চা বাগানে পর্যটক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা
পর্যটন শিল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় মৌলভীবাজারকে ‘পর্যটন জেলা’ ঘোষণা দেওয়ার লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করছে সরকার। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জেলায় পর্যটন শিল্পের বিকাশে এরই মধ্যে প্রাথমিক সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। সম্প্রতি এই তথ্য সংসদে জানিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী। কিন্তু সরকার যখন ‘পর্যটন জেলা’ ঘোষণার উদ্যোগ নিয়েছে ঠিক তখনই জেলায় আসা পর্যটকরা তাদের প্রধান আকর্ষণ চা বাগানে প্রবেশে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন। কিছু জায়গায় প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড দিয়ে নিষেধাজ্ঞাও দেওয়া হচ্ছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশ-বিদেশের পর্যটকরা চা বাগান দেখতে মৌলভীবাজারে আসেন। তাদেরকে এভাবে বাধা দেওয়া হলে তারা এই জেলায় আসা কমিয়ে দেবেন। আর পর্যটক কমে গেলে এ খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এছাড়া এটি পর্যটন খাতে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব ফেলবে। তবে আশার বাণী শুনিয়েছে জেলা প্রশাসন। তারা বলছেন, খুব শিগগিরই চা বাগান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে এ সমস্যার সমাধান করা হবে।
জানা যায়, প্রকৃতির লীলাভূমি মৌলভীবাজারের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখতে সারাবছর কয়েক লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে। এই বিশাল সংখ্যক পর্যটকের উল্লেখিত একটি অংশ আসেন চা বাগান দেখতে। সবুজের চাদর বিছানো এসব বাগানে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন লেক; যা বাড়তি আকর্ষণ যোগ করে। চা বাগানে সেচ দেওয়ার জন্য লেকগুলো মূলত কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা। কিন্তু চা বাগান কর্তৃপক্ষের কারণে পর্যটকরা বাগানে প্রবেশ ও ছবি তুলতে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, যা এই জেলার পর্যটন শিল্প বিকাশের অন্তরায়।
জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখলা চা বাগানের ১৮ নম্বর সেকশনের লেকে গিয়ে দেখা যায়, পরিযায়ী পাখির কলকাকলিতে মুখর চারপাশ। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো ও লেকের পানিতে ঝাঁপাঝাঁপিতে সেটি এখন অন্যরকম সৌন্দর্যে সেজেছে। এসব অতিথি পাখি, লেক ও চা বাগানের সৌন্দর্য অবলোকন করতে আগ্রহী পর্যটকরা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের সূত্রে জানা যায়, সারাদেশের ১৬৬টি চা বাগানের মধ্যে ৯২টি মৌলভীবাজারে। পর্যটকদের অভিযোগ, এইসব চা বাগান ও বাগানের ভেতরের লেক এবং তার সৌন্দর্য থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হয়। মাঝে মধ্যে বাগানের প্রবেশমুখে দায়িত্বরতদের হাতে লাঞ্চনারও শিকার হওয়ার অভিযোগই তুলেছেন কেউ কেউ।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার রেহানা বাগানের লেকে ফুটেছে মনোরম পদ্মফুল। সবুজ চাবাগানের মধ্যে লাল পদ্ম দিয়েছে অন্যরকম আমেজ। সপরিবারে পদ্মফুল দেখতে গিয়েছিলেন আবদুর রব। তিনি জানান, খুব ভোরে আমরা চা বাগানে যাই, কিন্তু বাগান কর্তৃপক্ষ আমাদের ঢুকতে দেয়নি।
এদিকে, মৌলভীবাজারে যত পর্যটক আসেন তার বেশিরভাগ শ্রীমঙ্গলে আসেন চা বাগান দেখতে। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পাশেই ভুরভুরিয়া চা বাগান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাগান কর্তৃপক্ষ প্রকাশ্যে সাইনবোর্ড টানিয়ে পর্যটক প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এমনকি ছবি তুলতেও বারণ করছে।
বিষয়টি পর্যটকদের বিমুখ করছে বলে মনে করছেন শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংস্থার সভাপতি আবু সিদ্দিক মোহাম্মদ মুছা। তিনি জানান, পর্যটকরা চা বাগান দেখতেই ‘চায়ের দেশে’ আসেন। তারা ফিরে গেলে এই এলাকার পর্যটন খাতের বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকরী পদক্ষেপের আশা করছেন তিনি।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। গ্রীনলিফ গেস্ট হাউজ অ্যান্ড ইকো ট্যুরিজমের পরিচালক এস কে দাশ সুমন জানান, চা বাগান কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে পর্যটকরা প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাগানে ঢোকার অনুমতি না থাকায় পর্যটকরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। আমরা মনে করি এটি এখানকার পর্যটন শিল্পের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিষয়টি এই এলাকার পর্যটন খাতে দীর্ঘ মেয়াদি প্রভাব ফেলবে।
নিসর্গ ইকো রিসোর্টের পরিচালক শামসুল হক জানান, পর্যটকরা আমাদের অনেক সময় জানান যে, তারা বাগানে প্রবেশ করতে পারেননি। এতে তারা কষ্ট নিয়ে ফিরে যান। চা বাগান ও চা ফ্যাক্টরি নিয়ে বিদেশি পর্যটকদের প্রচুর আগ্রহ রয়েছে। আমরা অনেকবার বাগান মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে কোনো লাভ হয়নি।
অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ (সিলেট ভ্যালি) চা সংসদের চেয়ারম্যান জি এম শিবলি বলেন, চা বাগান একটা ইন্ডাস্ট্রি। এখানে পর্যটনের জন্য সাধারণ জনগণকে ঢুকতে দিলে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে।
‘‘যদি একজন দর্শনার্থী একটি করে চা গাছের ডাল বা পাতা ছিঁড়ে, দিন শেষে তা আমাদের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সরকারী নীতিমালাতেই আছে চা বাগানে অন্য কিছু করা যাবেনা, এর মানে পর্যটনের জন্যও ব্যবহার করা যাবেনা।’’
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক নাজিয়া শিরিন জানান, ‘‘চা বাগানে পর্যটক প্রবেশে প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে আমি শুনেছি। আমরা বাগান মালিক ও ম্যানেজারদের সঙ্গে আলাপ করে শিগগিরই পর্যটকদের প্রবেশের ব্যবস্থা করবো। পর্যটকদের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করা হবে।’’