লর্ডসের ময়দানে ক্রিকেট-প্রতিভার দ্যুতি দেখানো রোহিঙ্গা মেয়েটি বিবিসির সেরা একশতে
বাংলাদেশের নয়াপাড়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে জন্ম জেসমিনের। বাবা মারা গিয়েছেন তার জন্মের আগেই। মায়ের আশ্রয়ে ওই ক্যাম্পে বেড়ে উঠতে থাকা জেসমিনের জন্য বড় সুযোগ খুলে দিয়েছিল জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার গেইটওয়ে রিসেটেলমেন্ট কর্মসূচি। এর সুবাদে বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আরও ৩০০ জনের সঙ্গে জেসমিন ও তার মা ২০০৯ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। তখন জেসমিনের বয়স মাত্র আট।
কিন্তু যুক্তরাজ্যে যাবার পরও রোহিঙ্গা পরিবারটির দুঃখের দিন শেষ হয়ে যায়নি। এক দুর্ঘটনায় মা আহত হলে জেসমিনকে নিজের দায়িত্ব নিজেকে নিতে শিখতে হল। সেই কঠিন সময়ে কিশোরীটি আশ্রয় করলেন ক্রিকেট।
ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে সেই তার শুরু। গত দশ বছরে যুক্তরাজ্যের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিশুদের জন্য ক্রিকেট খেলে গিয়েছেন জেসমিন; প্রশিক্ষণ দিয়েছেন তাদের অনেককে।
আর তাই আজ আঠারো বছর বয়সের তরুণীটিকে বিবিসি এ বছরের সেরা একশ প্রেরণাদায়ী ও প্রভাবশালী নারীদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা দিয়েছে। ক্রিকেটে জেসমিন আক্তারের সাফল্যের স্বীকৃতি হিসেবে ‘ক্রীড়া’ ক্যাটাগরিতে তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
মায়ের দুর্ঘটনা থেকে ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা
ব্রিটেনে আসার পরই জেসমিনের জীবনে যা ঘটেছিল তাতে বিপরীতটিও ঘটতে পারত। নিজের সে সময়ের মানসিক অবস্থার বিবরণ তিনি দিয়েছেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের কাছে--
“মায়ের দুর্ঘটনার পর গভীর বিষাদে ছেয়ে গিয়েছিল মন। সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলাম। স্কুলে বা বাসায় কারও সঙ্গে কথা বলতাম না।”
একদিন এক বন্ধু জেসমিনকে নিয়ে গেলেন স্কুলশেষের এক ক্লাবে। সেখানকার কোচ তাকে ক্রিকেট খেলতে পরামর্শ দিলেন। খেলা শুরুর মাস খানেকের মধ্যে জেসমিন দলের ক্যাপ্টেনসি পেয়ে গেলেন। এরপর পেলেন ইয়র্কশায়ার টিমে যোগ দেবার জন্য ট্রায়ালের সুযোগ।
ব্যাটে-বলে দুর্দান্ত করছিলেন জেসমিন। পরে ব্র্যাডফোর্ডের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ‘অল এশিয়ান গার্লস ক্রিকেট টিম’ গঠন করলেন। ক্রিকেটে ওয়েস্ট ইয়র্কশায়ারকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ব্র্যাডফোর্ড সিটির জন্য একসময় ফুটবলও খেলেছেন।
যেভাবে ক্রিকেট অধিনায়ক হলেন জেসমিন
‘সেন্টার পয়েন্ট’ নামের একটি দাতব্য সংগঠন যুক্তরাজ্যে ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সী গৃহহীন তরুণ-তরুণীদের জন্য আবাসন ও অন্যান্য সমর্থন দিয়ে থাকে। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, জীবনদক্ষতা, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করে সংস্থাটি।
সাধারণত ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যরা এটির পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। প্রয়াত প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানা এর অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ২০০৫ সাল থেকে দাতব্যটির সঙ্গে রয়েছেন প্রিন্সেস ডায়ানার বড় ছেলে, ডিউক অব কেমব্রিজ প্রিন্স উইলিয়াম।
লক্ষ্যগুলো পূরণের জন্য সংস্থাটি অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে মিলে কাজ করে। তেমন একটি দাতব্য সংস্থা হল ‘স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড'। এরা পথশিশুদের নিয়ে বিশেষ আন্তর্জাতিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এ আয়োজনের উদ্দেশ্য হল, পথশিশুদের প্রতি সাধারণ মানুষের ধারণা ও আচরণ বদলানো। সংস্থাটির প্রধান কার্যালয় লন্ডনে।
পথশিশুদের জন্য বিশ্বকাপ ক্রিকেটের আয়োজন ‘স্ট্রিট চাইল্ড ইউনাইটেড’এর অন্যতম একটি উদ্যোগ। এ বছরের এপ্রিল-মে মাসে আয়োজিত এই বিশেষ বিশ্বকাপেই ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অধিনায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন জেসমিন আক্তার। একদিন ব্র্যাডফোর্ডের স্থানীয় কমিউনিটি সেন্টারে কিশোর-কিশোরীদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন তিনি। সেখানে ‘সেন্টার পয়েন্ট’এর স্টাফদের সঙ্গে সাক্ষাত হয় তার। তারা জেসমিনকে অধিনায়কত্বের প্রস্তাবটি দেন।
এরপর এ বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে আয়োজিত হয় ‘পথশিশুদের ক্রিকেট বিশ্বকাপ’। যেখানে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০ দেশের পথশিশুরা। এই বিশ্বকাপের খেলার ধরনটি কিন্তু ভিন্ন। প্রতিটি দলে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে খেলেছে।
বিশ্বকাপের ফাইনালটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ৯ মে, লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী লর্ডসের ময়দানে। সেখানে জেসমিনের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাজ্যের দলটি হেরে যায় ‘ভারত দক্ষিণ’ নামের দলটির কাছে।
যুক্তরাজ্যের হয়ে একটি বিশেষ বিশ্বকাপে জেসমিনের অধিনায়কত্ব তাকে ক্রীড়া আইকনে পরিণত করেছে। আর সেজন্যই বিবিসির তাকে এই স্বীকৃতিদান।
ক্রিকেট, ক্রিকেট এবং পড়াশুনা
ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসার জন্য যুক্তরাজ্যের মতো দেশেও লড়তে হয়েছে জেসমিনকে। প্রথম যখন ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন, তখন মেয়ে হয়ে ক্রিকেট খেলার জন্য সমাজে নানা রকম নেতিবাচক কথাবার্তা ও সমালোচনা শুনতেন। কিন্তু রোহিঙ্গা সম্প্রদায় তাকে বরাবরই ক্রিকেট খেলতে সমর্থন জুগিয়ে গেছে বলে জেসমিন তাদের নিয়ে গর্বিত।
এরই মাঝে পড়াশুনা চালিয়ে গেছেন। ব্র্যাডফোর্ড কলেজে ব্যবসায়িক শিক্ষায় পড়ছেন এখন। হিসাব বিজ্ঞানে গ্রাজুয়েশন করতে চান। কিন্তু ক্রীড়াই যে তার জীবন। যেখানে নিজের ভবিষ্যতের ঠিকানা খুঁজে পান তিনি।
“খেলা আমার জীবনে বিশেষ কিছু, আমার মনে হয় এজন্যই আমার জন্ম হয়েছে। খেলতে গেলে নিজেকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়-- দুনিয়াকে দেখাতে পারি আসলে আমি কী সেটা।”