মহামারির কারণে রোবটের কাছে কাজ হারানোর ভীতি ফিরে এসেছে
আঠারো শতকের মাঝামাঝি প্রথম শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হয় যুক্তরাজ্যে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে এ বিপ্লবের সময়ে যন্ত্র প্রযুক্তির বিকাশ রাতারাতি কারখানা পর্যায়ে উৎপাদনকে বিস্ময়করভাবে উন্নীত করে। হাজারো শ্রমিকের কাজ করার সক্ষমতা দেখায় বাষ্পীয় শক্তিচালিত এক একটি ইঞ্জিন। তখনও অবশ্য ভবিষ্যতের কর্মস্থলে মানুষের জায়গা সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপনের শঙ্কা দেখা যায়নি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে থেমসের স্রোত যেমন প্রবাহিত হয়েছে সমুদ্রের প্রতি, তেমনি বিকশিত হয়েছে যন্ত্রশিল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসে যন্ত্রের দক্ষতা বাড়ায় প্রাথমিক যুগের বাইনারি কম্পিউটার। আধুনিক গণনাযন্ত্রটির আরও উন্নয়ন চলতে থাকে পরের দশকগুলোতে। ধীরে ধীরে ৯০ এর দশকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর ডিজিটাল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন সফটঅয়্যারের অগ্রগতি- শিল্প কারাখানায় ঝুঁকিপূর্ণ ও শ্রমঘন কাজে ব্যবহার উপযোগী রোবটিক্স প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ায়।
উৎপাদনের সামগ্রিক গড়ের বিবেচনায় স্বস্তা বিনিয়োগ হিসেবে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে রোবটিক্স প্রযুক্তির। উন্নত বিশ্বের উদ্যোক্তাদের মাঝে জনপ্রিয়তার আরও অন্যান্য কারণ; মানবিক ত্রুটির সম্ভাবনা হ্রাস, শ্রমিক ধর্মঘট এবং মজুরি বৃদ্ধির মতো মানবিক সমস্যা থেকেও মুক্ত স্বয়ংক্রিয় রোবটের ব্যবহার।
বাস্তবিক অর্থেই, শিল্পোন্নত দেশগুলোতে এখন মানবিক শ্রমকে অনেকাংশে প্রতিস্থাপন করেছে রোবোটিক্সের প্রযুক্তি। কৃষি, সামরিক প্রকৌশল, ভারি যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং মহাকাশযান তৈরির সকল ধাপে আছে এর ব্যবহার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্ভর চতুর্থ যে শিল্প বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিশ্ব পাড়ি দিচ্ছে; তা রোবটিক্সের বিকাশকে আরো গতিশীল করেছে।
তবে বর্তমানে বিশ্ব পড়েছে করোনার মহামারি ও তার অভিঘাতে সৃষ্ট মন্দার মুখে। অনেক অর্থনীতিবিদ এটি স্মরণকালের সবচেয়ে দীর্ঘ ও প্রলয়ঙ্করী মন্দা হতে চলেছে বলে হুঁশিয়ার করেছেন। এর মাঝেই নতুন করে রোবটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো অভিনব প্রযুক্তির কর্মস্থলে দখলদারিত্ব বৃদ্ধির শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা পরিচালিত সেবা এবং কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে; যান্ত্রিক পরিবেশে নতুন করোনাভাইরাসের মতো জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে না। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মহামারি জনিত ব্যাঘাত সৃষ্টির সমস্যা নেই। আরও নেই জরুরি পণ্যের সঙ্কট দেখা দেওয়ার শঙ্কা।
তবে শুধু শিল্প কারখানায় নয়, প্রতি মুহূর্তেই উল্লেখযোগ্য অর্জন নিয়ে অন্যান্য পেশার দিকেও হাত বাড়িয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির প্রভাব। কয়েক সপ্তাহ আগেই ইন্টারনেট দুনিয়ায় আলোড়ন তোলে জিপিটি-৩ নামের একটি এআই চালিত সফটঅয়্যার। গবেষণা সংস্থা ওপেনেই- এর তৈরি পোগ্রামটি নানা ভাষা থেকে সঠিক ভাবানুবাদে আশাতীত সফলতা দেখায়।
মহামারিতে ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলোও যান্ত্রিক প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে চলেছে। কোভিড-১৯ সৃষ্ট এই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির নির্ভরতা ঘটছে আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে। অনেক সময় আমরা তা অনুভব করি, তবে অধিকাংশ সময়েই তা ভুলে যাই।
তারপরও নতুন প্রবণতাগুলোর দিকে নজর দেওয়া দরকার। কিছু প্রতিষ্ঠান এখন নথিপত্র বাছাইয়ে নতুন ধরনের সফটঅয়্যারের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বাড়ি থেকে কাজ করা কর্মীদের পক্ষে যা করা সম্ভব নয়। আবার চ্যাটবটের ব্যবহার বেড়েছে হাসপাতালগুলোর আনুষ্ঠানিক সেবা ব্যবস্থাপনার গ্রুপগুলোতে। বৃহৎ কসাইখানার মতো শ্রমঘন এবং ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে- মাংসে করোনার সংক্রমণ ঝুঁকি কমাতে রোবটিক্স প্রযুক্তির শরণাপন্ন হতেই বেশি আগ্রহী ব্যবসায়ীরা।
উন্নত বিশ্বজুড়ে এমন সময় এ প্রবণতা বেড়েছে যখন মহামারি দীর্ঘস্থায়ী মন্দার মাধ্যমে বিদ্যমান চাকরির বাজারই হয়ে চলেছে সংকুচিত । অন্যদিকে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম এবং ভোক্তাচাহিদা ঘাটতির মতো বিষয় কর্মহীনতার এ পরিবেশকে আরো উদ্দীপ্ত করেই যাচ্ছে। লেবাননের মতো বেশ কিছু দেশে কোভিড সৃষ্ট
অর্থনৈতিক সঙ্কট রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পরিবেশকেও ব্যাহত করেছে। আবার, যুক্তরাষ্ট্রে আর্থ-সামাজিক বিভেদের কারণে জন্ম নেওয়া বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনকেও গতিশীল করেছে মহামারি। এসব আন্দোলন, ধর্মঘট, বিক্ষোভ সবকিছুই কারখানা পরিচালনার পরিবেশ উপযোগী নয়। বরং সহযোগী হয় অবনতিশীল ভোক্তাবাজারের।
তাই কায়িক শ্রমের তুলনায় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবহারের সুবিধা বহুবিধ। যদিও, তা বৈষম্যের জন্ম দেয়, এবং ইতোমধ্যেই পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীকে সমাজের অন্য স্তর থেকে আরো পিছিয়ে ফেলে। রুদ্ধ হয় দারিদ্র্য বিমোচনের বৃহত্তর লক্ষ্যমাত্রা।
তাই আপাতত স্বয়ংক্রিয় করণের উদ্যোগ চলছে কিছুটা ঢিমেতালে। রাজনৈতিক-অর্থনীতির বিবেচনাতেই এ রূপান্তর বুঝেশুনে করতে আগ্রহী উন্নত বিশ্ব।
- সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট অবলম্বনে