হিংস্র বাঘেদের জন্য সবুজ স্বর্গ ‘উপহার’ ভারতীয় দম্পতির
শ্বাপদ প্রাণিকূলের নিরাপদ বিচরণ স্থল অরণ্য। শিকারি প্রাণীরা শুধু অরণ্যকে বিপদসঙ্কুল করে তাই নয় বরং বাস্তুসংস্থানে ভারসাম্য বজায় রাখাটাও এদের কাজ। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে শীর্ষ শিকারি প্রাণী হলো বাঘ, আর সেই বাঘেদের অস্তিত্ব এখন বিপন্ন বন উজাড়িকরণ এবং অবৈধ শিকারিদের তাণ্ডবে।
এক সময় গ্রাম-বাংলার ছোট-খাট স্থানীয় বনেও দেখা মিলতো বাঘেদের। কিন্তু, এখন সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে কিছু সংরক্ষিত বনাঞ্চল ছাড়া তাদের দেখা মেলা প্রায় অসম্ভব। এমনই এক ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য হিসেবে বিখ্যাত ভারতে রাজস্থান প্রদেশে অবস্থিত ‘রানথামবোর টাইগার রিজার্ভ’।
আর হিংস্র শ্বাপদকে ঘৃণা নয় বরং তাদের নিরাপদ বিচরণের পরিধি বাড়াতেই নিজেদের সম্পদের বড় অংশ বিলিয়ে দিচ্ছেন এক ভারতীয় দম্পতি। বন্যপ্রাণীর স্থির আলোকচিত্রী এবং পরিবেশ সংরক্ষণবিদ আদিত্য সিং এবং তার স্ত্রী পুনম সিং গত দুই দশক ধরেই রানথামবোর রিজার্ভ সংলগ্ন স্থানীয় কৃষিজমি একটু একটু করে কিনছেন।
তবে তা নিজেদের জন্য নয়, ক্রয় করা জমি ফেলে রেখে সেখানে প্রাকৃতিক উপায়ে তারা গড়ে উঠতে দিচ্ছেন সবুজ বন। মূল রিজার্ভের পাশে এই দম্পতির তৈরি ছোট্ট বন এখন সকল প্রকার বন্যপ্রানীসহ বাঘেদের প্রিয় বিচরণভূমি। খবর অডিটি সেন্ট্রালের।
আদিত্য ও তার স্ত্রীর বনের জন্য মহতী এই দানের শুরুটা হয় ১৯৯৮ সালে। সেবছর দিল্লিতে আরাম-আয়েশের এক সরকারি চাকরি ছেড়ে আদিত্য রাজস্থানের এই প্রত্যন্ত অরণ্যে বন্যপ্রাণীদের ছবি তুলতে আসেন। আর এই শখটাকেই সেসময় থেকেই নিজের পেশা বানিয়ে নেন।
পরবর্তীতে প্রকৃতির প্রতি টান থেকেই এর কাছাকাছি থাকার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। আপত্তি করেননি তার স্ত্রী পুনম সিং। দুজনে মিলেই বন দেখতে আসা পর্যটকদের জন্য গড়ে তোলেন এক টুরিস্ট রিসোর্ট।
তখন থেকেই রিসোর্ট ব্যবসার আয় থেকে বনের আশেপাশের জমি কেনার সূত্রপাত। স্থানীয় কৃষকেরাও রিজার্ভ এলাকার বাঘেদের ভয়ে তটস্থ থাকতো। কারণ বাঘেরা সুযোগ পেলেই তাদের গবাদিপশু শিকার করে খেতো। তাই বনের পাশের জমি সহজেই বিক্রি করতে রাজি ছিলেন স্থানীয় কৃষকেরা।
এই সুযোগে সিং দম্পত্তি গত দুই দশকে প্রায় ৩৫ একর জমি কিনেছেন। কিন্তু সেই জমিতে তারা ফসলের আবাদ বা তাকে বাণিজ্যিক কোনো কাজে না লাগিয়ে সেগুলো ফেলে রাখেন বছরের পর বছর। ধীরে ধীরে প্রকৃতি তার নিজ আশীর্বাদেই এই ভালোবাসার দানকে ভরে তোলে স্থানীয় প্রজাতির গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে।
এমনকি মূল রিজার্ভের বনভূমির চাইতেও বেশি সতেজ ও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে এই একখণ্ড বন, যাকে ‘ভাদলাব’ নাম দিয়েছেন স্থানীয়রা, যার অর্থ ‘পরিবর্তন’। সিং দম্পতি ভাদলাবের জমিতে পশুদের জলপানের জন্য কিছু ছোট্ট পুকুরও খনন করেছিলেন।
পানি এবং ঘন অরণ্যের স্বাদ পেয়ে প্রথমে আসতে থাকলো বন্য শূকর আর হরিণের দল। শিকারের খোঁজে এরপর স্বাভাবিকভাবেই এলো বাঘেরাও। আর এখন বাঘেরা প্রায় নিয়মিত এই অনু-অরণ্যে শিকার ও বিশ্রামের জন্য আসে। শুধু বাঘ নয়, আসে চিতা আর অতি-বিরল ভারতীয় সিংহের দল।
প্রকৃতি সংরক্ষণবাদী সংবাদ ওয়েবসাইট মংগাবে ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আদিত্য বলেন, ‘জমিগুলো কেনার পরে আমি সেখানে নিজে থেকে কিছুই করিনি। মাঝে মাঝে শুধু আগাছা পরিষ্কার করে রাখতাম। এরপর প্রকৃতিই প্রথমে ঘাসবন এবং পরে স্থানীয় প্রজাতির গাছে একে সবুজ সতেজ অরণ্যে রুপ দিয়েছে। এটা প্রকৃতির জীবনদায়ী শক্তির বহিঃপ্রকাশ’।
আদিত্য ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে অনু বনটির একটি ছবিও তুলেছেন। ওই ছবিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রানথামবোর রিজার্ভের উষর বনের চাইতে কেন এই একখণ্ড সবুজ ভূমি বন্যপ্রাণীদের কাছে স্বর্গের সমান। এখানে নিরাপদে শিকারের সুযোগ মেলায় এখন স্থানীয় কৃষকদের গবাদিপশু পালের ওপরেও বাঘেদের হামলার ঘটনা ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
এই ব্যাপারে আদিত্য বলেন, ‘শিকারি প্রাণীরা বিপদে না পড়লে মানুষ বা গবাদিপশু শিকার করে না। আর তারা জানে ভাদলাবে নিরাপদ আশ্রয়, পানি, শিকার আর অরণ্যের সুশীতল ছাউনি পাওয়া যাচ্ছে। একারণেই তারা এখন স্থানীয় কৃষকদের আর বিরক্ত করে না’।
তবে বেশ কিছু ব্যবসায়ী মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এই ভাদলাব বনটিকে কিনতে চেয়েছিলেন। বরাবরই বিষয়টি টাকার মামলা না হওয়ায় আগ্রহী ক্রেতাদের নিরাশ করেছেন সিং দম্পতি। আর এখন সমগ্র ভারত থেকেই একইভাবে প্রকৃতির জন্য জমিদান শুরু করতে চান এমন অনেক মানুষের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছেন তারা।