কেমন আছেন দেশের প্রথম নারী পেট্রলপাম্প কর্মীরা
পাবনা সদরের লস্করপুর এলাকায় বাইপাস রাস্তার ধারে অবস্থিত ইয়াকুব ফিলিং স্টেশন। ফেব্রুয়ারির এক বিকালে গিয়ে সেখানে বিশাল এক ট্রাক ঢুকতে দেখা গেল। ট্রাক দেখে পেট্রোল গান হাতে সামনে এসে দাঁড়ালেন বোরকা পরিহিতা এক নারী।
কতটুকু পেট্রোল দিতে হবে ট্রাক চালককে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। এরপর ট্যাংক ভরতে শুরু করলেন। সেই সাথে নজর রাখলেন পাম্প মেশিনের দিকেও। পরবর্তীতে, রসিদ কেটে ক্যাশ কাউন্টারে জমা দিলেন।
বাংলাদেশের ফিলিং স্টেশনগুলোতে সচরাচর নারীদের দেখা মিলে না। তবে, ইয়াকুব ফিলিং স্টেশনটি ব্যতিক্রম। ২০০২ সালে স্কয়ার গ্রুপ ফিলিং স্টেশনটি প্রতিষ্ঠা করে। নারী কর্মীদের ফিলিং-এর কাজ দেওয়া প্রথম স্টেশন এটি।
স্টেশনটি প্রতিষ্ঠার পর চারজন নারী এখানে কাজ পান। ৩৬ বছর বয়সী পপি আক্তার তাদেরই একজন। ১৮ বছর বয়সে তিনি এখানে কাজে যোগ দেন। যোগদানের পূর্বে তার ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে পপিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
পপির জন্য নতুন এক জগত ছিল এই ফিলিং স্টেশন। এর আগে দেশের নারীরা এখানে কাজ করেননি। পপি সেই চ্যালেঞ্জই হাতে তুলে নিলেন।
"'মেয়েরাও মানুষ' নামের একটি চলচ্চিত্র আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল। সমাজকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে মেয়েরা ছেলেদের থেকে কোনো অংশে কম নয়," ট্রাকে তেল ভরার সময় বলছিলেন পপি।
বর্তমানে স্টেশনটিতে ছয়জন নারী কাজ করছেন। ইয়াকুব ফিলিং স্টেশন প্রতিদিন ২৭ হাজার লিটার জ্বালানি তেল বিক্রি করে থাকে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার যাত্রী ও বাণিজ্যিক পরিবহন এখানে আসে। পপির কাজ হল গাড়িতে পেট্রোল ভরা শেষে রসিদ কেটে কাউন্টারে জমা করা।
দেশের প্রভাবশালী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান স্কোয়ার গ্রুপ মূলত নিজেদের পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত বাহনগুলোর জন্য মানসম্পন্ন জ্বালানি নিশ্চিত করতে নিজস্ব ফিলিং স্টেশন স্থাপন করে। এর আগে সরবরাহ চেইন সক্রিয় রাখতে পরিবহনে জ্বালানি নিশ্চিত করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটিকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
তবে কর্মী নিয়োগের পূর্বে স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী নতুন এক উদ্যোগ নেন। তিনি ফিলিং স্টেশনগুলোতে নারী কর্মী নিয়োগদানের পরিকল্পনা করেন।
"আমাদের নির্বাহী পরিচালক আয়ের উৎস না থাকায় পরিবারে অবহেলিত নারীদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন," বলেন স্কয়ারের সহকারি মহা ব্যবস্থাপক আব্দুল হান্নান।
পাবনা টাউন গার্লস হাই স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর পপি ফিলিং স্টেশনের কাজে যোগদান করেন। এখানে কাজ করতে হলে ন্যূনতম এসএসসি উত্তীর্ণ হওয়া জরুরি।
শুরুর দিকে, বেশির ভাগ মানুষই তাদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করতেন। শুধু যানবাহন চালক বা হেল্পাররাই নন, প্রতিবেশিরাও তাদের সন্দেহের চোখে দেখতেন।
"তারা মনে করতেন নারীদের ফিলিং স্টেশনে কাজ করা উচিত নয়। কখনো কখনো তারা আমাদের উত্ত্যক্ত করার চেষ্টাও করতেন, তবে আমরা প্রতিবাদ জানাতাম," জানান পপি। কেউ খারাপ আচরণ করলে স্টেশন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ করত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
তবে সময়ের সাথে পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গেছে। চালক এবং হেল্পাররা এখন পরিচিত মুখে পরিণত হওয়ায় পপি এখন তেমন কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন না। স্টেশনে কাজ শুরু করার পরই পপির বিয়ে হয়ে যায়।
"আমার স্বামী স্টেশনে কাজের বিষয়টি জেনেশুনেই বিয়ে করেছিলেন। তিনি আমাকে কখনোই নিরুৎসাহিত করেননি। বরং পরিবারের প্রতি আমার আর্থিক অবদানের বিষয়টি তিনি পছন্দ করেন," বলেন পপি।
ফিলিং স্টেশনে রাত্রিকালীন কোন কাজ নেই। ভোর ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দুই শিফটে কাজ চলে।
পপির মতো জুলেখা আক্তারও ২০০২ সালে নিয়োগ পান। তিনি সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ সংলগ্ন রাধানগর এলাকার বাসিন্দা।
অনার্সে অধ্যয়নকালীন তিনি ফিলিং স্টেশনে যোগদান করেন। পড়ালেখা চালিয়ে যেতে এবং পরিবারকে সাহায্য করতে জুলেখার চাকরির প্রয়োজন ছিল। সেসময় তিনি প্রাইভেট পড়িয়ে এবং সেলাই করে পড়ালেখা করতেন।
"আমি অন্য কাজ করলেও আয় খুব কম ছিল। তারপর আমি শুনলাম যে নতুন ফিলিং স্টেশনে কাজের সুযোগ আছে। আবেদন করার পর আমি নিয়োগ পাই," বলেন জুলেখা।
"মানুষ মাঝেমধ্যে আমাদের দেখে খারাপ মন্তব্য করতেন। তবে, একদিন সবই সয়ে যাবে মনে করেই আমি চ্যালেঞ্জটা নিই," বলেন তিনি।
জুলেখা মনে করেন সুযোগ থাকলে বহু নারী এ পেশায় আসবেন। "এটা কঠিন কোনো কাজ নয়," যোগ করেন জুলেখা।
স্কয়ার টয়লেট্রিজের সহকারী মহা ব্যবস্থাপক আব্দুল হান্নান বলেন, "বিশ বছর আগে সামাজিক অবস্থা আরও ভিন্ন ছিল। সে সময় সমাজ আরও রক্ষণশীল ছিল। নারীদের জন্য কাজটি দুঃসাহসী ছিল। তারা পুরুষ শাসিত সমাজের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।"
তিনি বিশ্বাস করেন, প্রভাবশালী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততার কারণেই নারীদের পক্ষে অনুকূল পরিবেশে কাজ করা সম্ভব হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিটি কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে।
তিনি জানান, তারা শীঘ্রই আরও দুজন নারীকে নিয়োগ করবেন।
তবে, ফিলিং স্টেশনই প্রথম প্রকল্প নয় যার মাধ্যমে স্কয়ার নারীর ক্ষমতায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি প্রথমবারের মতো বিশাল সংখ্যক নারীদের নিয়োগ দেওয়া শুরু করে। কাজের মাধ্যমে নারীরা তাদের পারদর্শীতা প্রদর্শন করেন। এরপর প্রতিষ্ঠানটি আরও বহু নারীকে নিয়োগ করে।
বর্তমানে স্কয়ারের অধীনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৬৫ হাজার কর্মী কাজ করছেন। স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড এবং স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডে প্রায় সাত হাজার কর্মী কাজ করেন। এদের মধ্যে ৬২ শতাংশই নারী।
তবে, শীতকালীন পণ্য বেশি থাকায় শীতের মৌসুমে প্রতিষ্ঠানটি অধিক সংখ্যক নারীদের নিয়োগ প্রদান করে। পার্শ্ববর্তী, পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে খণ্ডকালীন এসব কর্মীদের নিয়োগ করা হয়।