সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে বেড়ে ওঠা
দেশের গণমাধ্যমগুলোতে গত ১৪ জুন একটি সংবাদ দেখে সেবা প্রকাশনীর বইয়ের পাঁড় ভক্তরা তাঁদের জীবনের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খেয়েছেন। তারা জানতে পেরেছেন, শৈশব আর কৈশোরের জীবনে যে বইয়ের পাতায় তারা বুঁদ হয়ে থাকতেন, সেই জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানার সবগুলো বইয়ের প্রকৃত লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন। সিরিজের মোট ৪৬০টি বইয়ের মধ্যে ২৬০টিই লিখেছেন শেখ আব্দুল হাকিম। ওই খবর থেকে ভক্তরা আরও জানতে পারেন, জনপ্রিয় লেখক এবং বাংলাদেশে মলাট বইয়ের প্রবর্তক কাজী আনোয়ার হোসেন শুধুমাত্র এই সিরিজের প্রথম ১১টি বই লিখেছেন।
মাসুদ রানা সিরিজ কিংবা কাজী আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অতোটা উচ্ছ্বাস নেই। কিন্তু আমরা জানি, এই নামগুলো বাংলাদেশের বইয়ের জগতে বড় দুটি ব্র্যান্ড। কাজী আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশে মলাট বইয়ের প্রকাশনার জগতে একজন পথিকৃৎ। ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেবা প্রকাশনী থেকে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় কুয়াশা সিরিজ। এরপর ১৯৬৬ সালে সেবা প্রকাশনী থেকে বের হয় জনপ্রিয় স্পাই থ্রিলার সিরিজ মাসুদ রানা যাকে বলা হতো 'বাংলাদেশের জেমস বন্ড'।
এই বইগুলো দামে যেমন সস্তা ছিলো, তেমনি পড়তেও ছিলো বেশ মজার। তাছাড়া বইগুলো সংগ্রহও করা যেতো খুব সহজে। শৈশব থেকেই আমরা জানতাম এই সিরিজের অনেক বই-ই বিদেশি থ্রিলার আর কমিক বইয়ের কাহিনী থেকে ধার করা। তবুও এই বইয়ের প্রতি আমাদের মুগ্ধতা এতটাই বেশি ছিলো যে, বিষয়গুলোকে আমরা কখনো পাত্তা দিতাম না।
সত্তরের দশকের শুরুর দিকে আমরা কুয়াশা সিরিজ পড়া শুরু করি। আমার মতো অল্প বয়সী পাঠকদের জন্য এই সিরিজকে তখন 'ঠিকঠাক' হিসেবে গণ্য করা হতো। মাসুদ রানা ছিলো একটু বড়দের বই। আমার ভাই ওটা পড়তো। কারণ জেমস বন্ডের মতো মাসুদ রানাও প্রাপ্তবয়স্কদের উপযোগী এমন কিছু কাজ করতো, যা আমার বড়ভাই চাইতো না আমি পড়ি।
আমরা ছিলাম কুয়াশা সিরিজের নেশায় বুঁদ। প্রত্যেক মাসেই কুয়াশা সিরিজের একটা করে বই আসতো। বইগুলোর শেষ অংশ এমনভাবে লেখা হতো, যার ফলে 'পরবর্তী বইয়ে কী আছে' তা জানতে আমাদের কৌতূহল আরও বেড়ে যেতো। পরের বই আসা পর্যন্ত এই পুরো একটা মাস আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতাম।
আমরা তখন বেইলি রোডে থাকতাম। সেগুনবাগিচার সেবা প্রকাশনী খুব বেশি দূরে ছিলো না আমাদের বাসা থেকে। কখনো কখনো এমন হতো; বই কেনার জন্য আমাদের হাতে টাকা আছে কিন্তু কুয়াশার সিরিজের নতুন বই আসতে আরও কয়েকদিন দেরি হবে; তখন আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেবা প্রকাশনীর ওদিকটায় যেতাম।
প্রকাশনীর যতোটা কাছাকাছি আমরা যেতাম ছাপাখানার কালির আর গ্রিজের গন্ধ আমাদের ততোটাই আকৃষ্ট করতো। প্রবেশের মুখেই থাকতো বইয়ের বড় বড় স্তুপ। আমরা সেখান থেকে বই হাতে তুলে নিতাম। আগে পড়া হয়নি এমন বই হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বারবার দেখতাম। এর মধ্যে থাকতো রাহাত হোসেনের লেখা ভয়াল সিরিজ কিংবা আমাদের তখনকার বয়স বিবেচনায় 'বড়দের জন্য' লেখা 'পঞ্চ রোমাঞ্চ'র ছোট থ্রিলার বই।
কখনো কখনো আমরা সেখানে কাজীদাকে (কাজী আনোয়ার হোসেন) দেখতাম। ছোট্ট বয়সে তাঁকে দেখে পুলকিত বোধ করলেও লজ্জায় সামনে গিয়ে কখনো কথা বলতে পারতাম না।
সত্তরের দশকজুড়ে বের হওয়া সেবা প্রকাশনীর প্রায় সব বই-ই আমাদের সংগ্রহে ছিলো। আমার বড় ভাই সংগ্রহ করতো মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো, আর বাকীগুলো আমরা সংগ্রহ করতাম। ওই সময়টায় আমাদের সারাঘর বিভিন্ন বই আর কমিকে পরিপূর্ণ ছিলো।
১৯৭৬ সালে আমার যখন দশ বছর বয়স তখন আমার সরকারি চাকরিজীবী বাবা ঢাকা থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রামে যান। এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে পাড়ি জমানোর আগের ওই সময়টায় আমি যে বইটি পড়ছিলাম সেটি ছিলো সম্ভবত কুয়াশা ৪৪ বা অন্যকিছু। আমরা যখন চট্টগ্রামে গেলাম, তখন বুঝতে পারলাম কুয়াশার বইগুলো প্রকাশ হওয়ার পর সেগুলো চট্টগ্রামে পৌঁছাতে এক সপ্তাহের মতো সময় লেগে যায়। কুয়াশা ৪৫ এ কী আছে তা জানতে ওই সময় আমরা এতোটাই উদগ্রীব পড়ি যে ঢাকায় থাকা আমাদের এক বইপোকা বন্ধুকে ফোন দেই। ওর নাম পলাশ। বই কিনতে প্রায়ই আমাদের সঙ্গে সেবা প্রকাশনীতে যেতো। পলাশকে আমরা বলি, ও যদি বইটা কেনে তাহলে সেটা পড়ার পর আমাদের যেনো ফোন করে জানায় এর পরের কাহিনী কী। আমার মনে আছে, সেসময় আমরা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে 'ট্র্যাংক কল' এর মাধ্যমে কথা বলতাম।
বই পড়ে ঢাকা থেকে আমার বন্ধু পলাশ বেশ আগ্রহ নিয়ে ফোন দিয়েছিলো আমাদের। কুয়াশার পরের বইয়ের কাহিনী কী পলাশ আমাদের শুধু এটুকু জানিয়েই ক্ষান্ত হয় নি; ওই বইটাকে ছিড়ে, ভাগ করে সেটাকে দুটো খামের ভেতর ঢুকিয়ে এরপর ডাকযোগে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দেয়।
এমনই পাঁড় ভক্ত ছিলাম আমরা।
কাজী আব্দুল হাকিম নামটার সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেবা প্রকাশনী থেকে বের হওয়া তাঁর লেখা 'বিপদ সংকেত' বইটি পড়ার মধ্য দিয়েই আমি খেয়াল করি এখানে আরেকজন লেখক আছেন। এরপর থেকেই তাঁর নামে বেশ কিছু বই দেখি। আমরা বুঝতে পারি কাজীদার মতো আব্দুল হাকিমও বেশ ভালো লেখেন।
পুরো আশির দশক জুড়েই সেবা প্রকাশনীর নাম-ডাক বাড়তে থাকে। ৭১টি বই প্রকাশের পর কুয়াশা সিরিজের ইতি টানে সেবা প্রকাশনী। তবে এরপরই তারা নিয়ে আসে কিশোর থ্রিলার তিন গোয়েন্দা যা পরবর্তীতে তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। আশির দশকে মাসুদ রানা সিরিজের একেকটি বই ৩০ থেকে ৪০ হাজার কপি পর্যন্ত বিক্রি হতো। এই ধরণের বিক্রি আজকের দিনে ভাবাই যায় না।
আশি সালের আগেই আমরা শোনা শুরু করি যে মাসুদ রানার আসল লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন বরং শেখ আব্দুল হাকিম জনপ্রিয় এই সিরিজটির প্রকৃত লেখক। আমরা বুঝতে পারি, তখনকার উঠতি বইয়ের বাজারে কাজী আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন বুদ্ধিমান উদ্যোক্তা। বাংলা মলাট বইয়ের জগতে সেসময়ই তিনি একটা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করে দেন। তাঁর দক্ষ পরিচালনাতেই একদল লেখক বিচিত্র সব বিষয়ের ওপর একের পর এক বই লিখতেন।
মলাট বইয়ের ব্যবসা সত্তর আশির দশকের সময়টায় এতোটাই জমজমাট হয়ে উঠেছিলো যে নতুন নতুন প্রকাশকরা এই ব্যবসায় নামেন। আমাদের কয়েকজন বন্ধুও তাদের জন্য লিখতেন। আমিও কিছু কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিতাম।
নব্বইয়ের পরবর্তী সময় থেকে মলাটওয়ালা বইয়ের শিল্পে উদ্ভাবনী কাজ কমতে কমতে বর্তমান অবস্থায় এসে ঠেকেছে। সেবা প্রকাশনীর নেতৃত্বে মলাট বইয়ের শিল্প এদেশের প্রজন্মের পর প্রজন্মের মধ্যে কল্পনাশক্তি আর সম্ভাবনার প্রসার ঘটিয়ে গেছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ আমাদের সমাজ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন আর সৃজনশীল নয়। যখন এ সমাজ নতুন লেখক সৃষ্টি করতো না, তখন এই পেপারব্যাক শিল্প বিশাল সংখ্যক তরুণকে বইয়ের মধ্যে ডুবিয়ে রাখতো এবং তাদের সৃষ্টিশীল হতে অনুপ্রাণিত করতো।
কাজী আনোয়ার হোসেন এবং শেখ আব্দুল হাকিমের মধ্যে যে বিবাদ তার পুরোটাই আর্থিক বিষয়কে ঘিরে। মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলোর রয়্যালিটি নিয়ে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে। বই লেখার বিপরীতে আনোয়ার হোসেন তাকে প্রাপ্য রয়্যালিটি দেননি অভিযোগ করে আব্দুল হাকিম বইয়ের স্বত্ব দাবি করেছেন। এ ঘটনায় কাজীদার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে। হোক। কিন্তু আমাদের উচিত হবে না, এ ঘটনায় সেবা প্রকাশনীকে টেনে নিচে নামানো। দীর্ঘ সময়জুড়ে বাংলাদেশের পেপারব্যাক শিল্পকে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী এই প্রকাশনী থেকে আরও আরও বই বের হোক; আমরা সেটিই চাই।