লেঙ্গুরা, পর্যটনের এক নতুন সম্ভাবনা
গারোপাহাড় থেকে নেমে আসা আসা এক চপলা-চঞ্চলা নদীর নাম গণেশ্বরী। তার উত্তর-পূর্বদিকে প্রকৃতির নিজ হাতে সাজানো-গোছানো উঁচু পাহাড়ের সারিসমেত ভারত সীমান্ত। যেন এক খণ্ড ঘন সবুজ অরণ্য। আর দক্ষিণ-পশ্চিমে ছোট ছোট টিলাসদৃশ বাংলাদেশ সীমান্ত। টিলার পাশ ঘেঁষে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জনবসতি। শুকনো মৌসুমে নদীর বুকজুড়ে সূর্যরশ্মির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চিকচিক করে সিলিকা বালিরাশি। আর বালির পরতের (স্তরের) নিচ দিয়ে ছুটে চলে স্বচ্ছ জলের ধারা। বলা চলে ঝরনা ধারা। মাথার ওপর ভেসে বেড়ায় নীল-সাদা মেঘ। এ যেন এক অপরূপ, শান্ত, সুনিবিঢ় ও বৈচিত্রময় পাহাড়ি জনপদ। শুধু নৈসর্গিক সৌন্দর্যই নয়, মুক্তিযুদ্ধ, টঙ্ক ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের নানা ইতিহাস-নিদর্শনও ছড়িয়ে আছে এর আশেপাশে। বিচিত্র এ জনপদের নাম লেঙ্গুরা। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার একটি পাহাড়ি-সীমান্ত অঞ্চল। একটু পরিকল্পনার ছকে আনলেই তা হয়ে ওঠতে পারে পর্যটক বা ভ্রমণ পিপাসুদের এক আকর্ষণীয় স্থান। যদিও পর্যটন শিল্পের বিকাশে আজও তেমন কিছুই করা হয়নি এ সম্ভাবনাময় জনপদে।
যেভাবে যাবেন
নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে লেঙ্গুরার দুরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। জেলা শহরের রাজুর বাসার বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে, সিএনজিচালিত অটোরিক্সায় বা ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলে প্রথমে যেতে হয় কলমাকান্দায়। রাস্তা কিছুটা দুর্গম। এরপর কলমাকান্দা সদর থেকে আবার মোটরসাইকেল, সিএনজি বা ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সায় নাজিরপুর এলাকা হয়ে সোজা যাওয়া যায় লেঙ্গুরায়। সময় বাঁচাতে মোটরসাইকেলই ভালো। আর প্রাইভেট কার বা মাইক্রোবাস হলে তো কথাই নেই। সর্বোচ্চ দু'ঘন্টার পথ। লোকাল বাসে সময় যেমন ব্যয় হয়, তেমনি বিড়ম্বনাও অনেক বেশি।
যা দেখবেন
কলমাকান্দা সদর থেকে নাজিরপুরের পথে ওঠা মাত্রই দূর থেকে দৃষ্টি কেড়ে নেয় মেঘালয়ের পাহাড় রাজ্য। মনে হয় এক খণ্ড ঘন-কালো মেঘ যেন সেই কবে থেকে মিতালী করে আছে আকাশ-মাটির সঙ্গে। নাজিরপুর মোড়ে গিয়ে চোখে পড়বে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন স্মৃতিস্তম্ভ। ৭১-এ পাকবাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ সম্মুখযুদ্ধ হয়েছিল নাজিরপুরের এই স্থানটিতে। শহীদ হয়েছিলেন সাতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। নাজিরপুর মোড় হয়ে গণেশ্বরী নদীর পাশ ধরে পাকা রাস্তায় একটানে লেঙ্গুরা বাজার। দীর্ঘ যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করতে বাজারে হালকা চা-নাস্তা সেরে নেয়া যেতে পারে।
বাজারের শেষ মাথায় কয়েকশ বছরের প্রাচীন মন্দির। ছোট টিলার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মন্দিরটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও থামিয়ে দেয় আগন্তুকদের। এরপর পাঁচ মিনিটের কাঁচামাটির পথ পেরোলেই লেঙ্গুরার অঢেল সৌন্দর্য সম্ভার। বিশাল পাহাড় আর ঘন সবুজের হাতছানি। সেখানে দাঁড়িয়ে খুব কাছে থেকে দেখা যায় বড় বড় পাহাড়, পাহাড়ের অরণ্য, অরণ্যের মাঝে উঁকি দিয়ে থাকা আদিবাসীদের ঘরবসতি। পাহাড়ের গহীন অরণ্য আর জীব-জানোয়ারের সঙ্গে মিতালী করে গারো, হাজং, হদি, কোচ প্রভৃতি আদিবাসীরা কবে-কীভাবে সেখানে বসতি স্থাপন করেছিল এসব ভাবনায় অবাক হয় দর্শক-মন। বড় পাহাড়গুলো ভারত সীমানায় অবস্থিত হওয়ার কারণে সেগুলোতে ওঠা যায় না। কিন্তু তাতে কী, দেখতে তো বাধা নেই! লেঙ্গুরায় বাংলাদেশের সীমানায়ও আছে কয়েকটি ছোট পাহাড়। এগুলো টিলা নামে পরিচিত। যেমন মমিনের টিলা, চেয়ারম্যানের টিলা, গাজীর টিলা প্রভৃতি। নানান প্রজাতির গাছ-গাছালি, পাখ-পাখালিতে পরিপূর্ণ টিলাগুলোতে উঠলে মন হারিয়ে যায় প্রকৃতির রাজ্যে। মমিনের টিলাটি ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক। বেশ বড় এবং বিশাল এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সমতল থেকে অনেক উঁচু টিলাটিতে ওঠার জন্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ি ছাড়াও গাছের পাতা-লতা আঁকড়ে ধরে পাথর-মাটির বিকল্প পথ দিয়েও ওঠা যায় ওপরে। ভ্রমণ পিপাসুদের সুবিধার্থে টিলার ওপর নির্মাণ করা আছে বেশকিছু পাকা বেঞ্চ ও ছাতা। টিলায় দাঁড়ালে উত্তর-পূর্ব দিকের বড় বড় পহাড়গুলো আরও ষ্পষ্ট হয়ে ওঠে আয়নার মতো। আর টিলার নীচের এক পাশ দিয়ে দেখা যায় গণেশ্বরী নদীর বিচিত্র রূপ। ছবির মতো এক নদী। গারো পাহাড় থেকে অনেকটা ঝরনার মতো নেমে আসা এ নদীটি বর্ষায় থাকে খরস্রোতা। আর শুষ্ক মৌসুমে এর বুকজুড়ে দেখা যায় শুধুই বালি আর বালি। কিন্তু অবাক হতে হয়Ñ বালির নিচেই পানির প্রবাহ দেখে। নদীর বুকে সামান্য গর্ত করে খানিক অপেক্ষা করলেই তা টলটলে পানিতে ভরে যায়। আর তা দিয়েই গোসলসহ দৈনন্দিন চাহিদা মেটান স্থানীয় আদিবাসীরা। অনেকে আবার নদীর বুক থেকে আহরণ করেন প্রাকৃতিক কয়লা ও নূড়ি পাথর। শুষ্ক মৌসুমে গণেশ্বরীকে অনেকটা সমুদ্র সৈকতের মতো মনে হয়। ইচ্ছা জাগলে প্রাণ খুলে হাঁটাও যায় নদীর বুকে। মমিনের টিলার পশ্চিম পাশে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। টিলা থেকে নেমে আর একটু পূর্বদিকে এগোলেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের 'নো ম্যানস্ ল্যান্ড'। নো ম্যানস্ ল্যান্ড ঘেঁষে একাত্তরের স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক সাত শহীদের মাজার। বছরের একদিন নেত্রকোনাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধারা মিলিত হন এই স্থানটিতে। এছাড়া লেঙ্গুরার আশপাশে রয়েছে বেশকিছু পুরনো মন্দির, গারো-খ্রিস্টানদের গীর্জা বা উপাসনালয়।
লেঙ্গুরায় কিছুক্ষণ অবস্থান করলেই চোখে পড়ে ক্ষুদ্র ও নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্রময় জীবনধারা। দেখা যায় হাজং নারীদের অনেকে 'জাখা' দিয়ে মাছ ধরছেন নদী-ছড়ায় (পাহাড় থেকে নেমে আসা পানি প্রবাহ)। পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধান কাটছেন বা রোপন করছেন কর্মজীবী গারো নারীরা। আবার কাজ শেষে দুগ্ধপোষ্য শিশুকে গামছা সহযোগে পিঠে ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছেন তাদের কেউ কেউ। আদিবাসী সাইকেল বালিকারা দুরন্ত গতিতে ছুটে চলছে বই-খাতা নিয়ে। অনেকে আবার লাকড়ি কুড়াচ্ছেন পাহাড়-টিলায়। একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে কথা বললে ধারণা পাওয়া যায় তাদের ব্যতিক্রম ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গেও।
অপার সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সীমান্ত ছুঁয়ে সারি সারি পাহাড়, টিলা, নদী, আদিবাসী জীবনধারা ও ইতিহাসÑ সবকিছু মিলিয়ে লেঙ্গুরা মানেই এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এর নৈসর্গিক সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। তাই এ স্থানটি সম্পর্কে যে দু-চারজন জানেন তারা শীতকালে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে যান সেখানে। কিন্তু বলাবাহুল্য, পর্যটন শিল্প বিকাশের উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও নীতিনির্ধারকদের উদাসীনতার কারণে এ জায়গাটি আজও সীমাহীন উপেক্ষিত। সেখানে থাকার মতো নেই কোন হোটেল-মোটেল, এমনকি একটি মানসম্মত একটি খাবারের দোকানও। এসব কারণে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের টানে ছুটে আসা ভ্রমণবিলাসীদের দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। অথচ একটু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলেই লেঙ্গুরা হয়ে ওঠতে পারে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রÑ যা অবদান রাখতে পারে রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রেও।
জানা গেছে, গত সরকারের সময় লেঙ্গুরাকে কেন্দ্র করে একটি ডিপিপি (ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল) তৈরি করা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল পর্যটন মোটেল, সাত শহীদের মাজার কমপ্লেক্স, লেঙ্গুরা থেকে মাজার পর্যন্ত প্রশস্ত সড়ক, বিভিন্ন টিলার ওপর বসার উপযোগী বেঞ্চ ও ছাতা, গণেশ্বরী নদীর ওপর ঝুলন্ত পাকা সেতু, পিকনিক ও শ্যুটিং স্পট, ইকোপার্ক প্রভৃতি। কিন্তু পরবর্তীতে আর সেটির কোন অগ্রগতি হয়নি।
তবে এ ব্যাপারে কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক কাজি মোঃ আবদুর রহমান। তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের পরামর্শে লেঙ্গুরাসহ কলমাকান্দা ও দুর্গাপুরের অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলো নিয়ে দু'টি প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হচ্ছে। প্রস্তাবনা দু'টি অনুমোদন পেলে ব্যাপক পরিসরে কিছু কাজ করা সম্ভব হবে। তবে এর আগে পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একটি মোবাইল এ্যাপস্, পর্যটকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা, যোগাযোগ এবং নিরাপত্তাসহ অন্যান্য বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয়ভাবে কিছু কাজ করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। শীঘ্র তা বাস্তবায়ন শুরু হবে।