যে থানায় ৬ মাসে মামলা হয়েছে মাত্র দুইটি!
আইনশৃঙ্খলাজনিত যে কোনো ঘটনায় মানুষকে ছুটতে হয় থানায়। শরণাপন্ন হতে হয় পুলিশের। এরপর ভুক্তভোগীরা আশ্রয় নেন আইনের। স্পর্শকাতর ও বড় কিছু ঘটলে করা হয় সরাসরি মামলা। ফলে থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের একদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ বজায় রাখতে হয়, অন্যদিকে ব্যস্ত থাকতে হয় বিভিন্ন ধরনের মামলা নিয়েও।
কিন্তু পার্বত্য জেলা বান্দরবানে একটি ব্যতিক্রম থানা থানচি; যেখানে মামলার কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় না পুলিশকে। কিছু ঘটলেও স্থানীয়ভাবে সমাধান করে ফেলেন এলাকাবাসী নিজেরাই। থানা-পুলিশ ও আদালত পর্যন্ত আর গড়ায় না।
থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুদ্দিন আনোয়ার জানান, বছরে গড়ে পাঁচ-ছয়টার বেশি মামলা হয় না। যে কয়টি মামলা হয় তাও মাদকসংক্রান্ত। খুব বড় কিছু না ঘটলে কেউ থানায় মামলা করতে আসেন না। এরপরও পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে তৎপর রয়েছে।
'কোনো সময় মাসের পর মাস একটা জিডি (সাধারণ ডায়েরি) পর্যন্ত হয় না। জায়গা-জমি বিরোধের কোনো মামলা নেই। এ বছর জুন পর্যন্ত দুটি মাত্র মামলা হয়েছে। তাও মাদকসংক্রান্ত' যোগ করেন তিনি।
ওসি সাইফুদ্দিন আরও বলেন, মামলা হয় না বলে আমরা বসে থাকি না। আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে কমিউনিটি পুলিশিং কাজ করছে। স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে কাজ করছি আমরা।
রাঙ্গামাটি জেলার অধীনে ১৯৬৯ সালে থানচি থানা প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে বাঁশের বেড়া দিয়ে তৈরি ছিল থানা কার্যালয়। বর্তমানে গণপূর্ত বিভাগের উদ্যোগে ২০১৮ সাল থেকে একটি দৃষ্টিনন্দন চারতলা ভবণ নির্মাণের কাজ চলছে। জেলা সদর থেকে থানচির দূরত্ব ৮৫ কিলোমিটার।
উপজেলা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানান, ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী থানচিতে মোট ২১ হাজার জনসংখ্যা রয়েছে। থানচি সদর, বলিপাড়া, তিন্দু ও রেমাক্রি এই চারটি ইউনিয়ন নিয়ে থানচি উপজেলা। এর মধ্যে তিন্দু ও রেমাক্রি দুই ইউনিয়ন এখনও পুরোপুরি মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন এলাকা। উপজেলার প্রত্যেকটি এলাকা একদিকে দুর্গম, অন্যদিকে পাহাড় ও বনাঞ্চলবেষ্টিত।
তবে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ তাজিংডং, তিন্দুমুখ বড় পাথর, নাফাকুম লেক, সংরক্ষিত সাঙ্গু রিজার্ভ বন, ঝিরি-ঝরণা ও ঘন বনজঙ্গল ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের সব জায়গা এই থানচিতে অবস্থিত। এছাড়া মারমা, চাকমা, তঞ্চঙ্গ্যা, বম, ত্রিপুরা, খুমী, ম্রো এবং খিয়াং আটটি পাহাড়ি সম্প্রদায় মিলে একটি নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্যও রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুল হক মৃদুল বলেন, মামলা কম মানে অপরাধপ্রবণতা কম। অনাবিল প্রকৃতির সাথে সহাবস্থান এলাকাবাসীদের শান্তিপ্রিয় করে তুলেছে। এছাড়া পাহাড়িদের নিজেদের মত করে সামাজিক বিচার ব্যবস্থা থাকায় থানায় মামলার দিকে ঝুঁকছেন না তারা।
উপজেলা চেয়ারম্যান থোয়াইহ্লামং মারমা বলেন, সরাসরি সড়ক যোগাযোগ না থাকায় একসময় অনগ্রসর এলাকা হিসেবে পরিচিত ছিল থানচি। সে সময় যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নদীপথে থানচি আস্তে তিন দিন সময় লাগত। থানচিতেও এখন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে।
অন্যদিকে, থানচিতে দেশের দুই বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও, আঞ্চলিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নেতাকর্মীরাও সক্রিয় রয়েছে। দলের আদর্শ ও বিশ্বাস ভিন্ন হলেও কোনো বিরোধের জেরে তা কেউ মামলার পর্যায়ে নিয়ে যায় না। রাজনৈতিক দলের এ ধরনের সহাবস্থানকেও মামলা কম হওয়ার কারণ বলে মনে করেন দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।
জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান- দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, যে এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কম, সেখানে মামলাও হয় কম। তাছাড়া থানচির বেশির ভাগ এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দুর্গম এলাকা। থানায় এসে মামলা করা এবং নিয়মিত পরিচালনা করা সহজ ব্যাপার নয়।
তাছাড়া এলাকায় কিছু ঘটলেও পাহাড়িদের ঐতিহ্যগত প্রথা কারবারি ও হেডম্যানের মাধ্যমে সমাধান হয়ে যায়। তবে শুধু থানচি নয় রোয়াংছড়ি, রুমা এবং সদর থানাতেও মামলা কম হয়, বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।