পদ্মা না কি গঙ্গার ইলিশ? কোন ইলিশে স্বাদ বেশি?
পৃথিবীর যেখানে বাঙালির দেখা মিলবে, সেখানেই আছে ইলিশের কদর। বাঙালির এই ইলিশ প্রীতি টের পাওয়া যায় বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ আর পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপূজার সময়। তবে পদ্মা আর গঙ্গার ইলিশের মধ্যে কোন ইলিশের স্বাদ বেশি, তা নিয়ে দুই বাংলায় আছে বহু বিতর্ক।
কলকাতায় বলে গঙ্গার ইলিশে দুনো স্বাদ, পদ্মার ইলিশে ঊণ। এদিকে বাংলাদেশের মানুষও কম যায় না। যে অঞ্চলের মানুষ 'খেয়ে এসেচ না গিয়ে খাবে' বলে কুটুম্বিতা করে, বাজারে গিয়ে ৫০ গ্রাম মাছ কিনতে চায় তারা আবার ইলিশের স্বাদ বুঝবে কী করে?
'ইলিশ পুরাণ' বইয়ে দিগেন বর্মন লিখেছেন, গঙ্গার ইলিশের চেয়ে পদ্মার ইলিশে তেল বেশি। সদ্যপ্রয়াত লেখক বুদ্ধদেব গুহ নাকি একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, "ঢাকা থেকে বন্ধুর পাঠানো ইলিশ খেয়ে কলম ঠিকমতো ধরতেই পারছি না। ইমপোর্টেড পদ্মার ইলিশের তেলে কলম পিছলে যাচ্ছে।"
'পদ্মা নদীর মাঝি' সিনেমার শুটিং করতে এসে আট মাস বাংলাদেশে ছিলেন পশ্চিম বাংলার অভিনেত্রী রূপা গাঙ্গুলি। সেসময়কার কথা স্মরণ করে একবার রূপা বলেন, "পদ্মার ইলিশ বহুদিন খেয়েছি। সারা দিন-রাত তো ইলিশই খেতাম। ভালো ইলিশে মুখ পচেনা আমার। তবে আমি কিন্তু গঙ্গার ইলিশের ফ্যান। কেন বেশি ভালো লাগে বুঝি না, হয়তো সাইকোলজিক্যাল।"
রুপার কথা সত্যি। মনস্তাত্ত্বিক কারণে পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ মানুষ হয়তো গঙ্গার ইলিশকেই সেরা বলবে। তবে দূষণের কারণে গঙ্গায় এখন আর আগের মতো ইলিশ ধরা পড়ে না। প্রতি বছরই পশ্চিমবঙ্গে কয়েক হাজার টন ইলিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশ। অন্যদিকে, গঙ্গার ইলিশ খাওয়ার সুযোগ না হলেও বাংলাদেশের মানুষ হয়তো এক কথায় পদ্মার ইলিশকেই সেরা ঘোষণা করে বসবে।
কিন্তু বিষয়টি কি পুরোপুরিই মনস্তাত্ত্বিক? সীমান্তের কাঁটাতারই বা ইলিশের স্বাদে কী এমন ফারাক তৈরি করে? স্বাদের বিষয়টি আপেক্ষিক হলেও গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের স্বাদের পার্থক্যের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। ইলিশের স্বাদ নিয়ে মৎস্যবিজ্ঞানীদের সেই ব্যাখ্যাই জানব আজ। সেই সঙ্গে থাকবে হাতেকলমে হিসাব কষে সবচেয়ে সুস্বাদু ইলিশ খুঁজে বের করার চেষ্টা!
আরও পড়ুন- কেন ১,৩০০ কিলোমিটার সাঁতরে বাংলাদেশে আসে ইলিশ?
গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশে পার্থক্য কী?
গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশ দুটোর উৎসই বঙ্গোপসাগর। সরকারি তথ্যমতে বাংলাদেশে তিন ধরনের ইলিশ পাওয়া যায়। এগুলো হলো: সাধারণভাবে পরিচিত ইলিশ, চন্দনা ইলিশ এবং গুর্তা ইলিশ।
অন্যদিকে, গঙ্গার ইলিশ দুধরনের। ছোট আকারের খোকা ইলিশ ও বড় ইলিশ। ছোট ইলিশকে পশ্চিমবঙ্গের অনেক জায়গায় খয়রা বা পিল মাছও বলা হয়। খয়রার চেয়ে কিছুটা বড় মাঝারি আকারের ইলিশ পশ্চিমবঙ্গে কোকিলা ইলিশ নামে বিক্রি করা হয়ে থাকে।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন বাংলাদেশের পদ্মা-মেঘনার ইলিশ পশ্চিমবঙ্গের কোলাঘাট বা ডায়মণ্ড হারবারের ইলিশের চেয়ে বেশিই উজ্জ্বল হয়।
তবে দুধরনের মাছেরই স্বাদই ডিম ছাড়ার আগে সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের আকারেও তেমন কোনো পার্থক্য নেই।
ইলিশের স্বাদে পার্থক্য কেন?
মাছ কী খাচ্ছে তার ওপর নির্ভর করে স্বাদে পার্থক্য তৈরি হতে পারে। কিন্তু গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশ দুটোই আসে বঙ্গোপসাগর থেকে। চাষের ইলিশ নয় বিধায় দুই ইলিশই সাগরে একই ধরনের খাবার খেয়ে থাকে।
পেটে ডিম আসলেই সমুদ্রের ইলিশ স্রোতের বিপরীতে গঙ্গা ও পদ্মার দিকে ছুটে। দুই নদীতে এবার খাবারও আলাদা। তাহলে নদীতে আসার পর খাবারের কারণেই কি ইলিশের স্বাদে ভিন্নতা আসে? মজার বিষয় হলো লোনা পানি ছেড়ে মিষ্টি পানিতে উজান বেয়ে যাওয়ার সময় ইলিশ তেমন কিছু খায় না। এসময় ইলিশ সমুদ্রে জমানো চর্বি কাজে লাগায়।
সাগরে থাকা অবস্থায় ইলিশ মূলত প্ল্যাঙ্কটন খায়। প্ল্যাঙ্কটন ছাড়াও ওয়াটার ফ্লি এবং প্রচুর বালি ও কাদা গিলে থাকে এই ইলিশ। খাদ্যাভাসের কারণেই ইলিশের দেহে প্রচুর তেল জমে এবং বিশেষ এক গন্ধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু নদীর ইলিশ ও সমুদ্রের ইলিশের স্বাদে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। বলা হয় সমুদ্রের ইলিশের গন্ধ হলো পেট্রলের মতো!
সমুদ্র থেকে ইলিশ যত বেশি নদীর দিকে আগাতে থাকে, ততই তাদের তেল ভাঙতে থাকে। স্যাচুরেটেড এই ফ্যাট ভেঙে পলি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড বা পুফায় বদলে যায়। মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, ইলিশের স্বাদের মূল কারণ এই পুফা। সমুদ্রের ইলিশের যত বেশি মেদ থাকবে, তারা তত দ্রুত নদীতে পাড়ি দিতে পারবে। আর তত বেশি ফ্যাট ভেঙে বাড়বে তার স্বাদ।
তেল ছাড়াও এই সাঁতারের কারণে ইলিশের পেশি শিথিল হয়ে নরম হয়ে আসে। একইসঙ্গে সমুদ্র থেকে যত দূরে যাবে, তত বেশি পুরোনো বর্জ্য শরীর থেকে বের হয়ে ইলিশ তাজা হবে। কমে যাবে তার লবণাক্ততাও। অর্থাৎ সহজ কথায় যে ইলিশ যত বেশি পথ পাড়ি দিবে, তার স্বাদও তত বাড়বে।
আরও পড়ুন- লক্ষ্মীপুরে পুকুরে ধরা পড়েছে ১০ ইলিশ, পুকুরে আছে আরো ইলিশ!
কোন ইলিশে স্বাদ বেশি?
এখন তাহলে আসল বিষয়ে আসা যাক। প্রশ্ন হলো কোথায় যেতে ইলিশকে বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়।
এই বিষয়ে আসার আগে আরও কিছু বিষয় জানা জরুরি। গঙ্গার মূল প্রবাহটিই পদ্মা হিসেবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে, ফারাক্কার কাছে গঙ্গার শাখা ভাগীরথী-হুগলি নামে পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
ইলিশ সাধারণত ১,৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত পথ পাড়ি দিতে পারে। একটা সময় ছিল যখন পদ্মার ইলিশ মূল গঙ্গা ধরে পাটনা, বেনারস, এলাহাবাদ এমনকি আগ্রা পর্যন্ত পৌঁছে যেত! কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের জন্য সেখানে ইলিশ চলাচল বন্ধ। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গে এখন গঙ্গার ইলিশ চাইলে হুগলি নদীর মাছই খেতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে ইলিশ এবং কোলাঘাট পরস্পরের সমার্থক। কোলাঘাটের রূপনারায়ণ নদ কিছু দূরে গিয়ে হুগলিতে পড়ে। এখানকার বড় বড় ইলিশ আড়ত থেকে একসময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ইলিশের চালান যেত। সমুদ্র থেকে কোলাঘাটের দূরত্ব খুব বেশি নয়। ইলিশের আরেক আড়ত হুগলি তীরের ডায়মন্ড হারবার সমুদ্রের আরও কাছে। মোটামুটি সমুদ্র থেকে ১০০ কিলোমিটারের ভেতরই এখানে ইলিশ ধরা পড়ে।
এদিকে বাংলাদেশে পদ্মার ইলিশের সবচেয়ে বড় আড়ত চাঁদপুরে। সমুদ্র উপকূল থেকে চাঁদপুরের দূরত্ব ২০০ কিলোমিটারেরও বেশি। পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল এখানে। অর্থাৎ, চাঁদপুর পার হয়ে পদ্মায় যেতে ইলিশকে হুগলির তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি পথ পাড়ি দিতে হয়। সুতরাং, তাত্ত্বিকভাবে পদ্মার ইলিশই যে সেরা তা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ রইল না!
তবে, পদ্মার বাঁকা পথে এখনও ইলিশ ভারতে পাড়ি দেয়। নিমতিতা থেকে ফারাক্কা বাঁধ পর্যন্ত গঙ্গায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ধরা হয় ইলিশ। পদ্মা পাড়ি দিয়ে গঙ্গায় যাওয়া এই ইলিশের স্বাদ চাঁদপুরের ইলিশ চেয়ে স্বাদে-গন্ধে ভালো হবে তা ধরে নেওয়া চলে! তবে এত কম ইলিশে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পেট-মন কোনোটাই যে ভরে না তা নিশ্চিত।
ফারাক্কার জন্যই কি গঙ্গার ইলিশের স্বাদ কমল?
পশ্চিমবঙ্গের লেখক-সাহিত্যিকদের বক্তব্যে গঙ্গার ইলিশের যে সুনাম উঠে এসেছে সেগুলো সম্ভবত তিন দশক আগের অভিজ্ঞতার আলোকে বর্ণনা করা।
১৯৭৮ সালে ফারাক্কা বাঁধে নেভিগেশন লক চালুর পর ইলিশের স্বাভাবিক চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই ভারতে ইলিশ কম ধরা পড়তে শুরু করে। বিহার ও উত্তর প্রদেশের সীমান্তে সর্বশেষ ৩২ বছর আগে ইলিশ ধরা পড়ে।
সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিশারিজ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষা অনুযায়ী, ফারাক্কা বাঁধ স্থাপনের পর থেকে উজানের দিকে ইলিশের প্রজনন এখন প্রায় বন্ধ। বাঁধ টপকে গঙ্গার উজানে ইলিশ প্রবেশ করতে না পারায় এই পরিস্থিতি।
ইলিশের জীবন পানি ঘিরে। আর সেই পানি দিতেই ভারতের যত কৃপণতা। ফারাক্কা বাঁধের জন্য বাংলাদেশে পদ্মার নাব্যতা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান ইলিশ বিপর্যয় যেন খোদ ইলিশেরই অভিশাপ।
তবে ইলিশ চলাচলের সুবিধার্তে ২০১৯ সালে ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে ফারাক্কায় নতুন নেভিগেশনাল লকগেট স্থাপনের উদ্যোগ নেয় ভারত সরকার। নতুন লকগেটের জন্য উজানে ইলিশ চলাচলের পরিধি বাড়ে কি না, সেটাই দেখার বিষয়।
আরও পড়ুন- ভারতে ইলিশ রপ্তানির সময় বাড়ল
গঙ্গার দূষণ আর হুগলির প্রবেশ পথে পলিমাটির জন্য ভারতের মোহনায় এখন ইলিশ খুব একটা প্রবেশ করে না। ফারাক্কার নতুন লকগেটের কারণে ভারতবাসী যে সুস্বাদু ইলিশ খাওয়ার স্বপ্ন দেখছে সেগুলোও বাংলাদেশের বুক পাড়ি দিয়েই ভারতে যাবে। ইলিশের যেহেতু ভিসা-পাসপোর্টের বালাই নেই তারা সেটা করতেই পারে। কিন্তু ইলিশ যদি স্বেচ্ছায় দূষণ এড়িয়ে চলে সেক্ষেত্রে কোনো লকগেটেই কাজ হবে না। দূষণের বিষয়টি শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। নদী বাঁচলে, বাঁচবে ইলিশ। তাই পদ্মা হোক বা গঙ্গা, ইলিশ রক্ষার সঙ্গে নদী রক্ষার সংকল্পও জরুরি।
সে যাই হোক, স্বাদে-গন্ধে পদ্মার ইলিশই যে এখন সেরা সেটাই ছিল আমাদের মূল কথা।
বিশ্বের যে ১১টি দেশে ইলিশ ধরা হয় তার মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশ্বের ৮৬ শতাংশ ইলিশের যোগান দেয় বাংলাদেশ। অন্যদিকে, ভারত থেকে আসে মাত্র ১০ শতাংশ ইলিশ। জি-আই (ভৌগলিক নির্দেশক) পণ্য হিসেবে বাংলাদেশের ইলিশের সুনাম এখন বিশ্বজুড়েই।
তবে পদ্মার ইলিশের স্বাদ বেশি এই বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের নাখোশ হওয়ার কিছু নেই। ইলিশ সজ্ঞানে অর্থাৎ নিজে সাঁতরে ওপাড়ে না গেলেও ইলিশের চালান ঠিকই যাচ্ছে। আর তাই বাজার থেকে কিনেও পদ্মার ইলিশের স্বাদ নেওয়া যাবে।
স্বাদের ক্ষেত্রে কিন্তু রন্ধন কৌশলও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সবচেয়ে বড় কথা স্বাদের আসল পরীক্ষা ভোজন রসিকের জিভে। আর তাই গঙ্গা ও পদ্মার ইলিশের স্বাদের প্রকৃত পার্থক্য জানতে চাইলে দুধরনের ইলিশ একসঙ্গে রান্না করে নিজেই চেখে দেখুন।
তথ্যঋণ:
টেমস-এর উজানে পদ্মার ইলিশ, শুদ্ধব্রত দেব
ইলিশ পুরাণ, দিগেন বর্মন