ডিপ্রেশনের যত ধরন
মানুষের জীবনে উত্থান-পতন খুব স্বাভাবিক একটি বিষয়। জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে গিয়ে বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতা হয় আমাদের; বদলে যায় মানসিক অবস্থা। কখনো কখনো খুব হাসি-আনন্দে থাকি, আমার কখনো গভীর দুঃখবোধ ও অবসাদ ঘিরে ফেলে আমাদের। সাধারণত, এই মন খারাপের অনুভূতি কয়েকদিন কিংবা বড়জোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই উধাও হয়ে যায়। তখন আবার নতুন উদ্যমে জীবনের পথে ফিরে আসি আমরা। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন, যাদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো খুব একটা সহজ হয়ে ওঠেনা। তাদের ক্ষেত্রে এই দুঃখ-হতাশাবোধ দীর্ঘতর হয় এবং দৈনন্দিন জীবনে খারাপ প্রভাব ফেলে। সেখান থেকেই জন্ম নেয় ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা।
আমরা আশেপাশে পরিচিত অনেক মানুষকেই দেখি, হুট করে সবকিছু থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেকে, নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলছে। রোজকার জীবনে তার মনোযোগও নেই। কেমন যেন একটা নির্মোহ-নির্বিকার ভাব দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে। এইসবের পেছনে ডিপ্রেশনের বড় ভূমিকা থাকে। সবার ক্ষেত্রে ডিপ্রেশনের ধরন ও প্রভাব এক নয়। ডিপ্রেশনের পেছনে কারণভেদে এর উপসর্গ ও সেরে ওঠার প্রক্রিয়াও ভিন্ন হয়।
ডিপ্রেশনের ধরনকে মূলত ৬ ভাগে ভাগ করা যায়।
১। মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (এমডিডি)
মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডারকে ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনও বলা হয়। অধিকাংশ মানুষের মধ্যে এই ধরনের ডিপ্রেশন সবচেয়ে বেশি লক্ষ্য করা যায়। যারা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভুগেন, আশেপাশের সবকিছু নিয়ে সারাক্ষণই তাদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করে। এদের কারো কারো হয়তো খুব ভালো একটা চাকরি আছে, পরিবার আছে; তবুও তারা আনন্দে থাকতে পারছেন না। আবার এমনও হয়, কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই তারা হতাশায় ভুগছেন! কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কিছু উপসর্গ হলো:
-একসময় যেসব কাজে আনন্দ পেতেন, সেগুলোর উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
-ওজন পরিবর্তন
-ঘুমের রুটিনে পরিবর্তন
-শ্রান্তি
-সারাক্ষণ নিজেকে অপদার্থ মনে হওয়া এবং অপরাধবোধ
-মনোযোগের অভাব
-মৃত্যু ও আত্মহত্যার চিন্তা আসা
২। ডিসথিমিয়া বা পারসিসটেন্ট ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার (পিডিডি)
ডিপ্রেশন যদি দুই বছরের বেশি সময় স্থায়ী হয়, তখন তাকে পিডিডি'র শ্রেণীতে ফেলা যায়। এই ধরনের ডিপ্রেশন সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয়। দীর্ঘদিন যাবত হতাশায় থাকার ফলে তারা দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে করতে পারেন না। অন্যদের সাথে সম্পর্কে জটিলতা তৈরি হয়। এর উপসর্গগুলোও তুলনামূলকভাবে গুরুতর।
-গভীর দুঃখবোধ বা নৈরাশ্য
-আত্মমর্যাদাবোধ কমে যাওয়া
-অক্ষমতাবোধ
-বিভিন্ন বিষয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা
-ক্ষুধায় পরিবর্তন
-দুর্বলতা বোধ বা ঘুমের ধরনে পরিবর্তন
-স্মৃতিশক্তি কমতে থাকা ও মনোযোগের অভাব
-সামাজিকভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা
৩। পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন (পিপিডি)
মাতৃত্ব নিঃসন্দেহে একজন নারীর জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। কিন্তু একই সময়ে নারীর দেহে বড় ধরনের হরমোনজনিত পরিবর্তনের ফলে, তাদের মন-মেজাজেও পরিবর্তন আসে। গর্ভকালীন সময়ে বা সন্তান জন্মের পর একজন নারীর মধ্যে হতাশা আসতে পারে যা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন নামে পরিচিত। প্রায়ই পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনকে 'বেবি ব্লু' এর সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু সত্যি বলতে, এই দুটি সমস্যার ধরন আলাদা। পোস্টপার্টাম বেশি গুরুতর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। পোস্টপার্টামের সময় যে উপসর্গগুলো দেখা দেয়:
-মন খারাপ থাকা
-বাইরের জগত থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা
-সন্তানের সঙ্গে বন্ধন গড়ে উঠতে সমস্যা
-ক্ষুধায় পরিবর্তন
-অসহায়বোধ ও নৈরাশ্য
-উদ্বেগ ও প্যানিক অ্যাটাক
-নিজের বা সন্তানের ক্ষতি করার চিন্তা
-আত্মহত্যার চিন্তা
৪। ম্যানিয়াক ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিপ্রেশন
এ ধরনের ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে টানা বিষণ্ণতাবোধ এবং পরে ব্যক্তির মধ্যে অদ্ভুত ও অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ্য করা যায়, যা 'ম্যানিয়া' নামে পরিচিত।একটি নির্দিষ্ট সময় ডিপ্রেশনে কাটানোর পর কারো মধ্যে যদি সাত দিনের বেশি ম্যানিয়া দেখা যায়, তাহলে সে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত বলে মনে করা হয়। এর উপসর্গগুলো নিম্নরূপ:
-দুঃখবোধ বা শূন্যতা অনুভব
-প্রাণশক্তি কমে যাওয়া
-শ্রান্তি-অবসাদ
-ঘুমের সমস্যা
-বিরক্তিবোধ
-আত্মমর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাওয়া
৫। অ্যাটিপিক্যাল ডিপ্রেশন
অ্যাটিপিক্যাল ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে, কোনো ইতিবাচক অভিজ্ঞতা লাভ করলে সাময়িকভাবে ডিপ্রেশন দূর হয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আশেপাশের মানুষ বুঝতে পারেনা যে আপনি ডিপ্রেশনে আছেন। কারণ এসময় অনেকেই বাইরে নিজের দুঃখবোধ প্রকাশ করেন না, বরং হাসিমুখে ঘুরে বেড়ান। অ্যাটিপিক্যাল ডিপ্রেশনের উপসর্গগুলো হলো:
-অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়া বা ওজন বেড়ে যাওয়া
-অতিরিক্ত ঘুম
-শ্রান্তি বা দুর্বলতা
-প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে না পারা
-তীব্র প্রতিক্রিয়াশীলতা
-বাহ্যিকভাবে ভঙ্গুরতা
-বিভিন্ন ধরনের ব্যথা ও যন্ত্রণা
৬। সিজনাল অ্যাফেক্টিভ ডিসঅর্ডার
সিজনাল ডিপ্রেশন আসলে প্রত্যেক ঋতুর সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। কোনো ব্যক্তি হয়তো একটি নির্দিষ্ট ঋতুতে হতাশায় ভুগে, কিন্তু বছরের বাকি সব সময় স্বাভাবিক থাকে। মৌসুমী ডিপ্রেশন সাধারণত শীতকালেই বেশি দেখা যায় এবং শীত বাড়ার সাথে সাথে তা তীব্রতর হয়। এ ধরনের ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে যেসব উপসর্গ দেখা যায়:
-সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্নতা
-অতিরিক্ত ঘুম
-ওজন বৃদ্ধি
-দুঃখ, নৈরাশ্য ও বিষাদবোধ
- সূত্র: টাইমস অফ ইন্ডিয়া