কিংবদন্তি হওয়া বুড়িমার মিষ্টি
একটা পেটমোটা দীর্ঘ রাস্তা শহরের এমাথা-ওমাথা পর্যন্ত বিস্তৃত, এটাই শহরের প্রধান সড়ক। এই সড়কের দুপাশ জুড়েই ঠাসাঠাসি করে ওঠা ছোটোবড় অসংখ্য দালান, বিপনীবিতান। এবং কিছু পেল্লাই সাইজের পিলার, এগুলো নাকি ফ্লাইওভার হবে- তারই সাক্ষী হয়ে চেয়ে আছে আকাশ পানে।
জামালপুর শহরে ঢোকার পরই একজন ঢাকাবাসীকে আশ্চর্য করবে যে ব্যাপারটি তা হল: ঢাকার মতো এখানকার রাস্তায় কোনো বাসের দৌরাত্ম নেই। বরং ফ্লাইওভারের পিলারের আশপাশে গরু হাঁটাচলা করছে, এক দুটো গরু বিচালী খেয়ে যাবর কাটছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেল জামালপুরের প্রধান বাস স্ট্যান্ড পুরোই শহরের বাইরে, তবে জামালপুরবাসী বাস না, তাদের যাতায়াত বেশিরভাগ ট্রেনে। যে কারণে ঢাকা বা জামালপুর থেকে ট্রেনের টিকেট পাওয়া দুরূহ এক ব্যাপার! এ লাইনে ব্যাপক জনপ্রিয় অগ্নিবীণার টিকেটের জন্য লাইন দিতে হয় এক কি দেড় সপ্তাহ আগেই, সে হোক অনলাইন কিংবা স্টেশন কাউন্টার।
স্টেশনে একজনের অপেক্ষমান থাকার কথা ছিল, ট্রেন একটু আগেই চলে আসায় সে এখনও এসে পৌঁছায়নি। তার অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে পড়লাম। স্টেশন এরিয়া পার হয়ে যে জায়গাটায় পৌঁছলাম তার নাম গেটপার। জামালপুর শহরের অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা। নানা দিক থেকে ছুটে আসছে রিকসা, সিএনজি, আর অগুন্তি মানুষের হাকডাক। কিন্তু আমার চোখ আটকে গেল কতগুলো মিষ্টির দোকানে। সার সার দোকান। সানোয়ার সুইটস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, মুনশী রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড সুইটস, নূর রেস্টুরেন্টস অ্যান্ড সুইটস- এরকম বাহারী নামের সব মিষ্টির দোকান। বিপরীত পাশেও তাই, মৌবন সুইটস অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট, গোপাল মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, জামালপুর মিষ্টিবাড়ি, মিষ্টি কানান, মধুমহল সুইটস। আমি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি, আমার স্থানীয় প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা না হওয়া পর্যন্ত কোনো কাজ নেই। এখন বিকেল বেলা, মিষ্টি দিয়েই জামালপুরের ভোজন পর্ব শুরু করলে কেমন হয়!
হাতখানেক দূরে রেললাইন ঘেঁষে দাঁড়ানো ধোপদুরস্ত প্যান্টশার্ট পরা এক লোককে জিজ্ঞেস করলাম, এতোগুলো মিষ্টির দোকানের মধ্যে ভালো কোনটা?
ভদ্রলোক জবাব দেওয়ার আগে আমাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে, ঠোঁট উল্টে বলল, নতুন আসছেন? জবাবে আমি মাথা নাড়লাম। তারপর তিনি যা জানালেন তা হল এরকম: জামালপুরের সেরা মিষ্টির দোকান আসলে একটাই। এগুলোর কোনোটাই না। সেরা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার হল: বুড়িমার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার।
নামটা অদ্ভুত!
ঠায়-ঠিকানা নিয়ে একটা রিকসা যোগে শহরের মাঝামাঝি পৌঁছে দেখি, ছোট একটা দোকান: মা মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, নিচে বন্ধনীতে লেখা বুড়িমার মিষ্টি। তেমন আহামরী চেহারা না।
ক্যাশে বসা এক যুবক। তার মাথার উপর ফ্রেমে বাধা এক মধ্য বয়স্ক মহিলার ছবি। বেশ একটা সম্ভ্রান্ত চেহারা। অমলাবালা সাহা।
বুড়িমার এই মিষ্টির দোকানের শুরু পচাত্তর বছর আগে। অমলাবালা সাহা মানিকগঞ্জের বালিয়াটি থেকে স্বামীর সঙ্গে জামালপুরে এসেছিলেন, বিয়ের পর পরই।
জামালপুরে তখন পাটের জন্য রমরমা অবস্থা। স্বামী সারাদিন পাটের মোকামে পড়ে থাকেন। একঘেয়েমিতে তিতিবিরক্ত অমলা বালা শ্যামলী ঘোষ নামের এক বান্ধবীর কাছে দই মিষ্টি বানাতে শিখেছিলেন, নিজে ব্যস্ত হতে দই আর চিড়ার আয়োজন রেখে ছোট একটা খাওয়ার দোকান চালু করে ফেললেন। পাটের ব্যবসার কারণে নিত্য ব্যস্ত শহরে দ্রুতই দই চিড়া খাওয়ার প্রচুর খদ্দের পেয়ে গেলেন অমলা। এবং পচাত্তর বছর আগে শুরু হওয়া দই চিড়ার দোকানই পরে হয় আজকের বুড়িমার মিষ্টির দোকান।
প্রায় তিন পুরুষের ব্যবসা
বুড়িমার সঙ্গে কাজ করেছেন, বুড়িমা নিজে হাতে মিষ্টি বানানো শিখিয়েছেন এরকম একজন পুরোনো কর্মচারী লালমোহন সাহা। বেশ দশাসই এক লোক, তবে চুল সব পেকে সাদা। হাসি মুখে তিনি গল্প শুরু করলেন।
লালমোহনই বুড়িমার সময়ের একমাত্র কারিগর। অমলাবালা ওরফে বুড়িমা স্বামীর মৃত্যুর পর এই মিষ্টির দোকানেই সব শ্রম, সময় ঢেলে দেন। তার ব্যবসার মূলমন্ত্র ছিল সততা আর ব্যবহার। বুড়িমা নিজে মিষ্টি বানাতেন, খদ্দের সামলাতেন এবং ব্যবসার হিসেব রাখতেন। বুড়িমা মারা গেছেন ২০০৪ সালে।
'বুড়িমার দুই ছেলের একজন অ্যাডভোকেট, কিন্তু ঢাকা ছেড়ে এসে বুড়িমার সঙ্গে সেও ব্যবসায় নেমে পড়ে। অন্যজন পড়াশোনা করেননি, বুড়িমার সঙ্গে ব্যবসায় খেটেছেন।' তখন বুড়িমার আরও দুটো শাখা খোলা হয়ে গেছে। মিষ্টির সঙ্গে যোগ হয়েছে সকালের নাস্তা: লুচি আর হালুয়া। লালমোহন আরো যোগ করলেন,' এই হালুয়ার কথা এখনও লোকে বলে।' কিন্তু বুড়িমা মারা যাওয়ার পর লুচি-হালুয়ার কারিগর চলে যান। 'আর ফিরল না। বাকি দোকান দুইটাও তাই বন্ধ। তবে এই দোকান থেকেই প্রতিদিন এক থেকে দেড় মণ মিষ্টি-দই বিক্রি হয়। এখনও বারো জন কর্মচারী দিনরাত খাটে,' জানালেন লালমোহন।
বুড়িমার দুই ছেলেও বেঁচে নেই। ব্যবসার দেখভাল করে এখন বুড়িমার নাতি। তাকে দুইবার গিয়েও ক্যাশে পাওয়া গেল না। তিনি সন্ধ্যায়, কিংবা রাতে এসে টাকা নিয়ে যান শুধু।
লালমোহন সাহার কথায় একটু কি হতাশার সুর ধ্বনিত হল, 'এরে আমি বুড়িমার সঙ্গে কোলে করে মানুষ করছি' বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
বুড়িমার ব্যবসা এখন তৃতীয় প্রজন্মের হাতে। এটাই শঙ্কার বিষয়। শুধু বুড়িমা না বাংলাদেশে অনেক নাম করা ব্যবসা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৃতীয় প্রজন্মের হাতে পড়ে শেষ হয়ে গেছে কিংবা জেল্লা হারিয়ে ফেলেছে।
লালমোহনও প্রায় বয়োবৃদ্ধ। তারপর?