তারকা ও ধনীদের বিচ্ছেদ শুধুই ‘ট্রেন্ড’, নাকি সমাধানও?
সাম্প্রতিক সময়ে খ্যাতনামা এবং অতি ধনী ব্যক্তিদের বিচ্ছেদের মাত্রা যে হারে বেড়েছে তা বিচ্ছেদের অর্থ সম্পর্কে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে মনে।
বিগত কয়েক বছরের এমন বিচ্ছেদের মধ্যে কয়েকটি ছিল সৌজন্যসূচক কিংবা 'ছদ্ম-সৌজন্যসূচক'। এই তালিকায় আমরা রাখতে পারি বিলিওনেয়ার বিল ও মেলিন্ডা গেটস এবং আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ও ম্যাকেঞ্জি স্কট দম্পতির নাম। একই বিষয় বিলিওনেয়ার তারকা কিম কার্দাশিয়ান এবং গায়ক কানিয়ে ওয়েস্টের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলা যায়। তবে হলিউড তারকা ব্র্যাড পিট ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলির লম্বা সময় ধরে চলতে থাকা বিচ্ছেদের নাটকীয়তা এবং অভিভাবকত্ব নিয়ে লড়াইয়ের মত ঘটনাও নিশ্চিতভাবে রয়েছে।
আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হারিয়ে ফেলাকেই মনে করা হচ্ছে আপাতদৃষ্টিতে সফল, বিত্তশালী এসব মানুষের জীবনের অশান্তির কারণ। কিন্তু এসব অনুমিত প্রশ্নের অনুমিত উত্তরই মিলছে শেষ পর্যন্ত।
জনপ্রিয় ও সফল জুটিদের বিচ্ছেদের পেছনের কারণ হিসেবে বেরিয়ে আসছে নানা রকম তত্ত্ব। অনেকে ভাবেন, বেজোসের সাবেক স্ত্রী, ম্যাকেঞ্জি স্কট বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছেন। কারণ বিচ্ছেদের মাধ্যমে প্রথমে আমাজনের ৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মালিকানা লাভ করেছেন ম্যাকেঞ্জি এবং তারপরেই ড্যান জেওয়েট নামের এক সাদাসিধা, নিতান্ত ভালোমানুষ স্কুল শিক্ষককে বেছে নিয়েছেন জীবনসঙ্গী হিসেবে।
কিন্তু সত্যি বলতে এসব ক্ষমতাধর জুটির বিচ্ছেদের কারণ আর দশটা সাধারণ জুটির মতোই সংকীর্ণ।
লস অ্যাঞ্জেলসের আইনজীবি লরা ওয়াজার কাজ করেছেন জোলি এবং কার্দাশিয়ানের মামলা নিয়ে। তার মতে, বিচ্ছেদ 'সমতা আনার' একটি দারুণ উপায়। ওয়াজার সম্প্রতি বিচ্ছেদ নিয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে 'ইট'স ওভার ইজি' নামক অনলাইন ব্যবসা খুলে বসেছেন।
গত সপ্তাহে আয়োজিত একটি অনলাইন ফোরামে তিনি মেরিল লিঞ্চ -এর সাবেক সিইও স্যালি ক্রচেককে বলেন, 'আমাদের বিচ্ছেদের কাজটা করতে হবে এমনভাবে যেন পুরো প্রক্রিয়ার সময় আপনি মানসিকভাবে এবং আর্থিকভাবে ভেঙে না পড়েন।'
ওয়াজারের ভাষ্যে, 'যখন মানুষ মাত্র ৪০ বছর বাঁচত, তখন আমৃত্যু একসাথে থাকার তত্ত্ব অনেক সোজা ছিল। কিন্তু এখন মানুষ আরো অনেক বছর সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে থাকছে, কাজ করছে। তাই তারা জোর করে কারো সঙ্গে থাকতে চায় না। তারা ৭০ বছর বয়সে এসেও জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায়।'
ওয়াজার নিশ্চিত করলেন যে বর্তমানে যেসব বিচ্ছেদের খবরে তোলপাড় শুরু হয় এবং পত্রিকার পাতায় শিরোনাম হয়, তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার এবং সৌজন্যসূচকভাবে এই সম্পর্কের ইতি টানার একটি 'ট্রেন্ড' তৈরি হয়েছে।
'তারকাদের জন্য তারা যত বেশি নিজেরা মিটমাট করে নেবে, ততই এটি জনসম্মুখে কম আসবে। আজকাল সমাজের মানুষ তারকা এবং ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের জীবন দেখে এবং তা অনুকরণ করতে চায়। এত বিত্তশালী-খ্যাতিমানদের বিচ্ছেদ হলে আমারটায় সমস্যা কি- এরকম একটি ট্রেন্ড এখন বেশ জনপ্রিয়', বললেন ওয়াজার।
লরা ওয়াজার মনে করেন, আদালতে 'কালো আলখাল্লা পরা' এক ব্যক্তিকে নিজের ও সন্তানদের ভবিষ্যত ঠিক করতে দেয়াটা সর্বোত্তম উপায় নয়।
নিউইয়র্কের 'ডিন অফ ডিভোর্স' নামে পরিচিত, রাউল ফেলডারের ধারণা, আমেরিকায় মহামারি প্রকোপ কমতে থাকায় মানুষ এখন নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইছে। ফলে কোভিড সম্পর্কিত বিচ্ছেদের মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে।
ফেলডার বলেন, 'এটা আসলে এতদিনের অবদমিত ইচ্ছা, যার বাঁধ এখন ভেঙে গিয়েছে। আপনি ভাবতে পারেন এমন একটা মানুষের সঙ্গে বছরখানেক এক ঘরে থাকা, যাকে আপনি শুরু থেকেই কাছে চাইতেন না? তাদের সম্পর্কের সেই পুরনো জাদু শুকিয়ে এসেছে, তারা এখন নতুন করে আনন্দ পেতে চাইছে।'
ডিভোর্সের হার বেড়ে যাওয়ায় আইনজীবিরা যে খুশি হচ্ছেন তা বলাই বাহুল্য। ফেলডার জানালেন, এখন তাদের ব্যবসা আগের চেয়ে ২০ গুণ বেশি। কিন্তু তার কাছে ডিভোর্সের হার মাধ্যাকর্ষণের মতো, একবার যা তরতর করে উপরে উঠলেও পরে আবার নিচে নামবেই।
কিন্তু ফেলডারের কাছে হাই প্রোফাইল ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিচ্ছেদ একটা চুক্তির মত, 'তাদের চুক্তি আগে থেকেই আছে, এখন শুধু শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে যেন তার ধারগুলো চকচকে করা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন দুটো কর্পোরেশনের বিচ্ছেদ হচ্ছে। একই কথা চলচ্চিত্র তারকাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।'
লস অ্যাঞ্জেলসের আরেক ডিভোর্স অ্যাটর্নি কেলি চ্যাং রিকার্ট বলেন, 'কেউই জানেনা কেন গেটস দম্পতি বিচ্ছেদ চাইছেন, কিন্তু আমি নিশ্চিত যে এর মধ্যে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ইস্যু রয়েছে। আপনি যত ধনী লোককে বিয়ে করবেন, সে ততই নিজের মর্জিমতো চলতে চাইবে। তারা সম্পর্কের প্রতিজ্ঞা রক্ষার ক্ষেত্রে খুব একটা বাধ্য নয়।'
রিকার্ট এও মনে করেন যে, কেউ যদি ডিভোর্স হয়েছে এমন বন্ধুবান্ধবের সংস্পর্শে বেশি থাকে, তারও একই অবস্থা হতে পারে। এটা অনেকটা ছোঁয়াচে রোগের মত!
তবে বিত্তশালীদের সম্পর্কের ইতি টানার ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থার অভাব নেই। দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল যখন সর্বপ্রথম জেফ্রি আপস্টেইনের সঙ্গে বিল গেটসের সম্পর্ক নিয়ে মেলিন্ডা গেটসের তিক্ত অনুভূতির কথা জানায়, সেই মুহূর্তে বিল ক্যালিফোর্নিয়ার এক বিলাসবহুল রিসোর্টে ছিলেন বলে খবর পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে এও বলা হয় যে, বিল গেটস তার বন্ধুদের কাছে বারবার জানিয়েছেন যে, মেলিন্ডার সঙ্গে তার ২৭ বছরের সম্পর্কে কোনো ভালোবাসা ছিল না।
জেফ বেজোস তার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্কের ইতি টেনেছেন লরেন সানচেজ নামের এক হেলিকপ্টার পাইলটের প্রেমে পড়ে। বিচ্ছেদ পরবর্তী আমোদ-প্রমোদে বেশ ব্যস্ত থাকতে দেখা গিয়েছে বেজোসকে। কিছুদিন আগেই তিনি ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে একটি অত্যাধুনিক ইয়ট কিনেছেন।
তবে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের যতই ধনসম্পদ থাকুক না কেন, প্রতিটি বিচ্ছেদের পেছনেই থাকে তাদের একান্ত ব্যক্তিগত কারণ ও অভিজ্ঞতা। তাই তাদের বিচ্ছেদের প্রকৃত কারণ নির্ণয় প্রায় অসম্ভব।
সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ রেইনি হাওয়ার্ড মনে করেন, 'মহামারি একটি অন্যতম কারণ। সম্পর্ক যদি আগেই খারাপের দিকে থাকে, মহামারির বছরে তা চরম পর্যায়ে গিয়েছে। আগে বা পরে হোক, সম্পর্কের যে বিশৃঙ্খলা আপনি এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন, একদিন না একদিন তার মুখোমুখি আপনাকে হতেই হবে।'
- সূত্র- দ্য গার্ডিয়ান