চা বাগানের ৪৬ শতাংশ কিশোরীই বাল্যবিয়ের শিকার
গত মাসেই বিয়ে হয় সিলেটের বুরজান চা বাগানের ঝুমুর মোদীর। এ বছর ১৩ বছর পূর্ণ করা ঝুমুর পড়েছে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। বিয়ের পরই সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভর্তি করা হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সেখান থেকে বাড়ি ফিরলেও এখনও পূর্ণ সুস্থ হয়নি ঝুমুর।
তবে ঝুমুরের বাবা ওই বাগানের শ্রমিক অঞ্জন মোদী মনে করেন, এই বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, ''মেয়েদের বেশিদিন ঘরে রাখা ঠিক না। নানা ঝামেলায় পড়তে হয়। তাদের যত আগে বিয়ে দেওয়া যায় ততোই ভালো।''
ঝুমুরের থেকেও তিন বছর কম বয়সে বিয়ে হয় সিলেটের দলদলি চা বাগানের মণি দাসের (১৮)। ২০১২ সালে যখন মণির বিয়ে হয় তখন তার বয়স মাত্র ১০। বিয়ের পরের বছর জমজ সন্তানের মা হন মণি। বর্তমানে সাড়ে ছয় বছর বয়সী দুইটি যমজ মেয়ে ও তিন বছরের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে তার। সন্তানদের সঙ্গে খেলা করেই কৈশোর পার করছেন মণি। অল্প বয়সে বিয়ে ও মা হওয়ার বিরূপ প্রভাব পরেছে মণি ও তার সন্তানদের ওপর। মা ও সন্তান চার জনেরই রোগা শরীর। সারা বছরই অসুস্থ থাকে তারা।
কেবল ওরা দু'জনই নয়, সিলেটের চা বাগানগুলোতে গেলে দেখা মিলবে এমন অসংখ্য ঝুমুর-মণিদের। কিশোরী মেয়েরা বাচ্চা কোলে ঘুরে বেড়াচ্ছে- চা বাগানে এমন দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক।
সিলেট বিভাগের চা বাগানের ওপর পরিচালিত জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে জানা গেছে, চা বাগানের ৪৬ শতাংশ কিশোরীই বাল্য বিয়ের শিকার। আর ১৮ বছরের আগেই মা হচ্ছে ২২ দশমিক দুই শতাংশ কিশোরী।
শুধুমাত্র চা জনগোষ্ঠী নিয়ে প্রথমবারের মতো এই জরিপ চালানো হয় ২০১৮ সালে। জরিপের প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত বছরের শেষ দিকে।
চা বাগানের কিশোর-কিশোরী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ঊষা'র পরিচালক নিগাত সাদিয়া বলেন, ''বাল্য বিয়ে চা শ্রমিক মেয়েদের জন্য অনেকটা নিয়তির মতো। নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্রতা, কুসংস্কার এবং অশিক্ষার কারণে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয়। অল্প বয়সে তারা মাও হচ্ছে।''
মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার কমানো, অপরিপক্ব শিশু জন্মরোধ ও কিশোরীদের স্বাভাবিক বিকাশে সরকার ১৮ বছরের আগে মেয়েদের ও ২১ বছরের আগে ছেলেদের বিয়ে আইন করে নিষিদ্ধ করেছে। ২০১৭ সালে করা সংশোধিত এই আইনে বিশেষ পরিস্থিতিতে আদালতের অনুমতি নিয়ে নাবালকের বিয়ের একটি বিশেষ বিধান রাখা হয়েছে।
আইন করে নিষিদ্ধ করা, প্রশাসনের উদ্যোগ ও জনসচেতনতার কারণে সিলেট বিভাগে বাল্যবিবাহ হারও কিছুটা কমে এসেছে। ২০১২-১৩ সালে ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগে বাল্য বিয়ের হার ৩৮.৫ শতাংশ। আর ২০১৯ সালে এই দুই সংস্থার পরিচালিত জরিপের তথ্য মতে, সিলেট বিভাগে বাল্য বিয়ের হার ৩১ শতাংশ।
চা বাগানে বাল্য বিয়ের হার এখনও অনেক বেশি বলে মনে করেন সিলেটের সদ্য বিদায়ী বিভাগীয় কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, জীবনমানের নানা ক্ষেত্রেই পিছিয়ে রয়েছে চা জনগোষ্ঠী। বাগানগুলোতে বাল্যবিয়ের হারও অধিক। বাগানে বাল্য বিয়ে কমিয়ে আনতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি।
তিনি বলেন, ''চা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি আমাদের থেকে আলাদা। তাদের মধ্যে সচেতনতারও অভাব রয়েছে। তাই সরকারের সকল বার্তা ও সেবা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে কিছুটা সময় লাগছে। তবে আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।''
সারা দেশে চা বাগান রয়েছে ১৬২টি। এর মধ্যে সিলেট বিভাগের তিন জেলায় রয়েছে ১৩৮টি। ইউনিসেফ ও বিবিএসের জরিপের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, মৌলভীবাজারে চা বাগানের ৪৭.৭ শতাংশ, হবিগঞ্জের ৪১.৩ শতাংশ ও সিলেটের ৩৯.১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয় ১৮ বছরের আগেই।
চা বাগানের ২০ থেকে ২৪ বছরের নারীদের উপর পরিচালিত এ জরিপে দেখা গেছে, ১৫ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় হবিগঞ্জের ১০.৩ শতাংশ, মৌলভীবাজারে ১৪.৩ শতাংশ ও সিলেটের ১৪.২ শতাংশ কিশোরীর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় কিশোরীরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অপুষ্ট সন্তান জন্ম দিচ্ছে তারা। অনেক সময় মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে।
লাক্কাতুরা চা বাগানে মিডওয়াইফ (প্রশিক্ষিত ধাত্রী) হিসেবে কাজ করেন পরশ গোয়ালা। তিনি বলেন, বিয়ের পরপরই মা হয়ে যায় বেশিরভাগ কিশোরী। প্রসবকালে এই কিশোরীরা নানা জটিলতায় ভোগে। সন্তান প্রসবের পর মা ও শিশু উভয়ই সঙ্কটে পড়ে। অনেকক্ষেত্রে মৃত্যুও হয়।
চা বাগানের শিশুদের শৈশবকালীন মৃত্যুর হার নিয়ে ইউনিসেফের জরিপ বলছে, চা বাগানে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৫৫ শতাংশ। এর মধ্যে জন্ম থেকে এক বছরের মধ্যে মৃত্যু হয় ৬৮ শতাংশ শিশুর।
এ ব্যাপারে সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. দেবপদ রায় বলেন, বাল্য বিয়ের কারণে মেয়েদের বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যেমন মায়ের উচ্চ রক্তচাপ, রক্তশূন্যতা, অপুষ্টি। এতে মা ও শিশু মৃত্যুর শঙ্কাও বেশি থাকে। এ ছাড়া বাচ্চার ওজন কম হবে, বাচ্চা পরিপক্ক হবার আগেই জন্ম হবে।
চা বাগানে বাল্য বিয়ের ব্যাপারে সিলেটের দলদলি চা বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মিন্টু দাশ বলেন, ''এখন চা বাগানে বাল্য বিয়ে কিছুটা কমেছে। আগে আরও বেশি ছিল। আমরা এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করছি।''