বাংলাদেশে সিনোফার্ম ভ্যাকসিন: যা জানা জরুরি
গতকাল চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের উৎপাদিত কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনকে জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। পশ্চিমা দেশগুলোর বাইরে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনই প্রথম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এই অনুমোদন পেল।
ইতোমধ্যেই চীনসহ বিশ্বের আরও কিছু দেশের লাখো মানুষকে এই চীনা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে।
এর আগে ডব্লিউএইচও ফাইজার, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন ও মডার্না-এ ৫ টি ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে।
আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশ তাদের স্বতন্ত্র স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী ভ্যাকসিনটির জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশও ইতোমধ্যে সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের অনুমোদন দিয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক নতুন এই ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে।
সিনোফার্মের ভ্যাকসিন কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি কতদূর?
গভমেন্ট টু গভমেন্ট (জি২জি) চুক্তির আওতায় চীন থেকে বাংলাদেশ সরকার ভ্যাকসিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
শনিবার সকালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, তারা ইতোমধ্যেই চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও যোগাযোগ শুরু করেছেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, 'আমাদের প্রতি মাসে ৫০ থেকে ৬০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োজন হবে। এটি আমাদের দেশের চাহিদা। চীন আমাদের কী পরিমাণ ডোজ সরবরাহ করবে তার ওপরও এটি নির্ভর করছে। আমরা এখন পর্যন্ত জানিনা যে তারা আমাদের কী পরিমাণ ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারবে।'
তিনি আরও বলেন, বুধবার ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের একটি চালান অনুদান হিসেবে চীন থেকে বাংলাদেশে আসবে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও জানান, ভ্যাকসিনের দামও এখনো নির্ধারণ করা হয়নি এবং তিনি জানেন না যে কবে থেকে ভ্যাকসিন আসা শুরু হবে।
জাহিদ মালেক বলেন, 'আমরা যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন পেতে চাই, কিন্তু এটি এখন আমাদের দর কষাকষি করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ওপর নির্ভরশীল।'
যারা অন্য ভ্যাকসিন নিয়েছেন তাদের কি হবে?
মহামারি, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একজন উপদেষ্টা, ডা মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন জানান, যারা ইতোমধ্যেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন নিয়েছেন, তারা আর অন্য কোনো ভ্যাকসিন নিতে পারবেন না।
যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছেন, তারা সেই একই ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ পাবেন। সরকার এখনো অন্যান্য উৎস থেকে একই অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাক্সিন আনার জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
সবাইকেই ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। যেহেতু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের স্বল্পতা রয়েছে, তাই কিছু মানুষের হয়তো দ্বিতীয় ডোজ পেতে ২/৩ দিন দেরি হতে পারে।
ডা. মোহাম্মদ মুশতাক হোসেন বলেন, 'বহু ইউরোপীয় দেশ এখন আর অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন ব্যবহার করছে না। তারা এই ভ্যাকসিনগুলো ডব্লিউএইচও-কে ফেরত দিচ্ছে। আমরা ডব্লিউএইচও-এর মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে এসব ভ্যাকসিন আনতে পারি।'
নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই জনসাধারণ তাদের ভ্যাকসিন পাবে বলে তিনি আশ্বস্ত করেন।
আগে চীনের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া কি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?
এর আগে ২০২০ সালের আগস্টে বাংলাদেশ চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেকের ভ্যাকসিনের হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এসে সরকার সহ-অর্থায়নে রাজি না হওয়ায় ভ্যাকসিনটির দেশীয় পর্যায়ের ট্রায়াল বাতিল হয়ে যায়।
খ্যাতিমান ভাইরোলজিস্ট, অধ্যাপক নজরুল ইসলামের মতে, সে সময় চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাককে বাংলাদেশে ট্রায়ালের অনুমোদন না দেওয়া একটি ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, 'তারা শুধুমাত্র ট্রায়াল চালাতে চেয়েছিল তা নয়, তারা আমাদের দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনও করতে চেয়েছিল। যদি আমাদের দেশেই তখন ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করা যেত, তাহলে এখন আমাদের ভারতের ওপর নির্ভর করে থাকতে হতো না।'
শনিবার তিনি বলেন, 'বাজারে চীনা ভ্যাকসিনের একটি ডোজের দামই অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের দ্বিগুণ। আমাদের দেশেই যদি তারা কারখানা স্থাপন করে উৎপাদনের কাজ শুরু করতো, তাহলে আমরা অনেক সস্তায় ভ্যাকসিন পেতাম। কিন্তু এখন আমরা সময়মত ভ্যাকসিন পাবো কিনা তা নিয়েই দুশ্চিন্তায় পড়তে হচ্ছে।'
অন্য কোন কোন দেশ চীনা ভ্যাকসিন কিনছে?
সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইনের মতো কিছু এশিয়ান দেশসহ আরো বেশকিছু দেশ এখন ভ্যাকসিন কেনার জন্য সিনোভ্যাকের সঙ্গে চুক্তির চেষ্টা চালাচ্ছে। এ বছরের জানুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়া চীনা ভ্যাকসিন দিয়েই তাদের গণ টিকাদান কর্মসূচি চালিয়েছে।
তুরস্কও চীনা ভ্যাকসিনের জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এছাড়াও ব্রাজিল এবং চিলির সঙ্গেও চীনা প্রতিষ্ঠানটির চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং বাহরাইনও সিনোফার্মের ভ্যাকসিনের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়েছে।
কতটা কার্যকরী এই ভ্যাকসিন?
প্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক জার্নাল 'দ্য ল্যান্সেট'-এ প্রকাশিত চীনা গবেষণায় চীনে করোনাভ্যাকের প্রথম ও দ্বিতীয় ট্রায়াল সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, গবেষণার লেখকদের একজন, ঝু ফেংকাই জানিয়েছেন, প্রথম পর্যায়ের ট্রায়ালে ১৪৪ জনের উপর এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে ৬০০ জনের উপর পরীক্ষা চালানোর পর এই ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ, এই ভ্যাকসিন জরুরি অবস্থায় ব্যবহারযোগ্য।
বিভিন্ন দেশে করোনাভ্যাক তিনটি ট্রায়ালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তুরস্ক এবং ইন্দোনেশিয়ায় লেট-স্টেজ ডেটা ট্রায়ালের অন্তর্বর্তী তথ্য থেকে জানা গেছে, ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ছিল যথাক্রমে ৯১ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশ।
ব্রাজিলের গবেষকরা প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন, তাদের ক্লিনিক্যান ট্রায়ালে ভ্যাকসিনটির ৭৮ শতাংশ কার্যকারিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু ২০২১ সালের জানুয়ারিতে আরোও তথ্য বিশ্লেষণের পর দেখা যায়, ভ্যাকসিনটির কার্যকারিতা ৫০ দশমিক ৪ শতাংশ।
এর আগে গেল নভেম্বরে একজন স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যুর পর তাদের ট্রায়াল সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। তবে পরবর্তীত সময়ে জানা যায়, স্বেচ্ছাসেবীর মৃত্যুর সঙ্গে ওই ভ্যাকসিনের কোনো সম্পর্ক নেই।
গত জুলাই থেকেই সিনোভ্যাক চীনে অধিক ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও জরুরি ব্যবহার অনুমোদনের আওতায় ভ্যাকসিনটি ব্যবহারের অনুমোদন পেয়েছে।