ব্রিটেনজুড়ে বিরল বাজপাখির ডিম চুরি ও পাচারের রহস্য কী?
অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র 'মিশন ইমপসিবল'-এর সপ্তম কিস্তিতে খ্যাতনামা অভিনেতা টম ক্রুজ ওরফে এজেন্ট ইথান হান্টকে দেখা যাবে আরও একবার মৃত্যুর মুখ থেকে নিজের প্রাণ রক্ষা করে ফিরতে।
লাইনচ্যুত এক ট্রেন কোন খাড়া পাহাড় থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছে; ট্রেনটা নিচে পড়ে গুঁড়িয়ে যাওয়ার আগেই লাফিয়ে বাহনটা থেকে নেমে পড়ে জীবন বাঁচাবেন টম ক্রুজ—এমনই এক দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য ভীষণদর্শন জায়গা খুঁজতে গিয়ে ডার্বিশায়ার পিক ডিস্ট্রিক্টে জনশূন্য এক চুনাপাথরের খনি খুঁজে পেয়েছেন লোকেশন স্কাউটরা।
তবে সেটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। ব্যাপার হলো, চুনাপাথরের খনিতে প্রবেশ করে তারা এমন এক বিপজ্জনক সত্য আবিষ্কার করেছেন, যা শুনলে আপনিও অবাক হতে বাধ্য! কারণ ডার্বিশায়ারের এই খনিতে সিনেমার শুটিংয়ের আগেই হয়ে গেছে বাস্তব জীবনেরই এই দুঃসাহসিক অভিযান।
মিশন ইমপসিবল সিনেমার হিরো ইথান হান্ট মানুষের কল্যাণে কাজ করলেও, খনিতে যারা অভিযান চালিয়েছেন তারা একেবারেই সাধারণ মানুষ।
চুনাপাথরের খনির উপর থেকে দড়ি বেধে জনৈক ব্যক্তি খনির একেবারে গভীরে নেমে গেছেন, যেখানে বাসা বেঁধেছে ব্রিটেনের সবচেয়ে সুরক্ষিত এক প্রজাতি—'পেরেগ্রিন ফ্যালকন' নামক বাজপাখি।
১৭০ ফুট নিচে দড়ি বেয়ে বাজপাখির বাসা থেকে দুইজোড়া লালচে-বাদামিরঙা বাজপাখির ডিম সংগ্রহ করে চুপিচুপি আবার উপরে উঠে গেছে শিকারি। এদিকে ঘরে ফিরে ডিম দেখতে না পেয়ে অসহায়ভাবে আকাশে চক্কর দিচ্ছে পুরুষ ও মেয়ে বাজপাখি। তাদের ডাকে ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশের আকাশ।
'পেরেগ্রিন ফ্যালকন' বাজপাখিদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুততম প্রজাতির শিকারী পাখি হলেও, মানুষ নামক অবৈধ শিকারির কাছে তার ক্ষমতা কিছুই না!
প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় শিকারীদের ধারণা ছিল, তাদের এই কুকর্ম কারও চোখে পড়বে না। কিন্তু 'রয়্যাল সোসাইটি ফর দ্য প্রোটেকশন অভ বার্ডস' আগেই বাসাটি পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য গোপন ক্যামেরা বসিয়েছিল। সেই ক্যামেরার চোখ ফাঁকি দিতে পারেনি শিকারিরা।
গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়া সেই শিকারী যে কোনোভাবেই টম ক্রুজের ধারেকাছে নেই, তা পাঠককে মানতেই হবে। বরং ৬১ বছর বয়সী অভিযুক্ত জন ফেন্টন একসময় ছিলেন কসাইখানার কর্মী। কিন্তু তিনি যে একজন চোরও বটে, তা বরাবরই অস্বীকার করেছেন।
ফেন্টনের এই কুকীর্তি ২০২০ সালে গোপন ক্যামেরায় ধরা পড়ে। ডার্বিশায়ারে ফেন্টনের প্রতিবেশীরা তাকে বর্ণনা করেছেন এমন এক ব্যক্তি হিসেবে, যিনি সুযোগ পেলেই প্রতিবেশীর সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে দ্বিধা করবেন না!
ডিম চুরি, প্রজননে বিঘ্ন ঘটানো ইত্যাদি অপরাধে সর্বোচ্চ ছয় মাসের জেল বা মোটা অঙ্কের জরিমানা হওয়ার কথা ফেন্টনের। কিন্তু শুরু থেকেই নিজের সব দোষ অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
সম্প্রতি শুধু ডার্বিশায়ারই নয়, ইংল্যান্ডের আরও কিছু গ্রাম্য এলাকায় বাজপাখির ডিম চুরির ঘটনা দেখা যাচ্ছে। গত মে মাসে বাজপাখির ডিম চুরির দায়ে পুলিশ তিন অপরাধীকে আটক করে, যার মধ্যে একজন নারী পুলিশও ছিলেন। তাদের মামলা এখনো বিচারাধীন।
নিশ্চয়ই এতক্ষণে ভাবছেন, কেন বাজপাখির ডিমের উপরেই সবার নিশানা? এই ডিমের বিশেষত্ব কি?
উত্তরটা হলো, বাজপাখির ডিমগুলো আসলে সংযুক্ত আরব আমিরাত বা সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে চোরাচালান করা হয়। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ঘোড়দৌড় বা উটের দৌড়ের চাইতেও ব্যাপক জনপ্রিয় খেলা হয়ে উঠেছে বাজপাখির দৌড় প্রতিযোগিতা। লাখ লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে বিজয়ী বাজপাখির হাতবদল হয় সেখানে।
গেল মাসে সৌদি আরবের রিয়াদে এক নিলামে একটি পিওর হোয়াইট জিরফ্যালকন প্রজাতির বাজপাখি ৩ লাখ ৩৭ হাজার পাউন্ডে বিক্রি হয়! এর মাধ্যমে গত বছরের রেকর্ড ভেঙে দেয় এটি। হিসেব করলে দেখা যায়, ৩৪ দশমিক ৫ আউন্স ওজনের পাখিটির প্রতি আউন্সের মূল্য ধরা হয়েছে ৯ হাজার ৭৬৮ পাউন্ড, যা স্বর্ণের দামের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি!
তবে এই বাজপাখিটি চোরাই মাল ছিল না। প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট ফ্যালকনস নামক একটি কোম্পানির আওতায় এর প্রজনন করা হয়। সৌদির ধনাঢ্যদের কাছে বাজপাখি বিক্রি করেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক ড্যানি আর্টসগার্ড।
ড্যানি জানান, তার ফার্ম থেকে একবার ৬টি বাজপাখি কিনে জেট বিমানে করে নিয়ে যান ক্রেতা। শুধুমাত্র ওই বিমানের ভাড়াই ছিল আড়াই লাখ ডলার। তিনি বলেন, 'আরবের ধনীরা পকেটে টাকা থাকলে কী কী করতে পারে, তা আমাদের ধারণারও বাইরে!'
অবশ্য ক্রেতার নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে রাজি হননি ড্যানি। তিনি আরও জানান, রেকর্ড দামে কেনা বাজপাখিটির নিলাম সৌদির জাতীয় টিভিতেও লাইভ দেখানো হয়।
২০১৬ সালে ব্রিটেনের আরেক ব্যবসায়ী, ব্রাইন ক্লোজ তার ডংকাস্টারভিত্তিক বাজপাখিটি আবুধাবির রাজপরিবারের কাছে ৩ দশমিক ৭ মিলিয়ন পাউন্ডে বিক্রি করেন। মিডল ইস্টার্ন টুর্নামেন্টের ছয়টি দৌড় প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয় তার পাখিটি। এর মাধ্যমে তার ক্লায়েন্টের আয় হয়েছিল ১ মিলিয়ন পাউন্ড।
আবুধাবিতে বাজপাখিদের নিয়ে 'সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা' আয়োজন করা হয়। শপিংমলে গেলে শুধু মানুষের নয়, বাজপাখিদের সাজসজ্জার জন্যেও প্রচুর অনুষঙ্গ মিলবে বৈকি!
বাজপাখিগুলো কী পরিমাণ সমাদর পায়, তা হয়তো অনেকেই বুঝে গেছেন। এর একটি নমুনা বলা যাক। একটি ছবিতে দেখা যায়, বাজপাখিদের জেট বিমানে করে আনার সময় প্রতিটি পাখিকে আলাদা আসন দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের চাপাচাপি না হয়! এমনকি সৌদি আরবে বাজপাখিকে এতটাই আদরযত্নে রাখা হয়, যা একজন সৌদি নাগরিক তার জীবনে পান না!
বাজপাখির ব্যবসা পুরোপুরিই বিদেশ থেকে পরিচালনা করা হয়। পরিবেশবাদীদের প্রতিবাদ ও দেশীয় নানা আইন থাকা সত্ত্বেও শিকারিদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে তাদের নাগাল পাওয়া মুশকিল। বাজপাখির রেস বৈধ খেলা কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশবাদীরা।
- সূত্র: ডেইলি মেইল