তিন বছর, তিন স্বপ্ন এবং একটি সিরীয় শৈশব
ফাতিমার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ২০১৩ সালে।
ওর তখন ১০ বছর বয়স। থাকে জর্ডানের ছোট্ট শহর মাফরাকের একটি ছাদে; বাবা-মায়ের সঙ্গে। বোবা ও কালা বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান সে।
এর এক বছর আগে, সিরিয়ার যুদ্ধমুখর হোমস শহরের বাবা-আমর এলাকা থেকে পুরো পরিবার পালিয়ে এসেছে। শুধু কিছু জামা-কাপড় কাঁধে নিয়ে, রাতের বেলা, বাসে চড়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিল ওরা। চলে এসেছে সিরীয় সীমান্তের ঠিক অন্য পারে, মাফরাক শহরে।
'প্রথমে সোজা গিয়ে, দ্বিতীয় রাস্তার বাঁকে ডান দিকে ঘুরে, এগিয়ে যেতে হবে'- কাগজে আঁকা এমন মানচিত্র সঙ্গী করে, গাড়ি চালিয়ে আমি জর্ডানের রাজধানী আম্মান থেকে ওখানে পৌঁছেছি। রাস্তাগুলোর কোনো নাম ছিল না। ছিল না আমার কাছে জিপিএস।
তবু কোনো না কোনোভাবে আমি সেই সমাজকর্মীর অফিসটি পেয়ে গেলাম, যিনি আমাকে ফাতিমার কাছে নিয়ে গেলেন। ভাড়া করা গাড়ি থেকে বাইরে পা ফেলতেই ঘেমে মুখ লাল হয়ে গেল আমার। দেখি, ঘামে ভেজা ধূসর মুখে হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটি।
কোনো রকম কুশল বিনিময় না করে, সিমেন্টে বাঁধা সিঁড়ি বেয়ে, আমাকে সে মরচে ধরা একটা ধাতব দরজা ঠেলে নিয়ে গেল ছাদে; এটাই তার ঘর। কংক্রিটের ছাদের ঠিক মাঝখানে, গরমে ভরা এক রুমের একটা খুপরি।
শুকোতে দেওয়া জামা-কাপড় মৃদু বাতাসে দুলছিল। ছাদের ওপর থেকে শহরটির একটি ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ আমাদের দেখাল ফাতিমা। উত্তর দিকে, ফাতিমার দেশের দিকে আমরা তাকিয়ে রইলাম।
ওদের থাকার জায়গায় কোনো পানি বা বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। তবে ওর মা ছোট্ট একটা গ্যাস স্টোভে পানি গরম করে আমাদের চা বানিয়ে দিলেন।
'আমার মা-বাবা কথা বলতে পারেন না। তাই কেউ এখানে এলে আমিই কথা বলি। ফোন এলে আমিই ধরি', বলল ফাতিমা। আর পাশে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকা বাবা-মাকে বোঝাল ইশারাভাষায়।
তাদের পক্ষে দুনিয়ার সঙ্গে তাদের কন্যার যোগাযোগ করা, সব মিলিয়ে এই পরিবারের একের অন্যের ওপর কতটা মমতা- সহজেই বোঝা যাচ্ছিল।
জাতিসংঘের দেওয়া খাদ্যের রশিদ দেখিয়ে পরিবারের জন্য বাজার করে আনে ফাতিমাই; প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পানি আনার দায়িত্বও সে-ই সামলায়। এ এক মমতায় ভরা, দারুণ পারিবারিক বন্ধন।
ফাতিমার স্বপ্ন
দড়িতে বেঁধে রাখা প্লাস্টিকের কাপ ও পিংপং বল নিয়ে ফাতিমা যখন আনমনে খেলছিল, ওর মুখে ধীরে ধীরে ভেসে উঠেছিল চিন্তার ভাঁজ।
'আমার একা লাগে। সময় কাটানোর জন্য একটা ভাই থাকলে ভালোই হতো।'
একটা ধাতব পানির ট্যাঙ্কের ওপর ওকে বসিয়ে আমি ছবি তুললাম। পাশেই ওর একটা খেলনা পুতুল। আমাকে সে শোনাল, নিজেদের গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় কী কী স্বপ্ন দেখত; কৃষি খামারের পাশেই ছিল তাদের বড় একটা বাড়ি; আর তার কাছেই ছিল অন্যান্য পরিবার।
'আমার স্কুলটা খুবই সুন্দর ছিল। কত কী যে পড়েছি, কিন্তু সব ভুলে গেছি', বলল সে। পরিবারটির অস্থায়ী ঘর থেকে ভেসে আসছিল গরম বাতাস; সবকিছুতে ধুলোর স্তর পড়ে গেছে সেখানে।
কেন সে স্কুল হারাল? সকল শরণার্থী শিশুর পড়াশোনা নিশ্চিত করতে অক্লান্ত খেটে যাচ্ছে মানবাধিকার এজেন্সিগুলো। তারপরও যাদের বাবা-মা অক্ষম, এমন প্রচুর শিশু এখনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারছে না। কেননা, সংসারে কাজ করতে হয় তাদের।
শান্ত গলায় ফাতিমা আমাকে বলল, 'সিরিয়ায় যখন ছিলাম, ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম আমি। সেখানেই কাটাতে চেয়েছিলাম সারাটা জীবন।'
১০ বছর বয়সী এই দারুণ মেয়েটির পক্ষে ওই স্বপ্ন সত্য করা কঠিন ছিল বলে মনে হয়নি আমার।
তিন বছর পর...
তিন বছর পর আরেকটি কাজে ফাতিমাকে খুঁজে বের করলাম চেষ্টা চালালাম। জানলাম, ওরা আর আগের ঠিকানায় নেই; তবে এক সমাজকর্মীর সহায়তায় ওদের খোঁজ পেলাম। ওরা তখন মাফরাক জেলার রিবা'আ গ্রামে থাকে।
আমাকে দেখে লাজুক হাসিমুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ফাতিমা।
বলল, 'নিজের জীবন নিয়ে আমি খুশি। এখন আমাদের একটা বড় বাড়ি হয়েছে। জর্ডানের এই বাড়িওয়ালা আমাদের প্রতি খুব সদয়; প্রতি দুই মাসে মাত্র এক মাসের করে ভাড়া দিতে হয়।'
ওদের আগের থাকার জায়গার তুলনায় এটা বেশ ভালো পরিবেশ। পানি, বিদ্যুতের ব্যবস্থা আছে; ঘরে আছে ফ্রিজ ও টেলিভিশন। গর্ব নিয়ে নিজের শোবার ঘর আমাকে দেখাল সে। দেখাল, পর্দার পাশে ঝুলে থাকা তার রঙিন জামা-কাপড়।
'আমরা ভালোই আছি। সকিছু ঠিকঠাক চলছে। বাবা-মা আমার প্রতি খুব দয়ালু। ইশারাভাষায় আমাদের বোঝাপড়াও বেশ ভালো এখন। এরচেয়ে ভালো কিছু তাদের পক্ষে আর হতে পারে না।'
তিন বছরে ওর বাবা-মায়ের বয়স যে বেড়ে গেছে, সেটা স্পষ্ট। বাবার চুল এখন পুরোপুরি সাদা। মেয়ে যখন কথা বলছিল, মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন তারা।
কিন্তু ফাতিমা এখনো একটা নতুন জানালা, নতুন দৃশ্যপট খুঁজছে; কেননা, ওর সেই পুরনো স্বপ্ন এখনো অধরা।
'আমি পড়তে পারি না, লিখতে পারি না। এমনকি টেক্সট মেসেজও পাঠাতে পারি না। আমার ভালো লাগে না। আমার সঙ্গী-সাথীরা লিখতে পারে, পড়তে পারে; আমি পারি না। আমার এটা ভালো লাগে না। ওরা মাঝে মধ্যে এ নিয়ে হাসাহাসি করে', বলল সে।
'আমার মূল স্বপ্ন- সিরিয়ায় ফিরে যাওয়া। দ্বিতীয় স্বপ্ন- বাবা-মাকে কথা বলতে শেখানো। তৃতীয় স্বপ্ন- ডাক্তার হওয়া। কিন্তু এর একটাও সত্য হবে বলে মনে হয় না আমার।'
এর পর কেটে গেছে আরও তিন বছরেরও বেশি সময়। যখনই ফাতিমার ছবিগুলোর দিকে তাকাই, অবাক হয়ে ভাবি, মেয়েটি এখন কী করছে: স্কুলে যাওয়ার এত যে ইচ্ছে ওর, ও কি পেয়েছে খুঁজে কোনো স্কুল? নাকি এখনো জানালার বাইরে তাকিয়ে ডুবে যাচ্ছে কোনো দিবাস্বপ্নে- যা কোনোদিনই বাস্তব হবে না?
- লেখক: ফ্রিল্যান্স ফিল্মমেকার ও ফটোগ্রাফার
আল জাজিরা থেকে অনুবাদ: রুদ্র আরিফ