‘ত্বকফর্সাকারী’ ক্রিমগুলি খোলস পরিবর্তন করলেও মানসিকতার বদল হচ্ছে না
''স্বামী যদি আপনাকে আর আগের মতো না ভালোবাসে, যদি সহকর্মীরা আপনার মতামত আর গুরুত্ব না দেয়, মেধা মূল্যায়ন না করে; তাহলে নিজের ত্বক ফর্সা করুন। মুহূর্তেই বদলে যাবে আপনার দাম্পত্য জীবন, সফল হবেন কর্মজীবনে! এমনকি সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবেন কেবল আপনি!''
পৃথিবীর বৃহত্তম সব প্রসাধনী কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের ভ্রান্ত, কুরুচিকর ও বর্ণবাদি প্রচারণা চালিয়ে ব্যবসা করে আসছিল।
এশিয়া, আফ্রিকা আর মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে এধরনের অশোভন বার্তা প্রচার করে বাণিজ্যিক সফলতা লুটতে সবার চাইতে এগিয়েছিল- ইউনিলিভার কোম্পানির ব্র্যান্ড 'ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি'। ভারতের বাজারে এখনও প্রতিবছর লাখ লাখ ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ক্রিমের টিউব বিক্রি হয় ২ মার্কিন ডলার সমমূল্যে।
বাংলাদেশে পণ্যটির বিপুল বাজার রয়েছে। তাদের বিজ্ঞাপনী নীতি নিয়ে দেশের অধিকার কর্মীদের তরফ থেকে সমালোচনাও রয়েছে।
৪৫ বছরের পুরোনো এ ব্র্যান্ডটি অ্যাংলো-ডাচ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারকে প্রতিবছর শুধু ভারতের বাজার থেকেই ৫০ কোটি ডলার আয়ের সুযোগ করে দেয়। বাণিজ্যিক তথ্য বিশ্লেষক জেফ্রিস সূত্রে এ সম্পর্কে জানা যায়। খবর এপির।
দশকের পর দশক ধরে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের বিকৃত প্রচারণা চালানোর পর- অবশেষে বিশ্বজুড়ে প্রসাধনী কোম্পানিগুলো নতুন করে ব্র্যান্ডিং করতে বাধ্য হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ বিরোধী সাম্প্রতিক আন্দোলন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বুনিয়াদের অনেক কিছু নিয়েই প্রশ্ন তোলে। ওই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর তীব্র সমালোচনার মুখে ব্যবসায়িক প্রচারণা এবং পণ্য বিপণন কৌশল পরিবর্তনে বাধ্য হয়, তথাকথিত 'ত্বক ফর্সাকারী' ক্রিম বিক্রেতারা।
ত্বক ফর্সাকারী পণ্য মানেই 'অন্তর্নিহিত বর্ণবাদ'। কেউ কি ত্বক কালো করার পণ্যের বাজারজাতকরণ নিয়ে শুনেছেন? এমন কোনো পণ্য আছে কি, যার প্রচারণায় বলা হয়; 'কালো হলেই সবাই আপনার কথায় উঠবে-বসবে? বা আপনি হবেন আকর্ষণের মধ্যমণি?
তাই বিশ্বের বৃহত্তম রুপচর্চা ব্র্যান্ডগুলোর প্রচারণা কৌশল পরিবর্তন তাদের ব্যবসার মূল ভিত্তি কতটুকু বদলাবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কৃষ্ণ বা শ্যাম বর্ণের চাইতে উজ্জ্বল বর্ণের ব্যক্তি মানেই আকর্ষণীয়, আত্মবিশ্বাসী এ ধারণা কি মধ্যযুগীয় উপনেবেশিক মানসিকতা প্রসূত নয়!
এমন হাজার নিন্দা হজম করার পর এখন ইউনিলিভার বলছে, তারা তাদের বিজ্ঞাপনী প্রচারণা এবং পণ্যের প্যাকেট থেকে উজ্জ্বল, সাদা এবং সুন্দরের মতো শব্দ বাদ দেবে।
''সৌন্দর্য্যের সার্বজনীন লক্ষ্য প্রতিষ্ঠায়'' এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানায় কোম্পানিটি। ইউনিলিভারের ভারতীয় শাখা হিন্দুস্তান ইউনিলিভার লিমিটেড জানায়, এখন থেকে তাদের ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি ব্র্যান্ডের ক্রিম বাজারজাত করা হবে, 'গ্লো অ্যান্ড লাভলি' নামে।
এ পরিবর্তনে তারপর যোগ দেয়, বিখ্যাত ফরাসি প্রসাধনী প্রস্তুতকারক- ল'রিয়েল। তারাও নিজেদের পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজিং থেকে বর্ণবাদি শব্দ সরিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার করে।
কার্যকর পদক্ষেপ অবশ্য নেয় জনসন অ্যান্ড জনসন। নিজেদের ত্বক ফর্সাকারী ব্র্যান্ড নিউট্রেজেনা ক্রিম ও অন্যান্য প্রসাধনী বিক্রি বন্ধ করার ঘোষণা দেয় কোম্পানিটি।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রসাধনী কোম্পানিগুলো এখন যেন নিজেরা রূপচর্চার মাধ্যমে ভোল পরিবর্তন করছে।
শ্বেতাঙ্গ পুলিশের নির্যাতনে যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকেই এ খোলস পরিবর্তন চলছে। 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটারস' আন্দোলন পরিবর্তনটিতে গতি এনেছে একথা ঠিক। তবে নৈতিকতার দায় থেকে কোম্পানিগুলো এটা করছে কিনা; তা নিয়ে ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে।
এ বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে যারা এসব কোম্পানির বর্ণবাদি আচরণ ও বাণিজ্যিক প্রচারণা নিয়ে প্রতিবাদ করে আসছেন, তারা ঠিকই অনুধাবন করেন।
মিশর থেকে মালয়েশিয়া; প্রায় সর্বত্র ইউনিলিভারের ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের আগ্রাসী বাজার নীতির প্রতিবাদ করেছেন প্রকৃত নারী অধিকার কর্মীরা। জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর আগে এসব প্রতিবাদ পাত্তাও দেয়নি ইউনিলিভার।
ভারতে 'ডার্ক ইজ বিউটিফুল' প্রচারণার উদ্যোক্তা কবিতা ইমানুয়েল এমনই এক অধিকার কর্মী। প্রায় এক দশক আগে তিনি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের নগ্ন বাজারজাতকরণ বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে এ আন্দোলন শুরু করেন। এর মাধ্যমে স্বাভাবিক কালো বা গাঢ় বর্ণের নারীর চেয়ে ফর্সানারীরা বেশি সুন্দর, এমন ভুল ধারণা খণ্ডনের প্রয়াস চালান তিনি।
কবিতা সাফ সাফ জানান, ইউনিলিভারের মতো বহুজাতিক কোম্পানি ত্বকের রঙ নিয়ে বৈষম্য সৃষ্টি করেনি, বরং তারা সমাজে বিদ্যমান বৈষম্যকে বাণিজ্যিক মূলধন হিসেবে ব্যবহার করেছে।
''৪৫ বছর ধরে এ ধরনের চর্চা প্রতিপালন করা প্রচণ্ড ক্ষতিকর।'' ভারতজুড়ে অসংখ্য নারীর আত্মসম্মান ও বিশ্বাস এর ফলে ক্ষয় হয়েছে- বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সাম্প্রতিক পেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশে চলমান আন্দোলনের যে প্রভাব পশ্চিমা বিশ্বে পড়েছে, তার কারণেই বাণিজ্যিক নীতির বহিরাবরণ বদলানো হচ্ছে। অথচ উন্নয়নশীল দেশের বাজার থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা অর্জন করার পরও, এসব দেশের অধিকার কর্মীদের দাবি গুরুত্ব দেয়নি বহুজাতিক প্রসাধন বেনিয়ারা। দৃশ্যত; এটাও বিভেদমূলক আদর্শ এবং শুধুমাত্র বাণিজ্যিক স্বার্থরক্ষার উদাহরণ মাত্র।