পৃথিবীর সবচেয়ে নৈরাশ্যবাদী শহর পুয়োলঙ্কা
একেক শহর একেক কারণে বিখ্যাত হয়। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া বিখ্যাত হলিউডের জন্য, লন্ডন বিখ্যাত তার রাজকীয় অবকাঠামোগুলোর জন্য, এবং কলকাতা বিখ্যাত তার সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোর জন্য। ফিনল্যান্ডের শহর পুয়োলঙ্কা খ্যাতি লাভ করেছে একটি অদ্ভুত বিষয়ে- নৈরাশ্যবাদে।
মধ্য ফিনল্যান্ডের শহর পুয়োলঙ্কার উদ্দেশ্যে যদি রওনা হন, শহরে প্রবেশের রাস্তায় একটি হলুদ ব্যানার দেখতে পাবেন। যাতে লেখা, 'আপনি কি হারিয়ে গেছেন? পরবর্তী গন্তব্য: পুয়োলঙ্কা'। সামনে এগোলে আরেকটা ব্যানার দেখতে পাবেন। যাতে লেখা, 'পুয়োলঙ্কা এসে গেছে প্রায়। এখনো সময় আছে উল্টো ঘোরার'।
এতোটুকুতেই আপনার বুঝে যাওয়ার কথা, এই শহরের লোকজন 'নিকৃষ্ট শহর' হিসেবে নিজেদেরকে কীভাবে বরণ করে নিয়েছে!
পুয়োলঙ্কা নৈরাশ্যবাদী সংঘের নির্বাহী পরিচালক টম্মি রাজালা বলেন, "নৈরাশ্যবাদী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে একটি যুক্তি বার বার তোলা হয়। সেটি হচ্ছে, আমরা যদি বাজে কাজ করি এবং শহরের বাজে দিকগুলো তুলে ধরি, তাহলে পুয়োলঙ্কার নাম খারাপ হবে। এক্ষেত্রে আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, নাম ভালো ছিল কখন?"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হতাশাবাদের ব্র্যান্ডিং করে ভালোই আলোচনায় এসেছে পুয়োলঙ্কা। নৈরাশ্যবাদী সংঘ খুলে, নৈরাশ্যবাদী উৎসব করে, এবং এলাকার বাজে দিকগুলো তুলে ধরে ভিডিও বানিয়ে শিরোনামে এসেছে পুয়োলঙ্কাবাসী।
এই ব্র্যান্ডিংয়ের চিন্তা কীভাবে শহরবাসীর মাথায় আসলো, সে সম্বন্ধে স্থানীয় 'হতাশাবাদী' রিতা নায়কানেন বলেন, "অন্য সব শহরের নিজস্ব উৎসব আছে। কিন্তু আমাদের কিছু নেই। বাকিদের উৎসব দেখে ঈর্ষান্বিত হয়েই এই কথা মাথায় আসে আমাদের। তখন আবার একজন বলে উঠে, 'পুয়োলঙ্কায় কিছুই কাজ করে না, নৈরাশ্যবাদও করবে না।' তার কথা শুনে আমরা আরেকটু উৎসাহী হয়ে বলি, একটা নৈরাশ্যবাদী উৎসব করেই দেখি আগে।"
পুয়োলঙ্কা নৈরাশ্যবাদী সংঘ যাত্রা শুরু করেছিল প্রায় এক দশক আগে। ফিনল্যান্ডের বাকি অঞ্চলগুলোয় পুয়োলঙ্কাকে যেই দৃষ্টিতে দেখা হয়, তার প্রভাবও পড়েছে পুয়োলঙ্কাবাসীর চিন্তাধারায়।
রাজালা বলেন, "কোনো না কোনো নেতিবাচক খবরেই সবসময় শিরোনামে আসতো পুয়োলঙ্কা। কোনো পরিসংখ্যান বা র্যাংকিংয়ে পুয়োলঙ্কা হয় সবার শেষে থাকবে, অথবা শেষ থেকে দুই-তিন নাম্বারে। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয়রা এ ব্যাপারে বেশ বিরক্ত ছিল।"
রাজালার দাবি, এই শহরে থাকার হতাশাকে সইতে সইতে এখানকার জনগণ নৈরাশ্যবাদকে বরণ করে নিয়েছে, এবং এই নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে একটি কোপিং মেকানিজম বা সামাল দেওয়ার প্রক্রিয়া গড়ে তুলেছে। যে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে নৈরাশ্যবাদকে মহিমান্বিত করা শুরু করেছে স্থানীয় বাসিন্দারা।
পুয়োলঙ্কার নৈরাশ্যবাদ উৎসবটিও বেশ অনন্য। "এই উৎসবের বিশেষত্ব হচ্ছে- এটি প্রতিবছর জানুয়ারির ১ তারিখে শুরু হয়ে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ পর্যন্ত চলে," বলেন রাজালা।
"নৈরাশ্যবাদ হচ্ছে আমাদের একটি পাল্টা প্রতিক্রিয়া। আমরা হয়তো ফিনল্যান্ডের সবচেয়ে বাজে শহর, কিন্তু বাজে হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা প্রথম।"
পুয়োলঙ্কার নৈরাশ্যবাদের ব্র্যান্ডিং ইন্টারনেট জগতে ভালোই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাদের নৈরাশ্যবাদী ভিডিওগুলোর অনুসারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এসব ভিডিওতে পুয়োলঙ্কা শহরের জনসংখ্যা কীভাবে ও কেন কমছে, এই শহরে কেন কিছুই করার নেই- এরকম বিষয়গুলো বার বার উঠে এসেছে।
"সাধারণত কোন শহর বা পৌরসভার ব্র্যান্ডিং হয়ে থাকে সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে দেখিয়ে। কিংবা সে অঞ্চলে কী ধরনের সেবা আছে, এবং কেন আপনার সন্তান ও গবাদিপশু পালনের জন্য এটি খুবই মহান জায়গা, সেসবের বর্ণনা দিয়ে," বলেন রাজালা।
"নৈরাশ্যবাদের ব্র্যান্ডিং পুরোই উল্টো। আমরা এক কথা বার বার বলেও বাস্তবতা দেখাতে পারি। অন্তত কোন এডভার্টাইজিং এজেন্সির সাজানো বুলি আওড়াতে হচ্ছে না আমাদের।"
নৈরাশ্যবাদের এই ব্র্যান্ডিং কিন্তু একটি বাণিজ্যিক সিদ্ধান্তও। এ ব্যাপারে শহরের মেয়র হারি পেলতোলা বলেন, শহরের ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে 'আপনার এমন কিছু একটা থাকতে হবে যেটা দেখে মানুষ আকর্ষিত হবে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটি হচ্ছে নৈরাশ্যবাদ। বিশেষ করে নিজেদের অপমান করে বানানো এই ভিডিওগুলো খুবই কাজে দিয়েছে"।
পেলতোলা আরও বলেন, "এই শহরের নৈরাশ্যবাদ দেখে মানুষ থেমেছে এবং আশ্চর্য হয়েছে। এরপর ভ্রমণ ব্যবসায়ীরা এসেছে তাদের প্রস্তাব নিয়ে।"
পুয়োলঙ্কার এই ব্র্যান্ডিং স্বল্পকিছু পর্যটককেও শহরমুখী করেছে, যাদের প্রায় সবাই ফিনিশ। শুক্রবার দিন পুয়োলঙ্কা শহরের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় অনেক তরুণ-তরুণীকে।
নৈরাশ্যবাদের আকর্ষণে পুয়োলঙ্কা ঘুরতে আসা ফিনিশ অভিনেতা আন্তি রেয়নানেন বলেন, "নৈরাশ্যবাদ পুয়োলঙ্কার লোকজনের চিন্তাশৈলীর অংশ, কিংবা বলতে পারেন তাদের লাইফস্টাইল। বিষয়টা এমন, যেন কোনো কিছুরই কোন মূল্য নেই। কোনো কাজ করারও দরকার নেই।"
পুয়োলঙ্কার নৈরাশ্যবাদী প্রচার-প্রচারণার জনপ্রিয়তা নিয়ে খুশী হওয়ার পাশাপাশি আরেকটি অবধারিত সত্যকেও বরণ করে নিচ্ছে পুয়োলঙ্কাবাসী। সেটি হচ্ছে- পুয়োলঙ্কা একটি মৃতপ্রায় শহর। জনসংখ্যা যে হারে হ্রাস পাচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে অচিরেই একটি পরিত্যক্ত শহরে পরিণত হবে পুয়োলঙ্কা।
এই 'মৃতপ্রায়' অবস্থাও এই শহরের জনপ্রিয়তার পিছনে ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি রাজালার। তার দাবি, অধিকাংশ ফিনিশ জনগণই এরকম ছোট, নাজুক ও প্রান্তিক শহরে বেড়ে উঠেছে। যে কারণে পুয়োলঙ্কার প্রতি একটি আলাদা সহানুভূতি কাজ করে তাদের।
রাজালা বলেন, "ফিনল্যান্ডের এরকম প্রান্তিক পৌরসভাগুলোর অবধারিত পরিণতি হচ্ছে এরা ছোট হতে হতে একসময় মারা যাবে। এদের কোন ভবিষ্যৎ নেই"।
"কিন্তু একজনের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সবার অলক্ষ্যে মারা যাওয়া। ফিনল্যান্ডে অনেক ছোট ছোট শহরই মারা গেছে, বা পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। এবং কেউ তাদেরকে মনে রাখেনি। আমরাও এভাবেই মারা যাবো, কিন্তু অন্তত নৈরাশ্যবাদের জন্য মানুষ আমাদের মনে রাখবে।"
- সূত্র: বিবিসি