রিপাবলিকান দলের জন্য বাংলাদেশের হাতি!
আমেরিকার রিপাবলিকানদের দলীয় প্রতীক- হাতি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে ধরা কয়েকটি হাতির মধ্যে একটি আইসেনহাওয়ারের জন্য উপহার হিসেবে পাঠায় তখনকার পাক সরকার।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আনারকলি ৫১ বছর বয়সে করাচি চিড়িয়াখানায় মারা যায়।
সেটা পাকিস্তান আমল, ১৯৫৬ সাল (ড. কোরেশী তার ২০০৬ সালের প্রবন্ধে লিখেছেন যে তিনি ১৯৫৫ সালে খেদা (বন্যহাতি ধরার বিশেষ ফাঁদ) করেন , আর ২০০২ সালের প্রবন্ধে খেদার সাল বলেছেন ১৯৫৬!)। আমি আগেরটিকেই সঠিক ধরে নিচ্ছি। সে বছরই ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ছিলেন রিপাবলিকান দলের এবং তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য লড়বেন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ দলের নির্বাচনী প্রতীক ছিল হাতি। তখনকার পাকিস্তান সরকার আমেরিকার সঙ্গে তাদের দোস্তি জাহিরের জন্য একটি হস্তীশাবক ওদেশে পাঠাবার মানসে আমাদের দেশের (তখনকার পূর্ব-পাকিস্তান) পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় একটি খেদা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। পূর্ব-পকিস্তান বন বিভাগের উদ্যোগে সে খেদা অনুষ্ঠিত হলেও সেটা পরিচালনার দায়িত্ব ছিলেন ড. কোরেশী। তিনি তখন করাচি চিড়িয়াখানার পরিচালক ছিলেন।
আমি এ অংশটুকু লিখেছি করাচি চিড়িয়াখানার দীর্ঘকালীন পরিচালক ড. এ. এ. কোরেশীর কিশোর-কিশোরীদের জন্য দি ডন পত্রিকার 'ডন ইয়ং ওয়ার্লড' ম্যাগাজিনে লেখা প্রবন্ধ থেকে ((Quraishy ২০০২ ও ২০০৬)। আনারকলিকে নিয়ে তাঁর দুটি লেখায় কিছু তথ্যগত ভুল আছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।
প্রথম প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, খেদা হয় চট্টগ্রামে আর ধরা পড়ে ১৪টি হাতি এবং দ্বিতীয়টিতে তিনি বলেছেন যে খেদা করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলায় এবং হাতি ধরা পড়ে ২৫টি (মৃত দুটি নমুনা বাদে!) আর একটিতে খেদার সাল ১৯৫৫ এবং অন্যটায় ১৯৫৬ বলা হয়েছে।
১৯৫৬ সালের খেদায় মোট ২৭টি হাতি আটকা পড়ে। এর দুটি শাবক খেদায় আটকে পড়ার মুহূর্তে দিশেহারা হাতির পালের পায়ের নিচে পড়ে মারা যায় বলে ডা. কোরেশী উল্লেখ করেছেন। খেদার হাতি বাগে এলে একটি একটি করে ২৫টিকে ঘেরের বাইরে আনা হয়। তার মধ্যে ৪টি শাবক ছিল। সেগুলির ভেতরে নারী হাতি দুটির ১৮টি নখর ছিল। সামনের দুপায়ে ৮টি এবং পিছনের দুপায়ে ১০টি নখর ছিল। মুখের তালু গোলাপি এমন হাতি বেছে নেয়া হয়। কারণ, এমন হাতি সব সময় নরম মেজাজের হয় বলে তখনকার লোকজন বিশ্বাস করতেন। আর যাদের তালু কালো এবং নখের সংখ্যা ৮টি করে মোট ১৬টি, তারা না-কি দারুণ বদমেজাজি হয় এবং মানুষ, বিশেষ করে মাহুত মারায় ওস্তাদ হয়।
ডা. কোরিশী একবার বলছেন উড়োজাহাজে এবং অন্যবার বলেছেন সামুদ্রিক জাহাজে হাতি দুটিকে করাচি নিয়ে একটিকে সহসাই প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। পরিণামে নাকি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে খুব বাহবা দেয়।
দ্বিতীয় নারী হাতিকে তিনি পাঠান করাচির নামি ব্যবসায়ী হিরজিনাকে। তিনি এটাকে কিছুদিন নিজের অধীনে পালার পর করাচি চিড়িয়াখানায় দান করেন। চিড়িয়াখানায় এ হাতির নাম দেওয়া হয় "আনারকলি"।
করাচি চিড়িয়াখানায় তাকে প্রশিক্ষণ দিলে সে সম্ভবত ৬-৭ বছর বয়স থেকেই চিড়িয়াখানার দর্শকদেরকে বহন করেছিল। বলতে গেলে ২০০৬ সালের জুলাই মাসে আনারকলি মারা যায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারকে দেওয়া হাতিটির গতি কী হয়েছে সেটা একটু পরেই বর্ণনা করছি।
ডা. কোরেশীর প্রবন্ধ থেকে এটা নিশ্চিত যে, বাংলাদেশের হাতি বন্দিদশায় কম পক্ষে ৫১ বছর বেঁচেছিল।
কিন্তু উপরের কিছু তথ্যগত ভুল বাদ দিলেও http://www.elephant.se/database2. php?elephantid=2268 ইন্টারনেট সাইট যে তথ্য দিয়েছে তাতে আনারকলির জন্ম তারিখ ১৯৪০ সাল উল্লেখ করা হয়েছে
এবং তার মৃত্যুদিবস হিসেবে ১৭ জুলাই ২০০৬ সাল দেওয়া আছে। এ হিসেবে আনারকলি ৬৫ (!) বছর বেঁচেছিল। এখানে দেওয়া হাতির বয়স সঠিক নয়।
অবশ্য এ ইন্টারনেট সাইটের সব তথ্য ভুল বলে আমি মনে করি যেহেতু কোরেশী নিজে ১৯৫৬ সালে আনারকলিকে চট্টগ্রাম/পার্বত্য চট্টগ্রামের বন থেকে খেদা করে ধরে নিয়ে যান বলে তার নিজের লেখা দুটি প্রবন্ধেই উল্লেখ করেছেন। তখন তিনি এর বয়স ধরেছিলেন ৪ বছর।
কাজেই আনারকলির বয়স ৫১ বা ৫২-র বেশি হতে পারে না। তবে আনারকলি যে অবশ্যই ২০০৬ সালের ১৭ জুলাই মারা গেছে সে ব্যাপারে পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যে খবর ছাপা হয়েছে তা সত্য।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আনারকলির দোসর 'babe' যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ৪০ বছর বয়সে করাচির ডন পত্রিকার আর্কাইভ থেকে ডা. কোরেশী লিখিত আনারকলির প্রবন্ধটি পড়ার পর থেকেই মনে প্রশ্ন জাগে আনারকলির দোসর যে হাতিটিকে তিনি করাচি নেন এবং পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ারের জন্য পাঠায় তার ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কি ঘটেছিল?
ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ঘাটাঘাটির পর যুক্তরাষ্ট্রের অরগন জু, পোর্টল্যান্ড, অরগন প্রকাশিত এবং Association of Zoos and Aquariums (AZA)-এর সহযোগিতায় "এশিয়ান এলিফ্যান্ট (Elephas maximus)-নর্থ আমেরিকান রিজিওনাল স্টাডিবুক, ১৭ জুলাই ২০০৭ থেকে ৩১ আগষ্ট ২০১০" প্রজনন এবং জীবনেতিহাসের বইটির বা স্টাডিবুকটির সন্ধান পাই যা কিলি ও সঙ্গীরা, ২০১০ (Keele et al, 2010, http://www.elephanttag.org/professional/ 2010AsianElephantStudbook.pdf) রচনা করেছেন। আর স্টাডবুকটি ছাপিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অরগন জু। বইটির গ্রন্থসত্বও ঐ চিড়িয়াখানার গ্রন্থপঞ্জিতে দেওয়া হয়েছে। ঐ স্টাডবুকটিতে ২০১০ সালের আগস্ট পর্যন্ত উত্তর আমেরিকায় এশিয়ার হাতির মোট ৭২৫টি নমুনার সন্ধান মিলেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে।
আমেরিকার স্টাডবুকটিতে ৭২৫টি হাতির মধ্যে কেবল ক্রমিক সংখ্যা ২৫ নামে যে হস্তিনীটিকে দেখানো হয়েছে কেবল সেটিই মনে হয় সারা আমেরিকার একমাত্র হাতি যা পাকিস্তান থেকে ১৯৫৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে। বাকি ৭২৪টি হাতির কারো উৎসদেশ হিসেবে পাকিস্তানের নাম নেই।
তবে কিলি ও অন্যান্য (২০১০) এ ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য পাননি যে, হস্তিনীটি প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের কোথা দিয়ে, কার কাছে বা কোন শহরে প্রথম প্রবেশ করে বা কীভাবে পৌঁছে। এখানে একটি বড় প্রশ্ন রয়েছে। কিন্তু তাঁরা এটা নিশ্চিত হয়েছেন যে, হস্তিনীটি ১লা মে ১৯৫৫ সালে যায় 'মেট্রো জু'তে Metro Zoo, Zoo Miami, One Zoo Boulevard, Miami, Florida, USA)। এর আগে কে বা কারা ওর নাম রাখে 'babe' বা 'খুকুমনি'। প্রায় একবছর পর মেট্রো জু থেকে ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে তাকে নেওয়া হয় Walter D. Stone Memorial Zoo, Franklin Park, Stoneham, Massachusetts, USA, 02121 চিড়িয়াখানায়। সেখান থেকে আবার ফেরত পাঠানো হয় মেট্রো জুতে ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭৭ সালে। ওখান থেকে ৬ই জুন ১৯৮৫-তে আবার তাকে পাঠানো হয় Rosamond Gifford Zoo at Burnet Park, 1 Conservation Place, Syracuse, New York, USA চিড়িয়াখানায়। এখানেই ১২ই মে ১৯৯০ সালে সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলে স্টাডবুকে উল্লেখ আছে।
যেহেতু বেবে ছাড়া অন্য কোনো হাতি পাকিস্তান থেকে আমেরিকায় যায়নি তাই এটি সহজেই অনুমিত হয় যে, বেবেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আনারকলির দোসর। আর সে আনারকলির চেয়ে প্রায় ১০ বছর কম বেঁচেছিল।
- লেখক: বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং দুবাই চিড়িয়াখানার সাবেক প্রধান