টাইটানিকের রেপ্লিকা বানাচ্ছে চীন
১৯১২ সালে 'দ্য আনসিংকেবল' বা কোনোদিন ডুববে না, দাবি করা জাহাজ টাইটানিক তার প্রথম যাত্রায়ই আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যে বরফপিন্ডের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে গিয়েছিল। আধুনিক ইঞ্জিনিয়ারিং প্রযুক্তিতে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ভেবে নির্মিত জাহাজটি ডুবে যাওয়ায় সেদিন ১৫০০ এরও বেশি যাত্রীর নির্মম মৃত্যু ঘটে।
এরপর থেকে টাইটানিকের করুণ পরিণতির গল্প হয়ে উঠেছে এক কিংবদন্তী। আর এর জন্য হলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতা জেমস ক্যামেরনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। কারণ ক্যামেরনই টাইটানিক ট্র্যাজেডি অবলম্বনে লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও-কেট উইন্সলেট জুটিকে নিয়ে ১৯৯৭ সালে ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র 'টাইটানিক' নির্মাণ করেন।
অন্যদের মতো, চীনা বিনিয়োগকারী সু সাওজুনও খুব সম্ভবত টাইটানিক জাহাজ এবং ক্যামেরনের টাইটানিক চলচ্চিত্রের বিরাট ভক্ত। আর সে কারণেই বেশ কয়েক বছর আগে সু ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি টাইটানিকের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই দুর্ভাগা জাহাজের বিশাল বড় এক রেপ্লিকা নির্মাণ করবেন। সংবাদ সংস্থা এএফপি সূত্র জানায়, সে সময় সু বলেছিলেন 'আমরা টাইটানিককে নিয়ে একটা জাদুঘর বানাচ্ছি।'
চীনের সিচুয়ান প্রদেশে অবস্থিত 'রোমানডিসিয়া থিম পার্ক' এর মূল আকর্ষণ হবে ২৬০ মিটার লম্বা এই জাহাজটি। খুব শীঘ্রই পার্কটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। ২০০০ ইউয়ানের বিনিময়ে দর্শনার্থীরা এই জাহাজে রাত্রি যাপন করতে পারবেন।
সু জানিয়েছেন, তার বানানো রেপ্লিকা টাইটানিকের স্টিম ইঞ্জিন ফাংশনের কারণে যাত্রীদের মনে হবে যে তারা আসলেই সমুদ্রের মধ্যে রয়েছে। যদিও তার এই জাহাজ সমুদ্রে চলাচলের যোগ্য নয় বলে এটিকে নদীতীরেই থামিয়ে রাখা হবে। মজার বিষয় হলো এই যে, এই রেপ্লিকা জাহাজের দরজার হাতল থেকে ধরে কেবিনের নকশা পর্যন্ত আসল টাইটানিকের আদলে করা হয়েছে। সেই সাথে বিনোদন পার্কের ট্যুর বাসগুলোতেও বাজতে থাকবে সেলিন ডিওনের গাওয়া বিখ্যাত গান 'মাই হার্ট উইল গো অন'।
জেমস ক্যামেরনের ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্র 'টাইটানিক' ইউরোপ-আমেরিকার মতো চীনেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
তবে ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিল, টাইটানিক ট্র্যাজেডির ১০৯তম বার্ষিকীর আগেরদিন পরিচালক আর্থুর জোন্সের বানানো একটি প্রামাণ্যচিত্র মুক্তি পাওয়ার পর নতুন করে চীনে টাইটানিকের ব্যাপারে হইচই তৈরি হয়। টাইটানিক থেকে বেঁচে ফেরা ছয় চীনা নাগরিকের ভাগ্যে কি ঘটেছিল তা নিয়েই ছিল সেই প্রামাণ্যচিত্র।
রোমানডিসিয়া পার্কে টাইটানিকের পূর্ণাঙ্গ রেপ্লিকাটি চীনের অ্যামিউজমেন্ট পার্ক শিল্পে একটি বড় আকর্ষণ হতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। অ্যামিউজমেন্ট পার্ক খাতে বিশ্বে চীনের অবস্থান সবার ওপরে। ২০১৮ সালে এইসিওএম চায়না থিম পার্ক পাইপলাইন রিপোর্টে অনুমান করা হয়েছিল যে ২০২০ সালে চীন ২৩০ মিলিয়ন পরিদর্শককে পার্কগুলোয় স্বাগতম জানাবে এবং টিকিট বিক্রির মাধ্যমে ১২ মিলিয়ন ডলার আয় হবে।
কিন্তু মহামারির কারণে এই খাতের ব্যবসা ধীর হয়ে যায়, কারণ চীনা নাগরিকদের এখনো দেশের বাইরে ভ্রমণের অনুমতি খুবই সীমিত।
তবে এর আগে কেউ কেউ টাইটানিকের রেপ্লিকা বানানোর এ প্রকল্পটির সমালোচনা করেছেন। এত বড় একটি দুর্ঘটনাকে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে রূপদানকে 'অসংবেদনশীল' বলে উল্লেখ করেছেন। ২০১৭ সালে চীনা বিনিয়োগকারী যখন ব্রিটিশ টাইটানিক সোসাইটিতে এসে তার পরিকল্পনার কথা জানা, তখনও কিছু সদস্য একে 'খারাপ পছন্দ' বলে অভিহিত করেন।
জ্য লেগ-এর বাবা আসল টাইটানিকের একজন তত্ত্বাবধানকারী ছিলেন। লেগ বিবিসিকে বলেন, 'বাবা যদি জানতেন যে টাইটানিকেরও রেপ্লিকা করা হচ্ছে, তিনি কবর থেকেই জেগে উঠতেন! তারা টাইটানিক ট্র্যাজেডিকে ব্যবসার জন্য ব্যবহার করছে যা খুবই দুঃখজনক।'
বিবিসির এক সূত্র জানায়, সু'র থিম পার্কের মূল পরিকল্পনা ছিল কৃত্রিমভাবে বরফপিন্ডের সঙ্গে সংঘর্ষের একটি অনুভূতি দেয়ার ব্যবস্থা রাখা। কিন্তু পরে তা বাতিল করা হয়।
সোসাইটির সদস্য ডেভিড স্কট-বেডার্ড বলেন, 'সু আমাদের কথা দিয়েছিলেন যে এসব বিষয় সাবধানতার সঙ্গেই নজর রাখা হবে। জাহাজটি পুরোপুরি বানানো হয়ে গেলে বোঝা যাবে যে তারা আসল জাহাজের নির্মাণশৈলীকে কতটা অনুকরণ করতে পেরেছে। টাইটানিক নিয়ে যাদের আগ্রহ, তাদের সামনে টাইটানিক ও নিহতদের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখারও একটি উপায় হবে এটি'।
সু'র জাহাজ নির্মাণ শুরু হয়েছিল ছয় বছর আগে। ২০১৯ সালে শেষ হবার কথা থাকলেও জাহাজটির নির্মাণ কাজ এখনো চলছে। পাঁচ মিলিয়নের মতো দর্শনার্থী থিম পার্কে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে এর বাড়তি ব্যয় বেড়েছে ১ বিলিয়ন ইউয়ান (১৫৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার)। সু বলেন, 'আমি মনে করি এই জাহাজ এখানে আগামী ১০০/২০০ বছর টিকে থাকবে'।
তবে এএফপি সূত্র জানায়, কারো কারো মতে, এই জাহাজটিও ২০০৮ সালে ইউএসএস এন্টারপ্রাইজের বানানো রেপ্লিকার মত চালু হবার কিছুদিন পরেই পরিত্যক্ত হবে।
অস্ট্রেলিয়ান বিলিওনিয়ার ক্লাইভ পালমারও ২০১২ সাল থেকে টাইটানিক-২ বানানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এই জাহাজটি সমুদ্রে চলার উপযোগী করেই বানানোর কথা রয়েছে। ২০১৬ সালে কাজ শেষ হবার কথা থাকলেও এখন জাহাজটির নির্মাণ কাজ ২০২২ সালের মধ্যে শেষ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
- সূত্র- ডয়েচে ভেলে