করোনা মুক্ত ১০ দেশের কি হাল এখন?
বিশ্বের প্রায় সকল দেশ আর অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে কোভিড-১৯। কিন্তু, এখনও এ সংক্রামক রোগের থাবা মুক্ত ১০টি দেশ। সার্স কোভ-২ ভাইরাসের প্রভাব বিশ্বে বহুমুখী ভাবেই পড়েছে। মোটাদাগে অবশ্য প্রভাব দুই ধরনের; মানুষের জীবন এবং জীবিকার উপর কী আঘাত এসেছে-সেই অনুসারেই জনস্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির ভিন্ন দুই পরিমাপ করা চলে।
সে বিবেচনায় সংক্রমণ মুক্ত ১০টি দেশ কী জিতেছে?- সঙ্গতকারণেই সে প্রশ্ন ওঠে। সে উত্তর অনুসন্ধানেই নজর দেওয়া দরকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থার দিকে।
১৯৮২ সালে পালাউ দীপপুঞ্জের তৎকালীন রাজধানী- করোর দ্বীপে চালু করা হয় পালাউ হোটেল। পুরো দেশটিতে তখন ওই একটাই ছিল আধুনিক অতিথিশালা।
এরপর থেকে অবশ্য পর্যটন বিকাশের হাত ধরে সোনালী এক অধ্যায়ে প্রবেশ করে দিগন্ত বিস্তৃত প্রশান্ত মহাসাগরের আকাশী রঙা নীল জলরাশি বেষ্টিত দেশটি। ২০১৯ সালে ৯০ হাজার পর্যটক আসে পালাউয়ে, যা দ্বীপরাষ্ট্রটির মোট জনসংখ্যার চেয়ে ৫গুণ বেশি। ২০১৭ সালে আইএমএফ প্রদত্ত পরিসংখ্যান জানায়, পর্যটন থেকেই মোট জিডিপির ৪০ শতাংশ আসে দেশটির।
তবে এ অবস্থা কিন্তু মহামারি পূর্ব সময়ের।
সংক্রমণ শূন্য মানেই প্রভাবমুক্তি নয়:
বিশ্ব মহামারি দেখা দেওয়ার পর থেকেই গত মার্চ থেকে বন্ধ হয়েছে পালাউয়ে আন্তঃসীমান্ত চলাচল। আকাশ বা নৌপথ- বহিঃবিশ্বের সঙ্গে দুই ধরনের যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণেই রেখেছে দেশটি। পালাউ বিশ্বের এমন ১০টি দেশের মধ্যে পড়ে যেখানে কোনো সংক্রমণ ধরা পড়েনি। তালিকা থেকে অবশ্য; গোয়ার্তুমি করে সংক্রমণ মুক্ত দাবি করা- উ. কোরিয়া এবং তুর্কমেনিস্তানের মতো দেশকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
তবে পালাউয়ে সংক্রমণ না ছড়িয়েই দেশটিকে সম্পূর্ণ লন্ডভণ্ড করেছে অদৃশ্য জীবাণুর হুমকি।
গত মার্চ থেকেই বন্ধ আছে পালাউ হোটেল। নেই পর্যটকের আনাগোনা। বন্ধ হয়েছে অজস্র রেস্তোরাঁ আর ক্যাফেটেরিয়া। তালা ঝুলছে স্যুভেনিউর এর দোকানগুলোয়। হোটেল অবশ্য ফাঁকা নয়, এখনও কিছু মানুষ আছে সেখানে। কিন্তু, তারা হচ্ছেন বিদেশ ফেরত পালাউবাসী। তারা আপাতত হোটেলেই কোয়ারিন্টেনে আছেন।
পালাউ- এর মতো কিছু সমুদ্রবেষ্টিত ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের সমষ্টিতে গড়া দেশগুলোই মুক্ত আছে, কোভিড-১৯ থেকে। এক নজরে এ দেশগুলো হলো; পালাউ, মাইক্রোনেশিয়া, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, নাউরু, কিরিবাতি, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, টুভালু, সামোয়া, ভানুয়াতু এবং টোঙ্গা।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আন্দাজ পাওয়া যায় পালাউ হোটেলের ম্যানেজার এবং অংশীদার ব্রায়ান লি'র কথায়। তিনি জানান, এখানকার সমুদ্র বিশ্বের অন্য যেকোনো স্থানের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর। আকাশরঙা এই স্বচ্ছ নীল পানির টানেই ছুটে আসত পর্যটকের দল। তাদের নিয়ে ব্যস্ততায় সময় কেটে যেতো। কোভিড পূর্ব সময়ে ৫৪ কক্ষের হোটেলে বুকিং হার ছিল ৭০-৮০%। কিন্তু সীমান্ত বন্ধের পর থেকে কোনো বুকিং নেই।
''এটি ছোট্ট এক দেশ- তাই স্থানীয়রা হোটেলে এসে থাকেন না'' যোগ করেন ব্রায়ান।
সম্পূর্ণ বিদেশি অতিথি নির্ভর ব্যবসায় ধ্বস নামায় কর্মীদের চাকরি নিয়েও চিন্তিত ব্রায়ান। তিনি জানান, ২০ জনের প্রায় বেকার এ কর্মীদলের জন্য তিনি খালি হোটেল রক্ষণাবেক্ষণ বা ঘর সাজানোর কাজ প্রায়শই খুঁজে দেন।
দীর্ঘমেয়াদে অবশ্য এভাবে একটি খালি হোটেল রক্ষনাবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। ব্রায়ান জানান, ''আমি হয়তো আর মাস ছয়েক আছি। তারপর হোটেল বন্ধ করে আমাকে নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।''
ব্রায়ান সরকারকে দোষ দিচ্ছেন না। দেশকে সংক্রমণ মুক্ত রাখার পাশাপাশ প্রশাসন স্থানীয়দের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, বলেও জানান তিনি।
''আসলে তারা খুবই ভালো কাজ করেছেন'' বলেন ব্রায়ান। তবে পালাউ এর প্রথম হোটেলটি টিকে থাকতে হলে পরিস্থিতির কিছুটা পরিবর্তন দরকার।
অর্থনীতি সচলের উদ্যোগ:
ইতোমধ্যেই তেমন কিছুরই ইঙ্গিত দিয়েছেন পালাউয়ের প্রেসিডেন্ট। আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর থেকে বিমান চলাচল পুনঃসচলের ঘোষণা দেন তিনি। এছাড়াও, গুঞ্জন শোনা গেছে, পর্যটক আনতে তাইওয়ানের সঙ্গে একটি এয়ার করিডর চালুর ব্যাপারে।
ব্রায়ানের মতো বিদেশি উদ্যোক্তারা এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হওয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।
'' আমি মনে করি তাদের অর্থনীতিকে আবারো সচল করতে হবে। নিউজিল্যান্ড বা এমন কিছু দেশের সঙ্গে তা করা যেতে পারে। তাছাড়া, এখানে কেউই ভালোভাবে বাঁচতে পারবে না।''
দূরত্ব অনেক, তবু মিল কম নয়:
পালাউ থেকে আড়াই হাজার মাইল দূরে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যভাগের আরেক রাষ্ট্র- মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। সংক্রমণের আঁচড় এখানে আসেনি। তবে পালাউয়ের মতো প্রভাবিত এ দেশটিও।
বিদেশিদের জন্য সর্বাধুনিক অতিথিশালা হলো; হোটেল রবার্ট রেইমার্স। মাজুরো দ্বীপে মূল প্রবাল প্রাচীরের এক চিলতে জমির উপর দাড়িয়ে আছে এটি। অপর পাশে দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্ররাশি।
কোভিড পূর্ব সময়ে ৩৭ কক্ষের হোটেলটিতে অতিথি অবস্থানের হার ছিল ৭৫-৮৮ শতাংশ। বেশিরভাগ অতিথি আসতেন এশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড থেকে।
মার্চের পর এ হার নেমে আসে ৩ থেকে ৫ শতাংশে।
এব্যাপারে রবার্ট রেইমার্স হোটেল গ্রুপের একজন কর্মকর্তা সোফিয়া ফাউলার বলেন, ''দূরবর্তী দ্বীপপুঞ্জ থেকে ইতোপূর্বে কিছু অতিথি এসেছিলেন। কিন্তু, তাদের সংখ্যা অনেক কম। এভাবে ব্যবসা পরিচালনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে।''
জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ সৃষ্ট প্রভাবে ৭শ' মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর অনুমান করা হচ্ছে দেশটিতে। ১৯৯৭ সালের পর যা সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার ধ্বস। নতুন করে, বেকার হওয়াদের ২৫৮ জনই কাজ করতেন হোটেল এবং রেস্তোরাঁতে।
তবে সংক্রমণ প্রতিরোধে স্থানীয় মানুষের জন-সমাগম স্থান এড়িয়ে চলাই মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের অর্থনৈতিক পরিবেশকে বেশি প্রভাবিত করেছে। ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকের সংখ্যার উপর পালাউয়ের মতো সিংহভাগ নির্ভরশীলতা নেই দেশটির।
এর প্রধান কর্মসংস্থান বাজার হচ্ছে সাগরে মৎস আহরণ। কিন্তু, দেশকে সংক্রমণ মুক্ত রাখতে ইতোমধ্যেই যেসব দেশে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে, সেসব দেশে জাওয়া মাছ ধরার জাহাজগুলোকে স্থানীয় বন্দর ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। শুধু মাছ ধরার নৌকা নয়, স্থানীয় আয়ের বড় উৎস তেলবাহী এবং কন্টেইনারবাহী জাহাজকেও বন্দরে ভেড়ার আগে সাগরে নোঙ্গর করে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন পালন করতে হচ্ছে।
এ অবস্থায় মাছ ধরার অনুমতি পেয়েও তা বিক্রি করে দিয়েছেন অনেক জেলে। আবার পড়তি অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ভোক্তাপণ্যের চাহিদা কমার কারণে কমেছে মালবাহী বিমান অবতরণের সংখ্যা।
কোভিডের প্রভাব স্পষ্ট স্থানীয় অর্থনীতিতে। অ্যাকুরিয়ামে রাখা নানা বর্ণের মাছের অন্যতম যোগানদাতা মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ। দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত রপ্তানি- ফ্লেমিং অ্যাঞ্জেল নামের একটি মাছের প্রজাতি। কিন্তু, সাম্প্রতিক সময়ে এর রপ্তানি ৫০ শতাংশ কমেছে, বলে যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়।
এছাড়া, অন্যান্য ধরনের মাছ ধরার শিল্প প্রভাবিত হয়েছে কমবেশি ৩০ শতাংশের কাছাকাছি।
এ দুই দ্বীপ রাষ্ট্রের উদাহরণে দেখা যাচ্ছে, সংক্রমণ মুক্ত রাখা গেলে দেশের নাগরিকদের জীবনের সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু, তারপরও এর প্রভাব অনেকদূর বিস্তৃত। বিশ্ব অর্থনীতির প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত দৈন্যতার এ চাপ; সংক্রমণ মুক্ত থাকা দেশগুলোকেও মোকাবিলা করতে হচ্ছে।