ক্ষুদ্র ঋণকেও সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে কোভিড-১৯
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চলমান মহামারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় কর্মসংস্থান তথা আয়ের সুযোগ হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। দু'মুঠো খাবার যোগানের চেষ্টায় নিজের মুষ্টিমেয় সম্বলও বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন অগণিত ব্যক্তি। রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ ছিন্নমূল, দিনমজদুর এবং নিম্ন- মধ্যবিত্তের আর্থিক সঙ্কট দূরীকরণে কিছুটা কার্যকর হলেও, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ না থাকায় ক্রমশই শূন্য হয়ে পড়েছে অনেক দেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগার।
বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ঋণের মাধ্যমে মানুষের পাশে থাকার সুযোগ খুবই কম। সেখানে আমানতকারীর মূলধন সুরক্ষায় প্রদত্ত ঋণের ঝুঁকি মূল্যায়ন করা হয়। আলোচ্য শ্রেণির মানুষেরা এ মূল্যায়ন উত্তীর্ণ হতে পারেন না। তাই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প সহযোগিতার উৎস; ক্ষুদ্রঋণ। বিগত কয়েক যুগ ধরে প্রান্তিক জনগণের আর্থিক চাহিদা পূরণে- এটাই হয়ে উঠেছে বিকল্প এক শিল্প।
ক্ষুদ্র ঋণের বিকাশ ও প্রবক্তা:
প্রান্তিক বিকাশের এ ব্যবসায়িক সূত্রকে প্রতিষ্ঠিত শিল্পে রূপদানের মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচনের প্রয়াসের কারণেই; ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তবে কোভিড-১৯ ক্ষুদ্রঋণের বৈশ্বিক সংস্থাগুলোকে নজিরবিহীন এক পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে।
ক্ষুদ্র ঋণের বাংলাদেশি উদ্যোক্তা ইউনূস বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনের বিশাল প্রচেষ্টা হাতে নেন। তার ব্যবসায়িক মডেল অনুসরণ করে দেশে দেশে ক্ষুদ্র ঋণের প্রসারে গড়ে ওঠে অনেক সংস্থা। এদের কাছ থেকে সহজে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে বিনিয়োগের মূলধন নেওয়ার সুযোগ পেতে থাকেন প্রান্তিক জনগোষ্ঠী।
নিজেদের মধ্যে সুপ্ত উদ্যোক্তা স্বত্বার পরিস্ফুটন ঘটিয়ে অনেক ঋণগ্রহণকারীই মুক্তি পান চরম অভাব-অনটনের কড়াল গ্রাস থেকে। ঋণ ব্যবসাতেও যোগ হয় নতুন এক মডেল। যেখানে ঋণ সক্ষমতা যাচাইয়ে স্থায়ী সম্পদ জামানতের পরিবর্তে- ঋণ আবেদনকারীর প্রত্যাশিত আয়কে যাচাই করে ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন শুরু হয়। অনেক সময় ঋণ দেওয়া হয়, নির্দিষ্ট একটি এলাকা, মহল্লা বা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। এতে করে সম্ভাব্য ঋণগ্রহীতার সামাজিক অবস্থান সম্পর্কেও জামানতদার হয়ে ওঠেন পরিচিত অন্য ঋণগ্রহীতারা। সামাজিক দায়বদ্ধতা ও ঋণ পরিশোধের সম্ভাবনা বাড়ে- নির্দিস্ট সমাজে গোষ্ঠীবদ্ধ ঋণ প্রদানের মাধ্যমেও।
এ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যাংকারদের থেকেও এলাকার মানুষ একে-অন্যের সম্পর্কে ভালো করেই জানেন। তাই খেলাপির সম্ভাবনা বা ঋণ রিটার্নের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। ঋণ মূল্যায়নের নতুন এ মডেল আরো বাঁচায়; ঋণ নিয়ে আলাপ-আলোচনার দীর্ঘ সময় , ঋণ মূল্যায়নের বিলম্বিত কার্যপরিধি এবং অন্যান্য বাঁধা-বিপত্তি। ফলে সহজেই ছোট অংকের লগ্নি সাশ্রয়ী সুদহারে ঋণ দেওয়া যায়।
ক্ষুদ্র ঋণ শিল্প এক মহীরুহে পরিণত হয়েছে:
আজকের বিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণদাতা (এমএফআইএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বিত সম্পদমূল্য ১২ হাজার ৪শ' কোটি ডলার। তবে কোভিড-১৯ এর কারণে আর্থিক কর্মকাণ্ড পরিচলানায় যে বিপত্তি তৈরি হয়েছে, তা শিল্পটির অস্তিত্বের জন্যই হয়ে উঠেছে বিপৎজনক।
বিশেষ করে, ঋণ রিটার্নের বিষয়টি এখানে মূল ভূমিকা রাখছে। সাধারণত ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি শোধ করতে হয়, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এবং নগদ অর্থে। লকডাউন আর সামাজিক দূরত্ব রাখার ফেরে যাতে ধ্বস নেমেছে। অথচ যেসব বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র ঋণদাতাদের পুঁজি সরবরাহ করেছে, তারা এখন সুদে-আসলে তা ফেরত পাওয়ার আশা করছে। এ অবস্থায় দুই-তৃতীয়াংশ এমএফআইএস-গুলো তাদের ব্যবসার পরিধি সংকোচন করছে- ঋণ বিতরণ কমিয়ে। এদের অধিকাংশই প্রদত্ত ঋণের অংক অন্তত অর্ধেকে নামিয়ে আনে। বৈশ্বিক ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের এক-তৃতীয়াংশের কাছে চলতি প্রান্তিকে ঋণ প্রদানের মতো যথেষ্ট নগদ অর্থ না থাকাটাই- যার প্রধান কারণ।
শুধু নগদ অর্থ সঙ্কটে ব্যবসার পরিধি কমানো বা মূল আর্থিক পুঁজিদাতাদের লগ্নিসুদ পরিশোধ করাটাই সমস্যার শেষ নয়। বরং দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান কিছু সমস্যা বর্তমানে সৃষ্টি করছে- পুঞ্জিভূত চাপ। যা ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়িক সুনাম, আস্থা এবং দক্ষতার মতো মূল পুঁজিগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলা শুরু করেছে।
নিয়ন্ত্রক সংস্থার ব্যর্থতা:
প্রথমদিকে সরল ব্যবসায়ীক মডেল থাকলেও অতিবাহিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে- বিগত দুই দশকে বাড়ে ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসার আন্তর্জাতিক কলেবর। তার সঙ্গে বেড়ে চলে ঋণ সঞ্চালন ও আদায় পরিচালনার জটিলতা। শুধুমাত্র দরিদ্ররা নন, বহুবিধ সেবা অন্তর্ভুক্ত এখন মাইক্রো ফাইন্যান্সের ছাতার তলে; যেখানে বীমা থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তার জন্য দেওয়া নানাবিধ সেবাও যুক্ত হয়েছে।
নতুন বাজার সম্ভাবনার সন্ধান পেয়ে এতে যোগ দেয় বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরাও। প্রায় সব দেশেই পুঁজি সঞ্চালকদের 'গোলমেলে' এই বাজার প্রতিযোগিতার সীমারেখা বেঁধে দিতে হিমশিম খেয়েছে আর্থিকখাত নিয়ন্ত্রণের কর্তৃপক্ষেরা।
সাময়িক জটিলতা বা উদ্ভূত সমস্যা নিরসনে নিয়ন্ত্রকদের প্রণীত জোড়াতালি দেওয়া সমাধান এখন ক্ষুদ্র ঋণ শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। কারণ, সুদসহ (মুনাফা) ঋণ রিতার্নের হার ৯০ শতাংশ হওয়ায়, এ শিল্পে বিনিয়োগে আকৃষ্ট হয় বৃহৎ ঋণদাতারা। যাদের অনেকেই ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মূলধন সরবরাহের পূর্বশর্ত হিসেবে স্থায়ী জামানত নিয়েছে। অনেক সময় সরাসরি ক্ষুদ্র ঋণদাতার ভূমিকাতেও অবতীর্ণ হয় তারা; নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির অভাব ও আইনি ফাঁক-ফোকরের সুযোগ কাজে লাগিয়ে। ক্ষুদ্র ঋণগৃহীতার কাছ থেকে জামানত হিসেবে জমিজমা বা বসতবাড়িও বন্ধক রাখার শর্ত দেয় তারা। অনেক সময়, নির্ধারণ করেছে অতি-উচ্চ অংকের সুদ। আবার ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে- কঙ্গো থেকে কসোভো সর্বত্র এমন অসংখ্য কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে।
মন্দা মোকাবিলায় দরকার মাইক্রো ফাইন্যান্সে নীতি সহায়তা:
বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমন কার্যকালাপ বলার অপেক্ষা রাখে না- পারতপক্ষে ক্ষুদ্র ঋণের উপরেই জনমানুষের আস্থা হ্রাস করবে। যা সঙ্কটে আপতীত একটি শিল্পকে ঠেলে দিতে পারে বিলুপ্তির দিকে। কিন্তু, কোভিড-১৯ মহামারি নজিরবিহীন এক আর্থিক দীনতার সূচনা করেছে। ক্ষুদ্র ঋণদাতারা বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচনে প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে আরো শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে সমর্থ হবে। এক্ষেত্রে কমাতে হবে দানবসম আর্থিক প্রতিষ্ঠান তথা মূলধন সবরাহকদের উপর তাদের নির্ভরতার সম্পর্ক বা তাদের সৃষ্ট চাপের ভার।
সাম্প্রতিক দশকে ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক অনেক অর্থনৈতিক গবেষণাপত্রে ইঙ্গিত দেওয়া হয় যে, এমএফআইএস-গুলো তাদের বৃহৎ আর্থিক সহযোগীদের উচ্চ-প্রত্যাশা পূরণে সমর্থ হচ্ছে না। অর্থাৎ, বৃহৎ মূলধন দাতারা যেভাবে প্রান্তিক প্রতি মুনাফা বৃদ্ধি প্রত্যাশা করে তা ক্ষুদ্র ঋণ বাণিজ্যের সামাজিক ব্যবসার সহযোগী শক্তি নয়।
সর্বপ্রথম এ সমস্যার দিকে আলোকপাত করেন গতবছর নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ দম্পতি- অভিজিৎ ব্যানার্জি ও তার স্ত্রী এস্থার ডুফলো। তারাসহ অন্যান্য অর্থনীতিবিদের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণদাতার ব্যবসায়ীক সংযোগ; মূলধন সরবরাহের পরিবেশ, অর্জিত মুনাফা এবং ঋণ বিতরণকে অনিশ্চিত করে তোলে। ফলে দিনে দিনে পুঁজিবাজারের প্রতিষ্ঠিত লগ্নিকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান- ক্ষুদ্র ঋণে বিনিয়োগে অনুৎসাহী হয়ে উঠেছে। আবার ক্ষুদ্র ঋণে বেসরকারি অনুদানের অংকও হ্রাস পাচ্ছে।
বিশ্বমন্দার মধ্যে এই সঙ্কটের তাড়না; মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের সমান। বিশেষ করে, শুধু দারিদ্র্য বিমোচন নয়, স্বস্তায় নিজে বা আত্মীয়দের জন্যেও প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারেন নিম্ন আয়ের মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ দাতা প্রতিষ্ঠানের সুবাদে। অর্থাৎ, কম খরচের ভোক্তাপণ্য সরবরাহের অসংখ্য শিল্প ও শ্রমিকের কর্মসংস্থান নির্ভর করছে ক্ষুদ্র ঋণের সৃষ্ট প্রত্যক্ষ উপযোগটিকে কেন্দ্র করে।
তাই অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, এখনই সময় ক্ষুদ্র ঋণের জটিলতা হ্রাসে উদ্যোগী হওয়ার। লালফিতার দৌরাত্ম কমিয়ে ক্ষুদ্র ঋণ প্রতিষ্ঠানকে আইনি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে হবে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই। এর মাধ্যমে তাদের জন্য সহজে ও কম সুদের মূলধন সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হলে, তা স্থানীয় অর্থনীতির মন্দা থেকে পুনরুত্থান গতিশীল করবে। আবার সঙ্কটের এ সময়ে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক সুরক্ষার বলয়ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
সরকারি নীতি সহায়তার মাধ্যমে সুযোগ সন্ধানী এবং লোভী ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম বন্ধের এটাই প্রকৃত সময়। তাছাড়া, দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যকে সামনে রেখে সুসংবদ্ধ এবং স্বচ্ছ নীতিমালা প্রণয়নও অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে
- অনুবাদ: নূর মাজিদ