চীনে ধূমপানের ইতিহাস: দুশ্চিন্তা দূরকারী উদ্ভিদ থেকে বিষাক্ত তামাক
ষোলো শতাব্দীতে 'নতুন দুনিয়া'য় (নিউ ওয়ার্ল্ড) তামাকগাছের সঙ্গে পরিচয় হয় ইউরোপীয়দের। এরপরই তাদের হাত ধরে গোটা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে ধূমপান। এখন পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই, এমন সম্ভব অ্যান্টার্কটিকায়ও, পাওয়া যায় সিগারেট ও ধূমপান-পণ্য। এখনকার দিনে আর আগের মতো তামাক পাতা শুকিয়ে ধোঁয়া টানা হয় না। আজকের দুনিয়ায় ধূমপান চলে নানা উপায়ে—সিগারেট, ভেপ, মডস। এখন এমনকি 'বৈদ্যুতিক নিকোটিন ডেলিভারি সিস্টেম'ও এসেছে ধূমপানের জন্য।
এই নতুন পদ্ধতিতে ধূমপানের সমর্থকদের দাবি, এতে প্রথাগত ধূমপানের চেয়ে কম ক্ষতি হয় এবং ধূমপায়ীদের ধূমপান ছাড়তে সাহায্য করে। বিরোধীরা এ দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের বিশ্বাস, এটা নতুন প্রজন্মকে নিকোটিনে আসক্ত করতে তামাক কোম্পানিগুলোর নতুন চাল।
চীনে তামাকের আগমন ঘটে মিং রাজবংশের জিয়াজিং যুযগে (১৫২২-১৫৬৬)। দেশটিতে তামাক গিয়েছিল ফিলিপাইন থেকে। সে সময় ফিলিপাইন ছিল স্পেনের উপনিবেশ। স্প্যানিশরাই দেশটিতে তামাক নিয়ে আসে। কয়েক দশকের মধ্যেই চীনের তামাক চাষের পরিমাণ ফিলিপাইনকে ছাড়িয়ে যায়। চীনা তামাক তখন স্প্যানিশ কলোনিতে রপ্তানি হতে থাকে।
অচিরেই চীনে বিপুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ধূমপান। এ জনপ্রিয়তার আংশিক কারণ, চীনাদের ধারণা ছিল যে তামাক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। নারী ও শিশুরাও ধূমপান শুরু করে। শরীরে উদ্দীপনা ও আরামের ভাব এনে দেওয়ার পাশাপাশি অনেকেরই বিশ্বাস ছিল, ঠান্ডা ও জ্বরের মতো কিছু রোগ নিরাময় করতে পারে তামাক। ১৭ শতাব্দীর এক চিকিৎসাবিদ্যার বইয়ে তামাক সম্পর্কে লেখা আছে, 'এই ওষধি উদ্ভিত দুশ্চিন্তা দূর করতে সাহায্য করে।'
তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই তামাক ব্যবসা খুব লোভনীয় বাণিজ্য হয়ে ওঠে। ইউরোপে যখন তামাক চাষ শুরু হয়, প্রায় সে সময়ই চীনের শানদং প্রদেশের একটি এলাকায় বিপুল পরিমাণে তামাক চাষ হচ্ছিল। ওই অঞ্চলে ৪০০ শ্রমিক তামাক চাষে নিয়োজিত ছিল। ওই অঞ্চলে তামাক বিক্রি করে বছরে আয় হতো ৭৫ টন রুপা।
কিন রাজবংশের কাংজি যুগের (১৬৬২-১৭২২) বইপত্র ঘেঁটে জানা গেছে, সে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকরা ৬০০ গ্রাম প্রক্রিয়াজাত তামাকের বিনিময়ে একটা ঘোড়া দিয়ে দিত। রাশান সীমান্তরক্ষীরা ছোট তিন-চার থলে চীনা তামাক কিনত একটা ষাঁড়ের বিনিময়ে।
তবে শিগগিরই চীনে তামাক সেবনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাজানি হয়ে যায়। সতেরো শতকের শেষ দিকে লেখা চিকিৎসাবিদ্যা ও উদ্যানবিদ্যার ওপর লেখা কিছু বইয়ে 'বিষাক্ত গাঁজা' টানার বিরূপ প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। ওসব বইয়ে বলা হয়েছে, গাঁজা টানলে শরীর পানিশূন্য হয়ে পড়ে, ফুসফুস জ্বলে যায়। ফলে ধূমপায়ীর গলাব্যথা কাশি হয়—এমনকি কণ্ঠস্বরও নষ্ট হয়ে যায়।
ওষুধের নিরাময় ক্ষমতার ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে ধূমপান। যারা নিয়মিত ধূমপান করেন, তাদের আয়ুষ্কাল কমে যায়।
চীনে ধূমপানের ওপর প্রথম নিষেধাজ্ঞা জারি করেন মিং বংশের শেষ শাসক, সম্রাট চংঝেন। ১৬৩৯ সালে, নিজের শাসনকালের দ্বাদশ বছরে এ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তিনি। বলা হয়, তিনি শিশুদের একটা ছড়া শুনে ধূমপান নিষিদ্ধ করেছিলেন। ওই ছড়ায় বলা হয়েছিল, একটা সাম্রাজ্যের ওপর বিদ্রোহীদের ধূমপানের ধোঁয়া গলগল করে উড়ছে।
তারপর কিন রাজবংশ ও পরবর্তী শাসকরা ধূমপান নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করেন। নিষেধ ভঙ্গের শাস্তি ছিল ভয়াবহ। মোটা জরিমানা থেকে শুরু করে চাবুকপেটা, এমনকি শিরশ্ছেদও করা হতো অনেকের। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জারি করেও চীনে ধূমপান বন্ধ করা যায়নি।
বর্তমানে চীনে ধূমপায়ীর সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি, যা দেশটির মোট জনসংখ্যার বিশ শতাংশের বেশি। এ সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্বের মোট ধূমপায়ীর এক-তৃতীয়াংশই চীনা। এই বদভ্যাস চীনের জন্য বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
- সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট