলে কী করা উচিত?
এখন পর্যন্ত কোভিড-১৯ প্রতিরোধে আত্মবিশ্বাসের সাথে নির্দিষ্ট মাত্রার ভিটামিন-ডি গ্রহণে পরামর্শ দেবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ প্রমাণাদি নেই। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষ যথেষ্ট পরিমাণ ভিটামিন পাচ্ছেন কিনা সেদিকে লক্ষ্য রাখাও জরুরি। বিশেষ করে, শীতের মৌসুমে যখন সচরাচর ভিটামিন-ডি এর মাত্রা হ্রাস পেয়ে থাকে।
ভিটামিন-ডি ঘাটতি পূরণে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের বহু যুক্তিসংগত কারণ আছে। তবে, "বেশি কখনোই ভালো নয়" বলে সতর্ক করেন হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টিবিদ ওয়াল্টার উইলেট।
ভিটামিন ডি মূলত চর্বিতে দ্রবনীয় বা ফ্যাট সলিউবল একটি ভিটামিন। অতিরিক্ত পরিমাণে ভিটামিন-ডি সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ দেহে বিষক্রিয়া বা টক্সিসিটির ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। বেশ কিছু গবেষণার সূত্র অনুযায়ী নিয়মিত ৫০,০০০ আইইউ বা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিটের অধিক পরিমাণ ভিটামিন গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হতে পারে।
কোভিড প্রতিরোধে ভিটামিন-ডি ভূমিকা রাখলে সাপ্লিমেন্ট গ্রহণে সমস্যা কোথায়?
ভিটামিন গ্রহণের বিষয়ে বহু চিকিৎসাবিদ সতর্ক অবস্থান গ্রহণ করেছেন।
জনস হপকিনসের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এরিন মিচোস জানান, "আমি কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার জন্য রোগীদের সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের পরামর্শ দিব না।"
ভিটামিন-ডি নিয়ে চলমান বিতর্ককে পাশ কাটিয়ে মিচোস জানান, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বহু উপায় আছে। ভিটামিন সমৃদ্ধ বিভিন্ন শাকসবজি ও ফলমূল গ্রহণ, নিয়মিত শরীরচর্চা, অ্যালকোহল নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি যথেষ্ট পরিমাণ ঘুমের মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব।
"আমার মনে হয় না যে, সাপ্লিমেন্টের পিছে রোগীদের অর্থ অপচয় করা জরুরি," বলেন তিনি।
ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর অধ্যাপক ডক্টর মেল্টজার সাপ্লিমেন্ট গ্রহণের উপকারিতা সম্পর্কে বেশ আশাবাদী। তবে তিনি জানান, ভিটামিন গ্রহণের "স্বাভাবিক" মাত্রা নিয়ে এখনও অনেক কিছু জানা বাকি আছে। মূলত এখন পর্যন্ত হাড়ের সুস্বাস্থ্যে ভিটামিনের মাত্রা নিয়েই অধিকাংশ গবেষণা হয়েছে।
"আমরা আসলে জানি না যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য ভিটামিনের আদর্শ মাত্রা কী," বলেন তিনি। পাশাপাশি ত্বকের বর্ণ, জাতিগত ও জিনগত বৈশিষ্ট্য ও বংশগত পটভূমি অনুযায়ী প্রত্যেকের চাহিদা ভিন্ন। সুতরাং, এ সম্পর্কে জানতে আমাদের এখনো অনেক তথ্যের প্রয়োজন আছে বলে জানান ডক্টর মেল্টজার।
- সূত্র-এনপিআর ডট কম