যুগ যুগ ধরে বয়ে চলা সম্প্রীতি
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্রায়ই ঘটছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা; হচ্ছে হানাহানিও। তবে এতকিছুর মধ্যে কিছু বিষয় মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। বিশ্বব্যাপী নানা অস্থিরতার মধ্যেও দৃষ্টান্ত হয়ে মসজিদের মিনার আর মন্দিরের চূড়া একসঙ্গে মিশে আছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভৈরবগঞ্জ বাজারে।
৭৩ বছর ধরে একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ভৈরব মন্দির আর মাজদিহি জামে মসজিদ; যা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির এক উজ্জ্বল নিদর্শন। দু'টি উপাসনালয়ের পাশাপাশি অবস্থান শিক্ষা দিচ্ছে হিন্দু-মুসলমানের ভাতৃত্বের বন্ধন। শান্তিপূর্ণভাবে এখানে দুই ধর্মের মানুষ যার যার ধর্ম পালন করেন। মন্দির-মসজিদ পাশাপাশি থাকায় উভয় ধর্মের মানুষ একে অন্যের ধর্ম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। আর এ বিষয়টি সমাজে বিভেদহীন জীবনযাপনে সহায়ক বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে মন্দিরটি স্থাপিত হলেও মসজিদটি নির্মিত হয় ৭৩ বছর আগে। এই সময়ে দেশব্যাপী অনেক সাম্প্রদায়িক উস্কানি ছড়ালেও তার প্রভাব এখানে বিন্দুমাত্রও পড়েনি। দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ২০ গজ।
স্থানীয় কালাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মজুল জানান, এই মন্দিরের পাশেই এক সময় বাজার গড়ে ওঠে; সেটি এখনো ভৈরব বাজার নামে পরিচিত। লোকমুখে প্রচলিত আছে, প্রায় দুইশ বছর আগে পূণ্যদত্তের পরিবার মন্দিরটি স্থাপন করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, ১৯৪৭ সালের দিকে এখানে মসজিদ স্থাপন করা হয়। এলাকাবাসী ও মাজদিহি চা বাগান কর্তৃপক্ষ নিজেদের অর্থায়নে মসজিদটি নির্মাণ করেন। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই দুই ধর্মের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মকর্ম পালন করে যাচ্ছেন।
মসজিদের ইমাম জাফর আহমদ বলেন, '১৫ বছর ধরে এখানে খতিবের দায়িত্ব পালন করছি। প্রায় ৭৩ বছরের ইতিহাসে এখানে দুই ধর্মের মানুষের মধ্যে কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতা নেই।'
তিনি জানান, নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর প্রায়ই তার সঙ্গে মন্দিরের পুরোহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্যের দেখা হয়। তখন তারা কুশল বিনিময় করেন।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, 'আমি ছেলেবেলা থেকেই এভাবে দেখে আসছি। নিজেও ৪০ বছর ধরে এই মসজিদে নামাজ পড়ছি। আমরা উভয় ধর্মের মানুষ একে অপরের সমস্যায় এগিয়ে আসি। আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক কোনো সমস্যা নেই।'
ওই এলাকার কবি শেখ শাহ্ জামাল আহমদ জানান, মন্দিরে প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত পূর্জা ও কীর্তন হয়। এতে কারও কোনো আপত্তি নেই। বরং দুই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেই প্রতিদিন এলাকার মুসল্লি ও হিন্দু ধর্মালম্বীরা যাতায়াত করেন।
স্থানীয় চাতালী চা বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিজয় নুনিয়া জানান, নতুন প্রজন্ম এই মন্দির এবং মসজিদ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
মন্দিরের পুরোহিত জন্মজয় ভট্টাচার্য্য জানান, 'বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের নিমন্ত্রণ জানালে তারা সেখানে আসেন। আমরা প্রায়ই অনেক রাত পর্যন্ত কীর্তন করি। শুধু নামাজের সময় আমাদের বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ নিয়ন্ত্রণে রাখি। পূর্জাচনায় মুসল্লি ভাইয়েরাও সহায়তা করেন। গত ৩০ বছরে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই পূজা অর্চনা করে আসছি।'
শ্রীমঙ্গল ভৈরব বাজারের এই মন্দির ও মসজিদ বিশ্বের সাম্প্রদায়িক শক্তির জড়তা দূর করবে। এর চূড়া ও মিনারের মতো পাশাপাশি অবস্থান করে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিভেদ দূর করে মানুষে মানুষে জাগ্রত হবে ভাতৃত্ব বন্ধন, এমনটাই আশা এলাকার মানুষের।