২০ টাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর গল্প
মাসে মাত্র ৪০০০ টাকা আয় করার পরেও ভ্যানচালক আসাদ মিয়া তার মেয়ে দুটিকে পড়ালেখা করাতে চান। তার বড় মেয়ে লামিয়া পড়ে তৃতীয় শ্রেণীতে। প্রথম শ্রেণী থেকে এখনো পর্যন্ত লামিয়ার পড়ার খরচ দিয়ে আসছেন ফখরুল মাস্টার। কিন্তু এর জন্যে লামিয়ার বাবা আসাদ মিয়াকে কোনদিনই ফখরুল মাস্টারকে কোনো টাকা দিতে হয়নি।
সোহানা আর সুমনা দুই বোনই প্রথম শ্রেণী থেকে ফখরুল মাস্টারের কাছে পড়ছে। তাদের বাবা সজীব মোল্লা একজন কাঠমিস্ত্রি। দুই মেয়ের পড়ার খরচ হিসেবে তিনি শিক্ষককে ২০ টাকা করে মোট ৪০ টাকা দেন প্রতিদিন।
ফখরুল আলমের সঙ্গে কথা বলতে গেলেই আপনার চোখে ভেসে উঠবে কোন এক পুরনো দিনের সিনেমার কথা, যেখানে সাইকেলে চেপে বৃদ্ধ শিক্ষক পাড়ি দিচ্ছেন মাইলের পর মাইল, আর ১ম শ্রেণী থেকে ৫ম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের দিনে ২০ টাকার বিনিময়ে পড়াচ্ছেন। ফখরুল আলম আমাদের মনে করিয়ে দেন ১৮ শতকের আরেক মানবহিতৈষী ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষক ডেভিড হেয়ারের কথা, যিনি ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করেছিলেন।
ফখরুল আলমের বসবাস মাগুরার মোহাম্মদপুর এলাকায়। পুরো এলাকার মানুষ তাকে ফখরুল মাস্টার নামেই চেনে। ফখরুল মাস্টারের সাইকেলে ঝোলানো থাকে একটা ছোট ধাতব বোর্ড যেখানে লেখা আছে 'পড়াইতে চাই: প্লে থেকে ৫ম শ্রেণী। প্রতিদিন ২০ টাকা' সাথে রয়েছে তার নিজের মোবাইল নম্বর।
প্রতিদিন সকালে ঠিক দশটায় বেরিয়ে পড়েন ফখরুল মাস্টার। সারাদিন ছাত্র পড়িয়ে বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যা ৬ টায়। ফখরুল মাস্টার নিজে মাত্র ম্যাট্রিক পাস, সে কারণেই তিনি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্র পড়ানো বেছে নিয়েছেন।
কমও না, বেশিও না
বিশ বছর আগে ফখরুল আলম তার এই ভ্রাম্যমাণ শিক্ষকের পেশা শুরু করেন। তখন তিনি প্রতিদিন ৫ টাকা করে নিতেন। সেই টাকা বাড়তে বাড়তে এখন ২০ টাকায় এসে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন তিনি সাইকেলে করে দশ মাইল পথ পাড়ি দেন এবং বিভিন্ন স্থানে ৩০-৪০ জন শিক্ষার্থীকে পড়ান। তবে এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ২০-২৫ জন তাকে টাকা দিতে পারে, আর বাকিদের তাকে খরচ দেয়ার সামর্থ্য থাকেনা।
তবে ফখরুল মাস্টারের রয়েছে একটি শর্তও। সেটি হলো, তাকে যত টাকাই দেয়া হোক তা প্রতিদিনেরটা প্রতিদিন পরিশোধ করতে হবে, আগামীকালের জন্য কোনো টাকা বাকি রাখা যাবেনা। অনেকটা দিনমজুরের কাজের মতোই সঙ্গে সঙ্গে টাকা দেয়ার এই নিয়ম।
বাড়িতেও প্রায় ৫০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে কয়েকটি ব্যাচে পড়ান তিনি। এদের বেশিরভাগই তার কাছে বিনামূল্যে পড়ে। এখানেই টাকা পরিশোধের সেই একই নিয়ম। যদি টাকা দিতেই হয়, পড়া শেষেই তার হাতে ২০ টাকা দিয়ে যেতে হবে।
মাস্টার বলেন, 'কেউ কেউ আমাকে ধান-চাল দেয়, অথবা দুটো ডিম দেয়। আবার কেউ কেউ তাদের সাধ্যমত যত টাকা পারে দেয়। আমি কোন অভিযোগ করিনা এসব নিয়ে।'
ফখরুল মাস্টার জানালেন নিজের সহজ জীবনযাপনের কথা, "আমি কোনদিন ধনসম্পদের পাহাড় গড়তে চাইনা। আমার একটাই উদ্দেশ্য-আমি সারাদিন পড়াতে চাই। দিনশেষে যা পাই তা দিয়ে আমি বাজার করে এনে দেই আমার স্ত্রীকে যাতে সে রান্না করতে পারে। পরেরদিন আবার একই নিয়মে আমার জীবন চলে।"
বর্তমানে ফখরুল দিনে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা আয় করতে পারেন। ২০১৫ সালের দিকে তিনি একটি মোবাইল কেনেন। বিশ বছর আগে যখন কোনো মোবাইল ছিলনা তখন তিনি এলাকায় একটি নির্দিষ্ট জায়গা ঠিক করে দিতেন যেখানে সব ছাত্ররা জড়ো হত এবং তিনি ঘন্টাখানেক তাদের পড়াতেন। ২০১৫ সালের পর তার এই নিয়ম বদলে যায়।
ফখরুল মাস্টার নিজে বিত্তশালী নন, তবুও কেন তিনি বিনা পয়সায় পড়ান? এর উত্তরে তিনি বললেন, "যাতে করে আমি মৃত্যুর পর সৃষ্টিকর্তাকে জবাব দিতে পারি যে আমি সমাজের জন্য কিছু একটা করেছি।"
কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়, সমাজের জন্য ফখরুল আলমের রয়েছে সুদূরপ্রসারী চিন্তা। তিনি চান যেসব শিশুদের মা-বাবার বিচ্ছেদ হয়ে গেছে কিংবা তারা মা-বাবার থেকে আলাদা থাকে, তাদের জন্য কিছু করতে। তার মতে, সমাজে এই সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কারণেই কিশোর-কিশোরীরা বিপথে চলে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, "প্রতিদিন দেখি কত সংসার ভেঙে যাচ্ছে, বাচ্চাদের দাদা-দাদির কাছে ফেলে রেখে যাচ্ছে। এসব বৃদ্ধ মানুষ তো নিজেরাই ভালোভাবে থাকতে পারেনা, তারা একটা শিশুকে কিভাবে সামলাবে? এসব শিশুদের কোন পরিবার নেই, তারা নিজেদের সমাজের অংশ ভাবতে পারেনা। তাই তারা নিজেরা গ্যাঙ বানায়। যত বেশি পরিবারে ভাঙন আসবে, এরকম গ্যাঙ এর সংখ্যাও বাড়বে।"
ফখরুল মাস্টার এসব শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে দিতে চান যেন তারা ভুল পথে পা না বাড়ায়।
এসব বাচ্চদের অনেকের খাতা-কলম কেনার সামর্থ্যও থাকেনা। ফখরুল মাস্টার নিজে তাদের সেসব কিনে দেন। তার ভাষ্যে এগুলো খুব সামান্য হলেও তিনি যতখানি সম্ভব সাহায্য করার চেষ্টা করেন।
ফখরুল আলম বলেন, "এভাবেই আমি ২০ বছর ধরে কাজ করে আসছি। আজকে হয়ত আপনারা আমাকে চেনেন, আমার নাম খবরে আসবে। কিন্তু আমি যখন শুরু করি তখন এই চিন্তা নিয়ে শুরু করিনি।"
কেন ২০ টাকার শিক্ষক?
ফখরুল মাস্টার নিছকই একজন শিক্ষক নন, তিনি বেশ ভালো চিন্তাবিদও বটে। তিনি জানালেন, "যখন আপনার ঘরে বাচ্চার জন্যে কোনো খাবার থাকবে না, চরম দারিদ্র থাকবে তখন এমনিই মাথায় নানা আইডিয়া আসতে থাকে। দারিদ্রই আপনাকে সেই প্রবাদের কথা মনে করিয়ে দিবে, 'চাহিদাই উদ্ভাবনের কারণ'।"
তিনি নিজের মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেছিলেন ১৯৭৫ সালে। কিন্তু এরপর আর পড়া চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৭৬ সালে তিনি মাসিক ২০০০ টাকা বেতনে ঢাকার একটি হাসপাতালে পাহারাদারের চাকরি নেন। দুই বছর সেখানে চাকরি করার পর যখন ফখরুল বেতন বাড়ানোর দাবি করলেন, তখন তাকে চাকরি ছেড়ে দিতে বলা হয়।
অপমানিত অনুভব করে ফখরুল সাথে সাথেই সেই চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি বললেন, "আমি আর এত বড় মাপের মানুষদের সাথে থাকতে পারছিলাম না। তার চেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম ছোটদের সাথে থাকবো। তাই আমি শিক্ষক হতে চাইলাম, কারণ এতে ছাত্রর মা-বাবা যতই ধনী হোক না কেন, আমাকে অপমান করতে পারবে না।"
আর এভাবেই শিক্ষকতা হয়ে গেল ফখরুলের পেশা ও নেশা। এখন ফখরুল আর কোনোকিছুকেই ভয় পান না, "আমি বাচ্চাদের সাথে এখন খুব ভাল মিশে গেছি। আমি যখন সাইকেলে করে যাই, বাচ্চারা আমার সাইকেলের পেছনে পেছনে দৌড়ে আসতে থাকে আর উল্লাসে চিৎকার করতে থাকে যেন আমি হ্যামিলনের বাশিওয়ালার মত কোন গল্পের বইয়ের জাদুর ফেরিওয়ালা।"
ফখরুল আলমের সাত সন্তান রয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচজন ছেলে এবং দুজন মেয়ে। তিনি জানালেন তার সন্তানরা তাকে এখন সাহায্য করতে চায়। কিন্তু তিনি মৃত্যুর পর নিজের কাজের জবাব দিতে চান, তাই তিনি নিজে কাজ করে তৃপ্তি অর্জন করতে চান। "আমি চাই আমি যেন সমাজের জন্য সামান্য হলেও অবদান রেখে যেতে পারি", বলছিলেন একজন সুখী মানুষ ফখরুল মাস্টার।
- ফিচারটি ইংরেজিতে পড়ুন: Ferrying the light of education at Tk 20 per day