পৃথিবীর কি আরও মানুষ দরকার?
বৈশ্বিক জনসংখ্যা হ্রাস নিয়ে আমাদের কতটুকু উদ্বিগ্ন হওয়া উচিৎ? পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে উর্বরতা হার ১ শতাংশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও নিচে নেমে এসেছে। একইভাবে, ইউরোপেও মূল জনসংখ্যা কমছে। যুক্তরাষ্ট্রে উর্বরতা হার ইতিহাসের সর্বনিম্ন বা ১.৭ শতাংশে নেমে আসে ২০১৯ সালে- যা এমনকি মৃত্যুর কারণে কমে যাওয়া জনসংখ্যা ঘাটতি পূরণের অবস্থান হারিয়েছে। ২০২০ সালে কোভিড মহামারির কারণে এই হার আরও কমেছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
সমস্যাটি শুধু উন্নত দেশের নয়, বরং বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশেও জন্মহার নজিরবিহীন মাত্রায় পতন লক্ষ্য করছে। একটি পূর্বাভাস অনুসারে, ২১০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শূন্যে গিয়ে ঠেকবে।
৭শ' কোটির বেশি মানুষের পদভারে বিচলিত আজকের পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে জনসংখ্যা অতিরিক্ত মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের দু'পেয়ে প্রজাতির সংখ্যা কমলে তা পৃথিবীর পরিবেশের জন্যও মঙ্গলজনক হবে বলে মনে করা হয়। তাই এ আভাসকে অনেকে স্বাগতই জানাবেন। তবে আমার সহকর্মী রবিন হ্যানসনের মতো বিশেষজ্ঞরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে জানাচ্ছেন, পড়তি জনসংখ্যার নেতিবাচক পরিণতির নিজস্ব যুক্তিও আছে। যেসব যুক্তি অপরিবর্তনীয় এবং পরিণাম সুদূরপ্রসারী। যেমন; জাপানের জনসংখ্যা যদি অর্ধেক কমে সাড়ে ছয় কোটিতে নেমে আসে- তাহলে সেটি যে আরও কমতে কমতে একসময় ৩ কোটি বা ২ কোটি হবে না- তার নিশ্চয়তা কী?
ইতোমধ্যেই, কিছু প্রমাণ মিলেছে যে, জনসংখ্যার পড়তি হার বিশ্ব অর্থনীতির জন্য শুভ নয়। তবে আমার কাছে মনে হয়, এই অবস্থার মধ্যে পৃথিবীর জীবনধারণের যে পূর্ণ সক্ষমতা আছে আমাদের সেটি নির্ধারণ করা উচিৎ। সেই অনুসারে পরিবার পরিকল্পনার দরকার নেই, তবে প্রয়োজন আছে বড় পরিবার গঠনকে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা।
ক্রম-হ্রাসমান জনসংখ্যা নিজে নিজেই পাল্টা ব্যবস্থা বা জনসংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে কাজ করবে এমন সম্ভাবনা নিয়েও অবশ্য আলোচনা আছে। যেমন; জাপানের জনসংখ্যা অর্ধেক কমার অর্থ হবে দেশটি বর্তমানের চাইতে অনেক ফাঁকা হবে, ফলে কমবে জমির দাম। সুলভ মূল্যে টোকিও মহানগরীর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে বড় আকারের অ্যাপার্টমেন্ট কেনার সুযোগ পাবে অনেক দম্পতি। এতে তারা বেশি সন্তান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতেও উৎসাহী হতে পারেন। অর্থাৎ, বসবাসের পরিবেশ নির্বাচনে আর্থিক স্বচ্ছলতা তৈরি করবে জনহার বৃদ্ধির সহযোগী মনোভাব।
তবে এই প্রক্রিয়াটি আসলে জনসংখ্যা ঘাটতি পূরণের বদলে আরও কমানোর পক্ষেই কাজ করবে। কারণ, শুধু বসবাসের জায়গা নয়, পরিবারের আকার নির্ধারণে আরও অনেক অনুঘটক কাজ করে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, জনসংখ্যা কমলে নতুন আবাসন তৈরিতে বাণিজ্যিক মুনাফা কমবে। ফলে পুঁজিবাজারে দরপতনের শিকার হবে আবাসন কোম্পানিগুলো, এটি তাদের নতুন প্রকল্পে বিনিয়োগের উৎসাহ ও পুঁজি সক্ষমতা দুটি দিককেই নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে দেখা যায়, আসলে বড় পরিবারের উপযোগী বসবাসের জায়গা দীর্ঘমেয়াদে খুব বেশি বাড়বে না।
জনসংখ্যা প্রবণতা নির্ভর করে মূলত উর্বরতা হার কতোটা স্থায়ীভাবে কমছে বা বাড়ছে তার উপর। এখন অনেক নারীই সন্তানধারণের চাইতে কর্মজীবন বা ক্যারিয়ারের উন্নতিকে প্রাধান্য দেন। জন্মহার কমার সেটাও বড় কারণ। একই যুক্তিতে জাপান বা ইতালির মতো দেশের জনসংখ্যা হ্রাসকে ব্যাখ্যা করা যায়।
তবে পড়তি জনসংখ্যার আরেকটি কারণ হলো উর্বরতা হ্রাস; যুক্তরাষ্ট্রে এর পেছনে প্রধান কারণ সিঙ্গেল প্যারেন্ট বা একক অভিভাবকদের সংখ্যা বৃদ্ধি। নিজে নিজে সন্তান পালনকারী একজন নারী- জীবনসঙ্গী না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একবারের বেশি গর্ভধারণ করতে চান না। এখন কথা হলো জনসংখ্যা কমলে কী এমন একক মায়েদের নিয়ন্ত্রিত পরিবারের সংখ্যা কমবে? না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। কারণ, বিবাহযোগ্য পুরুষের অভাব, অস্থিতিশীল পারিবারিক জীবনের ঝুঁকি বা ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দের কারণেই অধিকাংশ নারী একাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, জনসংখ্যা হ্রাসের যুগে রাতারাতি এসব কারণ মিলিয়ে যাবে- এমনটা হওয়ার কোনো যুক্তি নেই।
ছোট পরিবার বৃদ্ধির পেছনে দায়ী এই কারণগুলো আসলে অব্যাহত থাকবে বা ক্ষেত্র বিশেষে আরো জোরদার হবে। নারীদের জন্য মানসম্মত চাকরির সুযোগও বাড়তে থাকবে। আরেকটি বড় কারণ সম্পদ বৃদ্ধি। এই সম্পদ বৃদ্ধি হয়েছে বিশ্বজুড়ে- ধনী ও দরিদ্র দেশ সবখানেই। অনেক দেশ এখন আগের তুলনায় অনেক সম্পন্ন। সম্পদ বাড়ার কল্যাণে হ্রাস পেয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার প্রবণতা। অতীতে ধর্মীয় নীতিমালার কারণেই বেশি সন্তান নেওয়ার উৎসাহ ছিল।
উর্বরতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে আর অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো কী? হয়তো প্রযুক্তির বিকাশও এর বড় কারণ। অচিরেই হয়তো দেখা যাবে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পরিচালিত স্নেহময়ী রোবটেরা মানব সন্তানদের পালন করছে। রোবটের সাহায্য থাকায় তখন সন্তান নেওয়ার আগ্রহও হয়তো বাড়তে দেখা যাবে। হয়তো জনসংখ্যার নাটকীয় পতনের ঘটনায় অনেক দেশের অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখেও পড়বে, তখন হয়তো দম্পতিরা অনুভব করবে বড় পরিবার গঠনের তাগিদ। এই ভবিষ্যৎবাদের অতি-কল্পনার ডালপালা আরেকটু মেললে ক্ষতি কী! হয়তো সামনেই সেই যুগ- যেখানে অর্থের বিনিময়ে জনশূন্য পৃথিবীর বিশাল সব অঞ্চল শিশুদের লালন-পালনের জন্যে ইজারা নেবে কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা। বিনিময়ে শিশুরা বড় হয়ে যে আয় করবে- তার একটি অংশ মুনাফা হিসেবে আদায় করবে।
পৃথিবী যেদিকে যাচ্ছে, তাতে এমন ভবিষ্যৎ দেখা দেবে না- তা জোর দিয়ে কে বলতে পারেন! তবে উপকথার মতো এসব সমাধানের মতো পথ চেয়ে বসে না থাকাই ভালো। সিঙ্গাপুরের মতো অনেক দেশ অন্তত তাই বর্তমানের বাস্তবসম্মত সমাধানের পথে হাঁটছে। দেশটির সরকার আগ্রাসীভাবে গ্রহণ করেছে পরিবার সহযোগী প্রণোদনার কর্মসূচি। যদিও তাতে খুব একটা ফলও মিলছে না।
সার্বিকভাবে জনসংখ্যা পতন আজ বৈশ্বিক সমস্যা; ধনী দেশে এই সমস্যা বেশি। এনিয়ে খুব বেশি আলোচনা তো হচ্ছেই না, ফলদায়ক সমাধানের পদক্ষেপ চোখে পড়ছে তার চেয়েও কম। কোনো এক বছরে কোনো একটি দেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়া হয়তো বড় কোনো ঘটনা নয়, কিন্তু তা নিয়ে স্বস্তি পাওয়ারও কারণ নেই। বছরের পর বছর ধরে এমন পতন চলতে দিয়ে আসলে আমরা সমগ্র মানব জাতির জন্যই ব্যতিক্রমী এক ভবিষ্যৎ তৈরি করছি।
-
লেখক: ব্লুমবার্গের মতামত কলামিস্ট টাইলার কোয়েন জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার লেখা একটি বহুল সমাদৃত বই "দ্য কমপ্লেসেন্ট ক্লাস: দ্য সেলফ- ডিফিটিং কোয়েস্ট ফর দ্য আমেরিকান ড্রিম।" - ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত