ভারত শাসন করা চার আফ্রিকান রাজা
'এখানে কালো মানুষেরাই বেশি সম্মান ও প্রতিপত্তির অধিকারী। অন্য বর্ণের চাইতে নিজেদের মর্যাদা বেশি বলেই ভাবেন তারা। যাদের গায়ের রঙ খুব একটা কৃষ্ণ বর্ণের নয়, তাদের নিজেদের চাইতে কম যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করেন এরা। আমি আরও দেখেছি এদের কল্পনায় দেবদেবীরাও সবাই কৃষ্ণ বর্ণের। আর তারা অসুরদের শ্বেতাঙ্গ হিসেবে চিত্রিত করেন। এখানকার কালো মানুষেরা বলেন, ঈশ্বর এবং তার প্রেরিত সকল সন্তই ছিলেন কালো আর শয়তানেরা ছিল সাদা চামড়ার। এজন্যেই তারা দেবতা এবং অসুরদের সাদা-কালোর বর্ণভেদে তুলে ধরেন।'
আলোচ্য উক্তিটি ইউরোপের বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলোর। ১২৮৮ সালে তিনি ভারতের প্রাচীন পান্ডু রাজ্য সফর করে এসব কথা লিখেছেন তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে।
বর্ণবাদ যখন যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, শোষণে নিষ্পেষিত করছে লাখো কোটি আদম সন্তানকে, তখন মার্কোর উক্তিটি খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে।
পৃথিবীর মহিমামণ্ডিত কিছু সভ্যতা যে কালো মানুষেরাই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, সেটা তাদের উত্তরসূরিদের দুর্দশা দেখে আজ প্রায় ভুলতেই বসেছে মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের শিক্ষায় আজ আমরাও সাদা চামড়ার শ্রেষ্ঠত্ব নিজেদের অজান্তেই অবচেতন মানসে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি। হয়তো এ কারণেই কিছুদিন আগেও এ দেশের মানুষ ঘানাবাসীকে নিয়ে অবজ্ঞার সুরে টিটকারি-রসিকতা করতেন। অথচ তাদের অনেকেই জানেন না, ঘানার মোট জিডিপির পরিমাণ ৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ৬৫০ ডলার।
জিডিপি আর মাথাপিছু আয় প্রকৃত উন্নয়ন না দর্শালেও, এর চাইতে ঢের কম আয়ের নেপাল বা ভুটানবাসীকে নিয়ে কিন্তু আমাদের এমন নাক সিটকানোর নজির নেই।
ইতিহাস বলে, প্রাচীন গ্রীস বা রোমের হাজার বছর আগে কালো চামড়ার কর্মঠ দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর নারী-পুরুষরা এই অঞ্চলে শক্তিশালী সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছিলেন সিন্ধু উপত্যকায়। অনেক নৃতাত্ত্বিকের ধারণা, দ্রাবিড়দের পুর্বপুরুষ ছিলেন কালো আফ্রিকানরাই। পরবর্তীকালে তাদের সঙ্গে অস্ট্রেলয়েড জাতির সংমিশ্রণে দ্রাবিড় জাতি গড়ে ওঠে। তাদের সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসে ছিল এ ইতিহাসের সুস্পষ্ট প্রতিফলন।
এ বিষয়ে আফ্রিকাকেন্দ্রিক সভ্যতা বিকাশের সমর্থক নৃতাত্ত্বিক ড. ক্লাইড উইন্টারস লিখেছেন, 'ইথিওপীয়দের সঙ্গে (প্রাচীন) ভারতীয়দের খুব আত্মিক সম্পর্ক ছিল। ইতিহাস বিস্মৃত সুপ্রাচীনকালে ইথিওপীয়রা ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল শাসন করেছেন। এসব ইথিওপীয়দের নাগা নামে ডাকা হতো। নাগাদের হাতেই সংস্কৃত ভাষার জন্ম। খ্রিস্টপূর্ব ৫ শতকের দ্রাবিড়িয় সাহিত্য পাঠের মাধ্যমে আমরা নাগা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছি। এসব উপকথায় উল্লেখ আছে, নাগারা মধ্যভারতকে ভিল্লাভার (ধনুযোদ্ধা) এবং মিনাভার (জেলে) গোষ্ঠীকে যুদ্ধে হারিয়ে এ অঞ্চল জয় করেছিলেন।'
তিনি আরও বলেন, নাগারা ছিলেন সামুদ্রিক অভিযাত্রী গোষ্ঠী ও দক্ষ নাবিক। তারা শুধু মধ্য ভারত নয়, বরং শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারেও নিজেদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে আসা অপেক্ষাকৃত শ্বেত বর্ণের আর্যরা নাগাদের অর্ধেক মানুষ ও অর্ধেক সাপ বলে অভহিত করতেন। তামিলদের বর্ণনায়, নাগাদের ধনুক এবং দড়ির ফাঁস ব্যবহার করতে সক্ষম- এমন জাতিগোষ্ঠী বলা হয়েছে। এমনকি নাগাদের সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় রামায়ণ ও মহাভারতের মতো মহাকাব্যের আদি সংস্করণগুলোয়।
মহাভারতে আছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৩ শতকে নাগাদের রাজধানী ছিল অধুনা দক্ষিণাত্যে। তাদের স্থাপিত অন্যান্য শহর ছিল গঙ্গা এবং যমুনা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলজুড়ে বিস্তৃত। দ্রাবিড়িয় আদি সাহিত্য চিল্লাপাথিকারামে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মহাশক্তিশালী রাজ্যই ছিল নাগানাড়ু।
প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা তো জানা গেল, তবে কি মধ্যযুগের আগেই নাগাদের আফ্রিকীয় কালোদের ভারত শাসনের অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছিল? মোটেও তা নয়, বরং ইতিহাস বলছে মুসলিম আবির্ভাবের বহুকাল পরেও ভারতে কৃষ্ণাঙ্গরা প্রবল প্রতাপের সঙ্গেই রাজ্যশাসন পরিচালনা করেছেন।
এমন চার কালো বর্ণের রাজার কথা তুলে ধরতেই, মাইন্ড বিল্ডার্স ফেলোশিপ ব্লগস্পটের সূত্র ধরে এ আয়োজন।
মালিক আনদিল খান সুলতান
১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলা জয় করে হাবশি বংশ প্রতিষ্ঠাকারী শাহজাদা খোজা বারবাক সম্পর্কে ইতিহাসে বেশি কিছু পাওয়া যায় না। তবে তিনি যে সিদি আফ্রিকীয় ছিলেন এবং তার পূর্বপুরুষ ইথিওপীয়, তা নিশ্চিত।
সিদি হচ্ছে সিদ্ধি শব্দের প্রচলিত অপভ্রংশ। সোয়াহিলি ভাষার মূল শব্দটি হলো শিদি বা হাবশি। আজো এদের বংশধরেরা ভারত ও পাকিস্তানের নানা অঞ্চলে বসবাস করেন। পূর্ব আফ্রিকার বান্টু জনগোষ্ঠীরাই হাবশিদের পূর্বপুরুষ ছিলেন বলে অনুমান করা হয়।
শাহজাদা খোজা বারবাক ক্ষমতায় আসীন হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তার বিশ্বস্ত এক আমাত্যের হাতে নিহত হন। তখন ক্ষমতায় আসীন হন মালিক আনদিল খান সুলতান।
সিংহাসনে বসার পর তিনি নিজের নাম পরিবর্তন করে রাখেন সাইফ উদ্দিন আবুল মুজাফফর ফিরোজ শাহ। তিনি একজন অত্যন্ত জ্ঞানী ও সুযোগ্য রাজা ছিলেন। তার শাসনামলে বাংলায় সমৃদ্ধি এসেছিল।
ফিরোজ শাহ ১৪৮৭ থেকে ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মসনদে আসীন ছিলেন। তার আমলে জারি করা মুদ্রার সুবাদেই শাসনকাল সম্পর্কে নিশ্চিত জানা গেছে। তিনি নিজ প্রজাদের জন্য শান্তি ও স্থিতিশীলতা তৈরি করেন। একইসঙ্গে ছিলেন খুবই দয়ালু ও প্রজাবৎসল।
বিবলিওথিকা ইন্ডিয়া' গ্রন্থে তার প্রচুর ধনদৌলত দান-ধ্যানের উল্লেখ রয়েছে। গরিবদের জন্য তার সহমর্মিতা ছিল অতুলনীয়।
জামাল আল-দ্বীন ইয়াকুত
রাষ্ট্র ক্ষমতায় নিজের অবস্থান সুসংহত করার যাত্রাটা দিল্লি রাজ্যেই শুরু করেছিলেন এই হাবশি। দিল্লির মুসলিম সুলতানেরা তাদের সেনা, হারেম এবং রাজকীয় নিরাপত্তারক্ষী বাহিনীতে সেকালে বহু পূর্ব আফ্রিকীয় দাস রাখতেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত থাকায় দিল্লিতে তাদের প্রভাবও বাড়তে থাকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। রাজা না হলেও তার জীবন কোনো অংশেই কম নাটকীয়তাপূর্ণ নয়।
জামাল আল-দ্বীন যখন তার কর্মজীবন শুরু করেন, কিছুদিনের মধ্যেই দিল্লির মসনদে বসেন সুলতানা রাজিয়া। ১২৩৬ থেকে ১২৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকারী রাজিয়া ছিলেন দিল্লির প্রথম নারী সুলতানা। তিনি জামাল আল-দ্বীনকে খুবই পছন্দ করতেন। রাজিয়া এই হাবশিকে প্রথমে পদন্নোতি দিয়ে রাজসভার একজন আমির বানান, পরে তাকে আরও সম্মানজনক পদ বা রাজকীয় আস্তাবলের তত্ত্বআবধায়করূপে নিয়োজিত করেন।
জামালের কর্ম তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে রাজিয়া তাকে আমির-আল-খায়াল (বা অশ্বশ্রেণির নেতা) উপাধি দেন। পরবর্তীকালে দেন সর্বোচ্চ সম্মানজনক আমির-আল-উমারা উপাধি। এর অর্থ, সকল রাজ আমাত্যের (আমিরের) নেতা।
একজন হাবশিকে এত মর্যাদা দেওয়ায় ও তার ওপর আস্থা রাখায় রাজিয়ার দরবারের তুর্কি অভিজাতবর্গ খুবই নাখোশ হন। একে নারী নেতৃত্ব, তার ওপর হাবশি গোলামকে মর্যাদা দেওয়ার পরিক্রমা তাদের অহমিকায় আঘাত হানে।
আমাত্যদের প্রকাশ্য বিদ্রোহের মুখে রাজিয়া ক্ষমতাচ্যুত হন, আর জামাল আল-দ্বীনকে হত্যা করা হয়।
মালিক সারোয়ার
হাবশি ছিলেন মালিক সারোয়ারও। দিল্লির কাছাকাছি আরেক সুলতানি মসনদ জোনপুরের প্রশাসক হিসেবে তিনি নিয়োগ পেয়েছিলেন। দিল্লির সুলতানদের জন্য তিনি জোনপুর জয় করেন।
১৩৮৯ সালে তাকে খাজাহ-ই-জাহান উপাধি দেওয়া হয়। ১৩৯৪ সালে দিল্লির সুলতান দ্বিতীয় নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহ তুঘলক তাকে জোনপুরের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেন। আরও দেন সম্মানজনক মালিক-উস-শার্ক বা পূর্বের রাজা উপাধি।
গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই মালিক শাসক দিল্লির অধীনতা না মেনে একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে শাসন শুরু করেন। তিনি নিজে আতাবেক-ই-আজম উপাধি নেন।
এরপর ইতাওয়াহ, কোলই ও কৌনজের বিদ্রোহ দমন করেন তিনি। কারা, আওয়াধ, সান্দিলা, ডালমাউ, বাহরিচ, বিহার ও তীরহুত অঞ্চল জয় করে নিজ রাজ্যের সীমানা বিস্তার করেছিলেন সারোয়ার।
তার সামরিক রণকুশলের সঙ্গে পরিচিত হয়ে জাজনগরের রাই এবং লক্ষ্মণাবতির শাসকবৃন্দ তার আনুগত্য স্বীকার করে নেন। উপহার হিসেবে পাঠান সুপ্রশিক্ষিত বেশকিছু যোদ্ধাহাতি।
মালিক সারোয়ারের পালকপুত্র মালিক কারানফল তার পিতার পর মসনদে আসীন হন। তিনিই ছিলেন বিখ্যাত সুলতান মুবারক শাহ। সে আমলের চল অনুসারে তিনি নিজেই এই পদবি নিয়েছিলেন।
জোনপুরের এই সুলতান বংশের অধীনে রাজ্যটি সারা ভারতে শিক্ষা, সাহিত্য ও ব্যবসা- বাণিজ্যের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বংশে পাঁচজন বিখ্যাত হাবশি সুলতান শাসন করেছেন।
মালিক আম্বর
ইন্দো-আফ্রিকীয়দের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত মালিক আম্বর। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ইথিওপিয়ার হারার অঞ্চলেই সম্ভবত তার জন্ম। এরপর তাকে দাস ব্যবসায়ীরা ধরে গুজরাটের এক মুসলিম বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। ক্রীতদাস হলেও আম্বরকে শিক্ষা- দীক্ষা ও অন্যান্য শাস্ত্রে প্রশিক্ষিত করেন তার মনিব। ভারতে আসার পর পরবর্তীকালে সেটি তার কাজে লেগেছিল।
দক্ষিণ ভারতের আহমেদানগরের সুলতানশাহীর অধীনে চাকরি করার সময় তিনি প্রচণ্ড প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন। রাজ্যের সুরক্ষা ও শাসনের নেপথ্যে তিনিই হয়ে ওঠেন প্রধান শক্তি।
মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর দক্ষিণ ভারত জয় রুখতে তিনি প্রথম প্রকৃত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। বহুকাল তার সামরিক তৎপরতার কারণেই মুঘল বাহিনী আহমেদনগর রাজ্য জয় করতে ব্যর্থ হয়।
শুধু সুযোগ্য সমর নায়ক নন, অত্যন্ত বুদ্ধিমান কূটনৈতিক, রাজনৈতিক কৌশলের নিপুণ উদ্ভাবক এবং যোগ্য প্রশাসক হিসেবেও সুখ্যাতি ছিল আম্বরের। ১৫৯০ সালে বিজাপুর রাজ্যের অধীনস্ততা অস্বীকার করে আফ্রিকীয় দাস, আরব এবং স্থানীয় দাক্ষিনাত্যের অধিবাসীদের নিয়ে তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী এক সেনাবাহিনী গঠন করেন। এই সেনাদের নিয়েই তিনি আহমেদনগর রাজ্যের স্বপক্ষে মুঘলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেন।
উদারমনা আম্বর ছিলেন ধর্মীয় সংখ্যালঘুসহ সমাজের বঞ্চিত অংশের নানা বর্ণের মানুষের প্রতি সহানুভুতিশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষা ও কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার করে তিনি সামাজিক বিভেদ ঘোচাতে উদ্যোগী হন, এবং বঞ্চিত সম্প্রদায়ের ব্যক্তিদের প্রশাসনের নানা স্তরে চাকরি দিতেন।